ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ভাষা হচ্ছে সাঁওতালি ভাষা। এমনকি সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষা থেকেও। সাঁওতালি ভাষার অনেক কিছু নিয়ে এই উপমহাদেশের অনেক ভাষা আজ সমৃদ্ধ হয়েছে। নিজস্ব ভাষা ও গৌরবময় সংস্কৃতির অধিকারী হলেও সাঁওতালরা দীর্ঘদিন ধরে মুখে মুখেই তাদের ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করে এসেছেন। কোন বর্ণমালা না থাকার পরেও বর্তমান বাজার অর্থণীতির যুগে এসেও সাঁওতালি ভাষা স্বমহিমায় টিকে থাকার যে বাস্তবতা আজ বর্তমান তা সত্যিই বিস্ময়কর। তবে সাঁওতাল সমাজ যখন থেকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আসতে থাকে তখন সাঁওতালরা তাদের ভাষা ও সাহিত্যকে লিখে রাখার তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু কোন বর্ণমালায় তারা লিখবেন। তাদেরতো কোন বর্ণমালা ছিলনা। এখানে এটাও বলতে হয় যে ভাষা জন্ম হবার সাথে সাথে কোন ভাষার বর্ণমালাও নিশ্চয় তৈরি হয়না। নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি ভাষার লিপি তৈরি হয়। ফলে তৎক্ষনাতভাবে সাঁওতালরা সাহিত্য চর্চার জন্য তাদের আশেপাশের প্রতিবেশী ভাষার বর্ণমালাগুলোকেই ধার করেছে এবং যেহেতু বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সাঁওতালদের বসবাস তাই তাদের ধারকৃত বর্ণমালাগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হয়েছে। ফলে সাঁওতালি ভাষা লিখিতভাবে চর্চার ক্ষেত্রে অলচিকি, বাংলা, উড়িয়া, রোমান, দেবনাগরি, হিন্দি ইত্যাদি বর্ণমালা ব্যবহার করার উদাহরণ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের সাঁওতালরা মূলত বাংলা এবং রোমান লিপিতে সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করে আসছেন। তবে আজকাল অনেকেই সাঁওতাল জাতির স্বাতন্ত্র্যতার কথা চিন্তা করে অলচিকি লিপি চর্চার কথাও ভাবছেন। ১৯২৫ সালে সাঁওতাল পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু ‘অলচিকি’ লিপি উদ্ভাবন করেন। সাঁওতালি ভাষায় ‘অল’ এর বাংলা অর্থ লেখা এবং ‘চিকি’ এর বাংলা অর্থ লিপি। সাঁওতাল সমাজের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য, আকার, ইঙ্গিতগুলো দিয়েই সম্পূর্ণ মনোবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে অলচিকি লিপি তৈরি হয়েছে বলে অনেক সাঁওতাল এটিকে নিজেদের লিপি হিসেব বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে অলচিকি বিশ্বের প্রচলিত লিপিসমূহের তালিকা UNICODE ISO/IEC 10646 – এ অন্তর্ভূক্ত হয়ে বিশ্বের অন্যতম লিপি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ২০০৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতের সংবিধানের শততম সংশোধনীতে সাঁওতালি ভাষা ৮ম তফশীলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা হয় (সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি- সুবোধ হাঁসদা)। বর্তমানে অলচিকি বর্ণমালায় ভারতে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা দান কার্যক্রম চালু হয়েছে।
বাংলাদেশে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে প্রাথমিক স্তরে সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের জন্য ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ যূগান্তকারী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। রাজশাহী জেলায় প্রথম প্রতিষ্ঠা করে সাঁওতালি ভাষার বিদ্যালয় এবং সাঁওতাল শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করে দৃষ্টান্ত তৈরি করে। দেশের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার শিক্ষার অধিকার পূরণে সরকার যখন ব্যর্থ ঠিক তখন সমতলের আদিবাসীদের গণসংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের এই উদ্যোগ আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার আন্দোলনের একটি মাইলফলক স্থাপন করেছিল। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও এখনো দুইটি বিদ্যালয় বহাল তবিয়তে চালু আছে। ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের দীর্ঘ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। অনেকদিন পরে হলেও সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে এবং ২০১১ সাল থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের শুরু থেকে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি) শিক্ষা চালুর ঘোষনা করলেও ২০১৫ সালে এসেও তা শুরু করতে পারেনি। সাঁওতালদের বর্ণমালা নিয়ে বিতর্ক থাকার কারণে প্রথম পর্যায়ে সাঁওতালি ভাষা থাকলেও পরবর্তীতে বাদ পড়ে গেছে।
সাঁওতালি ভাষা লেখার জন্য খ্রিস্টান মিশনারীদের মাধ্যমে মূলত রোমান লিপি সাঁওতাল সমাজে চলে আসে। বাইবেল এর বাণী প্রচার প্রসারের জন্য এক সময় মিশনারীরা সাঁওতালি ভাষা চর্চা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। ফলে রোমান লিপি ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের ধর্মীয় চর্চার লিপি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে রোমান বর্ণমালা গ্রহণের পক্ষে যারা কাজ করছেন মিথুশিলাক মুরমু তাদের মধ্যে একজন। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত তার একটি লেখায় তিনি লিখেছেন ‘প্রায় প্রতিটি চার্চেরই রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, আর এই বিদ্যালয়গুলোতে অন্যান্য সাবজেক্টের পাশাপাশি রোমান বর্ণমালাতে ভাষা শিক্ষা ও ধর্মশিক্ষা পরিচালিত হয়ে আসছে।’ এছাড়া বর্ণমালা বিতর্ক নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সমর মাইকেল সরেনের লেখায় তিনি বলেছেন ‘সাঁওতালি ভাষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম লক্ষ করা যায় জয়পুরহাট জেলার বেগুনবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সালে, বেনীদুয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে, নিকেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। এ ছাড়া মিশনারি স্কুলগুলোতে এখন পর্যন্ত এর চর্চা রয়েছেই। তবে তা রোমান হরফে।’ এখানে যে বিদ্যালয়গুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সবগুলোই কোন না কোন বড় বড় খ্রীষ্টান মিশনের পাশের গ্রাম। যেখানে শতভাগ সাঁওতাল ধর্মান্তরিত হয়েছেন। সিল বাংলাদেশের একটি গবেষনা প্রতিবেদনে ৫৫ভাগ সাঁওতাল রোমান লিপি চান বলে দাবি করা হয়। তবে এখানে লক্ষনীয় যে, এই গবেষনাটির জন্য সারা বাংলাদেশের মাত্র ৭টি সাঁওতাল গ্রাম থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গ্রামগুলোও ঠিক একইভাবে বড় বড় মিশনের পার্শ্বে অবস্থিত। নিশ্চয় ৭টি গ্রামের তথ্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশের সাঁওতালদের মত কখনোই উঠে আসবে না। সাঁওতাল জাতিস্বত্তার সাহিত্য সংরক্ষণে মিশনারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর অন্তরালে সহজ সরল সাঁওতালদের ধর্মান্তরিতকরনের যে অপচেষ্টা সেটি সকলের কাছে আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছে। গত ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে দিনাজপুরের চিড়াকূটা সাঁওতাল গ্রামে ভূমিদস্যুদের হামলায় ঘটনা নিয়ে ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজে ২৮ জানুয়ারি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। যেখানে ঐ গ্রামের সাঁওতালদের খ্রিস্টান হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাদেরকে ট্রাইবাল বা সাঁওতাল ট্রাইব এইভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা এই সংবাদ দেখেও বুঝতে পারি যে খ্রিস্টান মিশনারীরা শুধুমাত্র নামমাত্রে সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে মিশনের হর্তকর্তারা তাদেরকে খ্রিস্টান হিসেবেও বিবেচনা করেনা।
সাঁওতাল জাতিস্বত্তার সাহিত্য সংরক্ষণে মিশনারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর অন্তরালে সহজ সরল সাঁওতালদের ধর্মান্তরিত করাই মূলত তাদের প্রধান কাজ। তবে মিশনারীদের বেশকিছু অবদান উল্লেখযোগ্য। যেমন তারা ধর্ম চর্চার পাশাপাশি রোমান হরফে সাঁওতালদের বেশ কিছু মূল্যবান সাহিত্য সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করেছেন। এদের মধ্যে পি ও বোডিং সাহেব, লারস ওলসেন স্ক্রেফসরুড, আলেকজান্ডার ক্যাম্পবেল এর নাম উল্লেখযোগ্য। রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা লিখতে গেলে বেশ কিছু অতিরিক্ত চিহ্নের ব্যবহার করতে হয়। এ সমন্ধে পি ও বোডিং সাহেব তাঁর Materials for Santali Grammer গ্রন্থের মুখবন্ধে ভাষার গায়ে অবাঞ্চিত দাগ বা কলঙ্কের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে সাঁওতাল জাতি নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র লিপি আবিষ্কার করলে সেদিন থেকে তারা রোমান বাদ দিতে পারেন।’
আজ যখন বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখনই সাঁওতালদের মধ্যে লিপি সংক্রান্ত বিতর্ক ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বিতর্কের কারনে সরকারী উদ্যোগের প্রথম পর্যায় থেকে সাঁওতালি ভাষা বাদ পড়লেও এখন পর্যন্ত দেশের সকল সাঁওতাল কোন বর্ণমালা ব্যবহার করবে তা নিয়ে ঐক্যমত হতে পারেনি। মিশনারীদের অনুসারি সাঁওতালরা বলছেন রোমান হরফে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হোক অন্যদিকে এ দেশের সনাতনীয় প্রথার সাঁওতালরা বলছেন, এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে আমাদের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক, রাস্তায়-হাটে-বাজারে, প্রতিবেশীর সাথে আমাদের বাংলায় কথা বলতে হয় এবং বাংলা ভাষার যেহেতু আমাদের দেশের শিক্ষার প্রধান মাধ্যম তাই এই বাংলা বর্ণমালাতেই আমরা শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। এখানে দুটি ধারা বা মতাদর্শ তাদের নিজ নিজ যৌক্তিকতা নিয়ে বাংলা বা রোমান হরফের পক্ষে কথা বলছেন। তবে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা, ব্লগের লেখালেখিতে দেখা যাচ্ছে যে দুটো দলই অলচিকি লিপি হলে সবচেয়ে ভালো হতো বলে স্বীকার করছেন। এরকম একটি দোদুল্যমান মুহূর্তে অলচিকি লিপির ¯্রস্টা পন্ডিত রঘুনাথ মুরমুর একটি উক্তিই কেবল মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, “শোষিত নিপীড়িত ও ছিন্নবিছিন্ন খেরওয়াল সমাজের মানুষ (সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, হো, বীরহড়’দের একত্রে খেরওয়াল বংশ বলে) যদি নির্দিষ্ট পথে না চলে এবং একটি নির্দিষ্ট হরফে ইতিহাস লিখে না যেতে পারে তাহলে সাঁওতালদের ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, বিভিন্ন প্রদেশের বা দেশের বিমাতৃয় ভাষায় শিক্ষিত সাঁওতাল জনগণ কোন দিনও তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের সমন্বয় সাধন করতে পারবে না।”
সাঁওতাল পন্ডিতের এই উক্তি এবং বর্তমান বিতর্কের দোদুল্যমান অবস্থা থেকে একটি চরম সত্য প্রতীয়মান হয় যে, মিশনারী অনুসারি সাঁওতাল এবং সনাতনী প্রথার সাঁওতালগণ উভয়ই বিশ্বাস করেন কেবল অলচিকি লিপি’রই সাঁওতাল সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, আচার, বিচার ইত্যাদির সাথে একটি শেকড়ের সম্পর্ক আছে এবং সাঁওতালি ভাষার জন্য এটিই একমাত্র স্বীকৃত বর্ণমালা। তাই বলতে চাই এই শেকড়ের সূত্র ধরে, বিশ্বাসের বাজি রেখে, মাদল-নাগড়া-বাঁশির সুরের টানে সাঁওতাল সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং অদূর ভবিষ্যতে অলচিকি রাজনৈতিক সীমানার গন্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর সকল সাঁওতালদের প্রাণের লিপি হিসেবে প্রতিষ্টা পাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৯