somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যু এলিজি

২৬ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুম ভাঙ্গতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠি আমি। বুকের ঠিক মাঝখানে তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা হচ্ছে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফুসফুসে একটু বেশী অক্সিজেন পাঠানোর চেষ্টা করলাম। বুকটা ব্যাথায় ফেটে গেল যেন। ভয় লাগছে। কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ করে রইলাম, তারপর আস্তে করে ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলাম। ব্যাথা কমেনি বিন্দুমাত্র, সদর্পে বিদ্যমান। এর নাম কি মৃত্যু? আমি কি মারা যাচ্ছি? মারা যেতে কেমন লাগে? সেদিন কোথায় যেন পড়ছিলাম যে মানুষের মাথা কেটে ফেলা হলে তারপরের ছয় নাকি দশ সেকেন্ড পর্যন্ত ব্রেইন চিন্তা করতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে কেমন হয় সেই চিন্তা? সেই চিন্তার অনুভূতিই কি তাহলে মৃত্যু?

এটা নিয়ে গতকাল রাতেই তিন্নির সাথে কথা হচ্ছিল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘ধরে নে, একদিন রাতে তোর সাথে কথা বলার পর আমি ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকাল থেকে কেউ আর ফোন ধরছে না, তাহলে তুই কি করবি?’। এইসব কথা বললে তিন্নির রাগ হয় আমি জানি, তবু কেন যেন মনে হল যে এই ভাবনা করাটা প্রাকটিক্যাল। কারণ, আমার ফ্যামিলি থেকে আমাকে সপ্তাহে দু-সপ্তাহে একবার হয়ত ফোন দেয়, আমার কিছু হলে সেটা তিন্নির আগে কেউ ধরতে পারবে না। তিন্নি বলল, ‘তাহলে আর কি করা? ঢাকায় আসতে হবে’।

-তুই ঢাকা চিনিস? খুঁজে পাবি আমার বাসা?
- রনির হেল্প নেব তাহলে।
-হুম, ভাল বুদ্ধি।

এই রনি হল সেই রনি যে সেই ভোররাত্রে আমার আর তিন্নির সাথে চা খেতে এসেছিল, এখন পল্লবীতে থাকে।

-কিন্তু তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস সেইটা বল।
-আমি আবার কি বোঝাতে চাইব? এমনিই জানতে চাইলাম।
-দেখ, এইসব মরে যাওয়ার কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। আর বলব না তোরে। একদিন দেখবি ঠুস করে মরে গেছি, সেদিন বুঝবি।
-এই যে আবার শুরু হইছে।
-আচ্ছা, আর বলতেছিনা।

কিন্তু তার পরদিন সকালেই যে মারা যেতে হবে এমন তো ভাবিনি। আমি একটু জোর নিঃশ্বাস নিয়ে ব্যাথাটার অস্তিত্ব ক্রসচেক করলাম। সেও একটা যন্ত্রণা দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিল। আমি পুনরায় নিস্তেজ হয়ে গেলাম।

আমি যদি এখন মারা যাই তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে ভাবতে লাগলাম। বাসায় আমি একা। রুমমেটরা কেউ নাই। একজন গত দুই মাস ধরে বাড়িতে, একজন গেছে বন্ধুর বাসায় খেলা দেখতে- আমাদের মনিটরটা আবার নষ্ট। আর একজন আছে, হরতালের কারনে আজ বাসায় আসতে পারেনি। মরার জন্য পারফেক্ট সিচুয়েশন দেখা যায়। দুপুরের আগে কারও আসার চান্স নাই। তাহলে প্রথমে আসবে হল বুয়া, সে এসে হয়ত ওদের কাউকে ফোন করবে। ওরা কেউ এসে আমার মোবাইল থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন করবে আমার বাড়িতে। তিন্নি জানতে পারবে না কারণ ও এখন অফিসে, বের হতে বিকাল হবে। আমার বাড়ির লোকজন আসতে আসতে আজকে রাত, ঝামেলা চুকিয়ে লাশ নিয়ে খুলনা ফিরতে ফিরতে আগামীকাল সকাল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দুপুরের মধ্যেই কবরে নামিয়ে দেবে, আমি হয়ে যাব শুধু ফ্রেমে বাধাঁনো স্মৃতি। বাবা-মা কাঁদবেন অনেকদিন, তারপর সয়ে যাবে। তিন্নি কি করবে বলা মুশকিল, এই মেয়েটাকে আমি এখনও প্রেডিক্ট করতে পারি না। তবু, টাইম ইজ দ্যা বেষ্ট হীলার, বেঁচে থাকলে সয়ে নেবে। এইসময় আবার এমন কিছু মানুষ আসবে যারা বেহুদা প্রশংসার চোটে আমি যেটা না আমাকে সেটা হিসেবে প্রমান করতে চেষ্টা করবে, যেটা আসলে ছিলাম সেটাই হয়ত কেউ বলবেনা। একজন মৃত মানুষের প্রতি এর থেকে বড় উপহাস আর কি হতে পারে!

ঢাকায় কিছু কিছু জায়গায় গেলে আমার কেমন যেন ডেজা ভ্যু টাইপের একটা ব্যাপার হয়। আণবিক শক্তি কমিশনের বিপরীতের ফুটপাতের দিকে তাকালে আমার মনে হয়, আজাদ স্যার হেঁটে আসছেন, পেছনে ছুটে আসছে চাপাতি হাতে কয়েকজন। শাহবাগের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের গেটের দিকে তাকালে যেন দেখতে পাই তারেক মাসুদের লাশটা বয়ে আনা এ্যাম্বুলেন্সটা ভেতরে ঢুকছে। এদের মৃত্যুতে যতটা দুঃখ পেয়েছিলাম, নিজের মৃত্যুর মূহুর্তে অবশ্য তেমন কোন ভয় বা দুঃখবোধ কাজ করছে না। শুধু একটু আফসোস হচ্ছে। ভেবেছিলাম সন্ধানীতে গিয়ে মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারটা সেরে আসব, মেডিকেলে ডেডবডি দান করার ব্যাপারটাও আলাপ করার ইচ্ছা ছিল। নানান ব্যাস্ততায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। জীবিত থেকে জগতের তেমন কোন কাজে লেগেছি বলে মনে হয়না, মরার পরে একটা চান্স ছিল, সেটাও আর হল না।

আমার সাথে আমার স্বপ্নগুলা মারা যাবে এটা চিন্তা করলেই খারাপ লাগছে। কত কিছু করার ইচ্ছা ছিল। তিন্নিটার সাথে ঘর করার ইচ্ছা ছিল, ঘুরতে যাবার ইচ্ছা ছিল। বেচারী কোনদিন সমুদ্র দেখেনি, আমি বলেছিলাম ওকে সমুদ্র দেখাব। সে কথাটাও আর রাখা হল এই জীবনে। ‘ইস্পাত’টা আরেকবার পড়ার ইচ্ছা ছিল, প্রিয় বই ‘থ্রী কমরেডস’টাও। একটা বই অনুবাদ করার কথাও ভেবেছিলাম। আরেকটা শর্ট ফিল্ম বানানোর ইচ্ছা ছিল, নামটাও ঠিক করেছিলাম – ‘গ্যাসবেলুন’। যেটাতে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম যে মানুষের মৃত্যুটা যদিও এক মূহুর্তে হয়ে যায় কিন্তু তার মানুষ হয়ে ওঠাটা অর্জন করতে হয় বহুদিনের পরিশ্রমের ফলে, অনেক আত্মত্যাগের পরে। একজন মানুষের জীবনের কৃতকর্মটাই মুখ্য। কে জানে আমার নিজের কৃতকর্মটা কতটুকু শক্ত হল!

এতসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙ্গল বুয়ার ডাকে। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। বুকের ভেতর ব্যাথা নাই ক্যান? লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। আসলেই তো ব্যাথাটা নাই। পরপর কয়েকবার নিলাম। নাহ, ব্যাথাটা চলেই গেছে দেখা যায়। এযাত্রা তাহলে আর মরতে হলোনা মনে হচ্ছে।

তিন্নি ফোন করল দুপুরে। ওর কন্ঠ শুনে কেন যেন অনেক বেশী ভাল লাগল আজকে। পরিবেশটাও কেমন যেন সুন্দর লাগছে আজ। মনটাও ভাল লাগছে। আমার মনে হল, মৃত্যু বিষয়টা আসলে ভুলে থাকার জিনিস না, মাথায় রেখে পথ চলবার বিষয়। সেটা পারলেই ‘আমি আমি’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে ‘মানুষ মানুষ’ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনটাকে দেখা সম্ভব, জীবনের আসল মানেটা খুঁজে নেওয়া সম্ভব। মোহ, ক্ষমতা, চাকচিক্য এসব আসলে অর্থহীন, জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলোই গুরুপ্তপূর্ণ হয়ে ওঠে মৃত্যুকালে।

‘প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে;
কেঁদেছিলে তুমি একা হেসেছিল সবে।
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন;
মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন’।

এর থেকে প্রার্থনীয় মৃত্যু আর কি হতে পারে!

বিঃদ্রঃ শিরোনামটা ওয়্যারফেইজের একটা গানের নাম থেকে ধার করা।

২৬ এপ্রিল, ২০১২, ঢাকা।

সুমন-তিন্নির আগের দুইটি লেখা পড়তে চাইলেঃ
১। একমুঠো বেকায়দা ভালবাসা
২। বেকায়দা যখন বাস্তব
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইনডিয়ান মিডিয়া, র এবং সংখ‍্যালঘু প্রসঙ্গ

লিখেছেন মোরতাজা, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:৫৭



১.
ইন্ডিয়ান মিডিয়াকে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্র বঙ্গে গীতা/বাইবেল জ্ঞান করা হতো। ৫ আগস্টের পর এই দেশটির মিডিয়া আম্লীগ এক্টিভিস্ট সুশান্তের আমার ব্লগের চেয়ে খারাপ পর্যায়ে প্রমানিত হয়েছে—জানায়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌন মিলনকে ধর্ষণ বলা হবে, না প্রতারণা বলা হবে?

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১:৪১

আমাদের দেশে এবং ভারতের আইনে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌন মিলনকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এই ধরণের বিধান আছে বলে আমার মনে হয় না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ, চীন ও ভারত: বিনিয়োগ, কূটনীতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ ভোর ৫:১০


প্রতিকী ছবি

বাংলাদেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরছেন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। শনিবার (২৯ মার্চ) এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্রঋণ ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনুস: এক নতুন স্টেটসম্যানের উত্থান

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ড. মুহাম্মদ ইউনুস ধীরে ধীরে রাজনীতির এক নতুন স্তরে পদার্পণ করছেন—একজন স্টেটসম্যান হিসেবে। তার রাজনৈতিক যাত্রা হয়তো এখনও পূর্ণতা পায়নি, তবে গতিপথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে নেয়া,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×