সুমন সাহেব আপনি খেতে যাবেন না? এ্যাডমিনের মেয়েটা বলে। ‘খেতে তো হবে, দেখি’ মনিটরের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দেই আমি। কিছুক্ষণ আগে ভূমিকম্প হয়ে গেছে। এই নিভো স্লাইডারটা কিছুতেই ঠিকমত কাজ করছে না। যেখানটাতে নেক্সট আর প্রিভিয়াসের এ্যারো দেখানোর কথা সেখানে ও নেক্সট আর প্রিভিয়াস লেখা টেক্সট দেখাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে গুতাগুতি করছি। এদিকে পেটও ক্ষিধায় জ্বলে যাচ্ছে।
যাইহোক কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি আহাম্মকের মত একটা কাজ করেছি। থিমের সিএসএসটা এ্যাড করি নাই, তাই এই বিপত্তি। সেটা করার পরে এইবার ঠিকমত কাজ করছে বদটা!
অফিস থেকে বেরিয়ে লিফ্টে উঠলাম। নামতে নামতে ভাবলাম, আজকে ষ্টারের বামপাশের ঐ টেবিলে বসা যাবে না। আগের দুইদিন ঐখানে বসেছি। দুইদিনেই খেয়েছি নান আর সবজি। টেবিলের বেয়ারাটা কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল শেষের দিন। আজকে ঐ টেবিলে বসলে নির্ঘাৎ এসে বলবে – ‘কি দিমু? নান আর সবজি?’। এইটা হলে ব্যাপার সুবিধার হবে না, এই রিস্ক না নেওয়াই ভাল।
মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে বিপরীত দিকে একটা রেষ্টুরেন্ট আছে, নর্দান ভার্সিটির নিচতলায়। একবার ভাবলাম ঐখানে যাব নাকি? পরমূহুর্তেই ভাবলাম যে পকেটের অবস্থা মাথায় রাখার দরকার আছে। হেঁটে সামনে যেতে লাগলাম। রাস্তার পাশে কতগুলা মেয়ে দাঁড়িয়ে বাগবাকুম বাগবাকুম করছে। উল্টোদিকে তাকিয়ে জায়গাটা পার হওয়ার চেষ্টা করতে করতে আমার একটা কথা মনে হল, আমি আসলে একটা লুজার। আর আমার এই লুজার লাইফের সাথে তিন্নির জীবনটা জড়িয়ে আমি কাজটা বিশেষ ভাল করিনি। তিন্নির কথা মনে হতেই খুলনার কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ধ্যাৎ! সেই সময়গুলোই ভাল ছিল, লাইফটা কেমন জানি হয়ে গেছে ইদানিং। সারাদিন মেশিনে বসে মেশিনের ভাষা নিয়ে কাজ করতে করতে আমি নিজের অজান্তেই কখন হয়ত একটা আস্ত মেশিন হয়ে গেছি। শালার লাইফ!
যাই হোক ষ্টারে ঢুকলাম। বামের টেবিলটা খালি। হোক খালি, আমি সোজা হেঁটে ভিতরের দিকে গেলাম। কাউন্টারের পরের টেবিলটা ফাঁকা পেয়ে বসে পড়লাম। আগের দিনের বেয়ারাটা ঘুরঘুর করছে। আমাকে না দেখলে হয়! আমার বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে এক লোক নান আর সবজি খাচ্ছে, আমার দলেরই লোক হবে মনেহয়। আমার এইখান দিয়ে বাইরের রোডটা দেখা যাচ্ছে। চারটা তরুন-তরুণী দাঁড়িয়ে আছে, সবার হাতেই সিগারেট। আহা! দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভালোই লাগে। এখনও খুলনাতে গেলে কোথাও সিগারেট ধরাতে গেলে পাঁচবার ভাবতে হয়! ডাষ্টবিনের পাশে আমাদের সেই সিগারেট খাবার জায়গাটা খুব মিস করি। গতমাসে গিয়েছিলাম ওখানে, জায়গাটা আর আগের মত নেই। ডাষ্টবিনটা নেই, নেই আমাদের সেই চায়ের দোকানটাও। সেখানে এখন ফাষ্ট ফুড টাইপের একটা পাকা দোকান। এইসব কারণেই আমি আর কোনদিন যশোরে ফিরে যাইনি। যে যশোরে আমি বড় হয়েছি সেটা আর বর্তমান এক না, আমি স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে চেয়েছি।
সিগারেটের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, তাদের সিগারেট খাওয়া(পড়ুন পান করা) শেষ হয়েছে। ছেলে দুইটা এখন চেষ্টা করছে মেয়ে দুইটার একটু বেশী কাছে গিয়ে দাঁড়াতে। বড়লোকের ছেলে-মেয়ে হলে বুঝি এইরকম হতে হয়। রেগুলার বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ, দামি গাড়ি, দামি পোষাক আরও কত কি! আমি অবশ্য ঠিক শিওর না, কারণ আমি বেশ গরীব, অত্যন্ত গরীব। জীবনে কোনদিন অভাব হয়নি সত্য, কিন্তু প্রাচূর্য কথাটা আমি শুধু অভিধানেই পড়েছি। আর গতমাসে সতের হাজারের চাকরিটা ছেড়ে অর্ধেক বেতনের চেয়েও কমদামি এই চাকরিটা নিয়ে আমি পুরা ফতুর হয়ে গেছি। বাবার কাছে হাত পাততে মোটেও ভাল লাগে নাই, কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা আর সাথে ক্যারিয়ারের ব্যাপারটা ভাবতে হয়েছে। টাকার কথা বাবাকে বলার পর বাবা একটা কথা বলেছিল আমাকে – ‘আগে তো সাত হাজার টাকায় মাস চলত এখন চলে না ক্যান?’ বাসভাড়া বেড়েছে, কারেন্টের দাম বাড়তি, বাসা ভাড়া বাড়ছে এইসব আর আমার বাবাকে আমি বুঝাতে যাইনি, চুপচাপ হজম করে নিয়েছি। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়!
ষ্টারের বেয়ারাগুলার ভাবই আলাদা। আমাকে তারা চোখেই দেখছে না। ষ্টারের বেয়ারা বলে কথা, এরা মনেহয় চেহারা দেখে বুঝতে পারে কার ক্ষমতা আছে বেশী টাকার দিয়ে খাওয়ার। আমি খাই তেত্রিশ টাকার খাওয়া, এরা আমাকে দাম দেবে না এইটাই স্বাভাবিক। অবশেষে উনার দয়া হল নাকি আমি চেয়ার দখল করে আছি দেখে আমাকে তাড়ানোর মতলবে জিজ্ঞাসা করল, কি খাবেন? তাও ভাল যে বলে নাই – কি? খাবেন? নাকি যাবেন?। আমি মুখস্ত বললাম, নান আর সবজি দেন। কিছুক্ষনপরে খাওয়া আসল। নরমালি নান দুইটা দেয়, আমাকে দিয়েছে একটা। আমার চেহারা দেখে বুঝে গেছে যে দুইটা নান খাবার ক্ষমতা আমার নাই। আমি ভোজনপর্ব শুরু করলাম।
আমার পাশের টেবিলে দুইটা ছেলে-মেয়ে অনেক সময় ধরে গুটুর-গুটুর করে গল্প করে যাচ্ছে। আমার তিন্নির কথা মনে হল আবার। বেচারি এখন অফিসে। এই অফিস অফিস করে এমবিএ ভর্তির প্রস্তুতিও ভাল করে নিতে পারছেনা ও। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমার করার কিছুই নাই কারণ আমার টাকা নাই। নিজেকে মাঝে মাঝে আমার একজন অথর্ব মানুষ বলে মনে হয়। যে কিনা কোন পূজোয়ই লাগে না।
খাওয়া শেষ। এইবার আমি এ্যাকশনে যাব। মানিব্যাগের চিপা থেকে একটা দুই আর একটা এক টাকার কয়েন বের করলাম। আর বের করলাম একটা একশ’ টাকার নোট। কাউন্টারে গিয়ে বেয়ারাকে বললাম, ‘মামা বিল বলেন’। ‘তেত্রিশ টাকা’ – সে বলে। আমি কাউন্টারে একশ’ তিন টাকা রাখলাম। ক্যাশিয়ার আমাকে ফেরত দিল সত্তর, আমি মনে মনে একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে এলাম। কয়দিন পরে হয়ত ষ্টারে আমার নাম হয়ে যাবে ‘তেত্রিশ টাকা’ বা এইজাতীয় কিছু। হোক না, মন্দ কি! এই পড়াশুনা জানা লেবাসটা না থাকলে আরও ভাল হত। লজ্জাটা কিছুটা কম লাগত হয়ত তখন।
তিন্নির কথাটা মাথা থেকে বের হচ্ছেনা। অফিসে ফিরে মেশিনের সামনে বসলেই হয়ত ভুলতে বাধ্য হব। এছাড়া আর বিকল্পই বা কি!
অঞ্জনের একটা গান শুনেছিলামঃ
আরো দু’টো ছেলেমেয়ের বয়স বেড়ে যাবে, আরও দু’টো দিনের অবসান,
আমার ছেলেমানুষিটা আঁকড়ে ধরে রেখে, লিখব আমি ভালবাসার গান…
আমার ভালবাসায় গানটা লেখার জন্য আমাকে আর কতদূর হাঁটতে হবে কে জানে! এই মূহুর্তে আমাকে আমার অফিস পর্যন্ত হাঁটতে হবে এটা অবশ্য নিশ্চিত।।
১১ এপ্রিল, ২০১২, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ১১:৫৫