আমাদের দেশে বিভিন্ন কাপড়ে বাটিক প্রিন্ট করা এখন একটি প্রচলিত ও জনপ্রিয় কর্মকান্ড৷ কেবল শহরেই নয় বরং গ্রামেও এর চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এখন যে কেউ নিজে থেকে বা পারিবারিক ভাবে স্বল্প পুঁজি ও লোকবল নিয়েই একে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন৷
এটি এমন এক ধরনের নকশা যা মোম ও রং দিয়ে গোলানো পানির মাধ্যমে নানা কাপড়ে করা হয়৷ অবশ্য বাটিক প্রিন্ট করার জন্য কাপড়ে নকশা আঁকা ও তা মোম দিয়ে ঢেকে দেওয়া বেশ জরুরি৷ বাটিক প্রিন্টকে অনেকে টাইডাই প্রিন্টও বলে থাকে৷ কাপড়ের উপর বাটিক বা টাইডাই প্রিন্ট করার আগে কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার৷ নানাভাবে কাপড়ে এই প্রিন্ট করা যায়৷ যেমন:
১. বিভিন্ন রঙের বাটিক: এজন্য নকশার বিভিন্ন অংশে একটা রং করার পর ঐ রংটা শুকিয়ে গেলে আরেকটা রং করতে হয়৷ এক্ষেত্রে প্রথমে হালকা রং ও পরে গাঢ় রং করতে হবে৷ জেনে নেই ধাপে ধাপে কি কি কাজ এজন্য করতে হবে:
মনে করুন আপনি সাদা, হলুদ, লাল,ও সবুজ- এই চার রঙে বাটিক করবেন৷ এজন্য প্রথমে সাদা কাপড়ে চার রঙের নকশা এঁকে নিতে হবে।
এরপর নকশার কোন অংশে কি রং দেবো তা ঠিক করতে হবে।
নকশার যে অংশ সাদা রাখবো সে অংশ মোম দিয়ে ঢেকে ১ ঘন্টা রেখে দিতে হবে যাতে কাপড়ের মোম শুকিয়ে যায়।
এরপর হলুদ রং গুলে তাতে ১ তোলা প্রুশিয়ান হলুদ রং, ঌ চা চামচ লবণ এবং ২ চা চামচ সোডা নিতে হবে৷ এগুলো পানিতে গুলিয়ে প্রুশিয়ান রঙের পদ্ধতিতে কাপড়ে হলুদ রং করতে হবে।
এরপর কাপড়টি ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে৷ নকশার যে অংশ হলুদ রাখা হবে সে অংশ ও একইসাথে সাদা অংশও মোম দিয়ে ঢেকে দিতে হবে৷ তারপর একইভাবে মোম শুকিয়ে নিতে হবে।
এরপর একইভাবে নীল রং গুলে কাপড়টি রং করলেই কাপড়টি নীল হয়ে যাবে৷ এখন কাপড়টি ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে।
একইভাবে কাপড়ে লাল ও সবুজ রং করে তা ছায়ায় শুকিয়ে আগের নিয়মে কাপড়ের মোম উঠিয়ে ফেলতে হবে৷ এভাবে কাপড়টিতে চার রংয়ের বাটিক করা হয়ে যাবে।
সবশেষে কাপড়ে মাঢ় দিতে হবে৷ আর মাঢ় শুকিয়ে গেলে কাপড়টি ইস্ত্রি করতে হবে।
২. তুলি দিয়ে রং লাগিয়ে বাটিক: তুলি দিয়েও নকশার নানা অংশে নানা রং লাগিয়ে বাটিক করা যায়৷ এজন্য তুলি দিয়ে নকশায় রং দিতে হয়৷ এরপর ব্রাশ দিয়ে নকশার উপর মোম দিয়ে ঢেকে দিতে হয়৷ এটাকে ব্রাশ বাটিক বলা হয়৷ অবশ্য এজন্য কিছু জিনিস লাগবে৷ যেমন-
(১ মিটার কাপড়ের জন্য)-
আধা চা চামচ ফাইনগাম
আধা তোলা বিভিন্ন রঙের প্রুশিয়ান
১ চা চামচ ইউরিয়া
১ চা চামচ রেজিষ্ট সল্ট
আধা চা চামচ কাপড় কাচার সোডা
১ কাপ পানি
১ চা চামচ খাবার সোডা
১ চা চামচ গ্লিসারিন
এখানে তুলি দিয়ে রং লাগিয়ে বাটিক করার ধাপগুলো দেওয়া হল:
প্রথমে একটি নকশা এঁকে নিতে হবে৷ এরপর রং গুলে তুলি দিয়ে নকশার যে যে অংশে যে যে রং করতে হবে সে সে অংশে সে সে রং করতে হবে৷ রং করার সময় কাপড়ের নিচে অবশ্যই কাগজ দিয়ে নিতে হবে।
এরপর কাপড়টি ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে সবকটি রং মোম দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
মোম শুকালে পুরো কাপড়টি অন্য একটি রঙে ডুবিয়ে নিলেই জমিনে আরেকটি রং হয়ে যাবে।
এবার মোম তুলে কাপড়টি শুকিয়ে নিতে হবে৷ দেখা যাবে কাপড়টি বহু রংয়ে বাটিক হয়ে যাবে।
মনে রাখা দরকার, ফাইনগাম দিয়ে কাজ করতে হলে ২/৩ দিন আগে তা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ও খেয়াল রাখতে হবে যেন ফাইনগামে কোনো দানা না থাকে৷ তাড়াতাড়ি কাজ করার প্রয়োজন হলে ফাইনগামের পরিবর্তে এলজিনেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. নেপথল পদ্ধতিতে রং লাগিয়ে বাটিক: বাটিক প্রিন্টের ক্ষেত্রে খুব ভালো রং করতে চাইলে নেপথল পদ্ধতিতে রং করা ভালো৷ তবে এই পদ্ধতিতে শুধু সিল্কের ও সুতির কাপড় বাটিক করা যায়৷ এক্ষেত্রে নকশা আঁকা, মোম লাগানো ও মোম উঠানো আগের নিয়মে করতে হবে৷ এক্ষেত্রে ২ টা পাত্র লাগবে যেখানে কি কি থাকবে তা নিচে দেওয়া হলোঃ
(১ মিটার কাপড়ের জন্য)
উপকরণের নাম উপকরণের পরিমাণ
১ম পাত্র ১ চা চামচ
নেপথল- এ.এস ১ চা চামচ
নেপথল বি এস ১ চা চামচ
মনোপোল সোপ ১ চা চামচ
কষ্টিক সোডা ২য় পাত্র
এলুমিনা সালফেট ১ চা চামচ
সোডিয়াম নাইট্রেট ১ চা চামচ
সালফিউরিক এসিড ১ চা চামচ
নেপথল রং জিবিসি-চকলেট, জি সি-কমলা প্রয়োজনমত
এখন জেনে নেই কিভাবে এক্ষেত্রে বাটিক করতে হবে:
• প্রথমে একটি পাত্র পাত্রে পানি, নেপথল এ.এস., নেপথল বি.এস. ও ১ চা চামচ মনোপোল সোপ নিয়ে ভালোভাবে মেশাতে হবে।
• এরপর ঐ পানিতে ১ চা চামচ কষ্টিক সোডা নিয়ে চুলায় হালকা আঁচে তা ফুটাতে হবে।
• এরপর তা নামিয়ে ঠান্ডা করে ছেকে নিতে হবে।
• আরেকটি পাত্রে এই ৪ টি কেমিক্যাল ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে৷ এরপর পাতলা কাপড় দিয়ে ছেকে নিয়ে কাপড়টি ৩০ মিনিট ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
• এরপর কাপড়টি প্রথম পাত্রে ৫ মিনিট ডুবিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে৷ আবার কাপড়টি তুলে ৫ মিনিট দ্বিতীয় পাত্রে ডুবিয়ে রাখতে হবে৷ এক সময় দেখা যাবে কাপড়ে রং ফুটে উঠছে।
• এভাবে আরো দুবার প্রথম ও দ্বিতীয় পাত্রে পরপর তা ডুবিয়ে নিতে হবে৷ সবশেষে ২য় পাত্র থেকে তা তুলে নিয়ে ছায়ায় রেখে ২৪ ঘন্টা শুকাতে হবে।
• এরপর সাবান গোলা ফুটন্ত গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট কাপড়টি উলট-পালট করে সিদ্ধ করতে হবে।
• সিদ্ধ হয়ে গেলে কাপড়টি ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে আবার ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে৷ এবার শুকানো কাপড়টি ইস্ত্রি করে নিলেই নেপথল পদ্ধতিতে বাটিক করা হয়ে যাবে।
বাটিক প্রিন্ট করার সময় কিভাবে সাবধান থাকতে হবে
যেকোনো কাপড়েই বাটিক বা টাইডাই প্রিন্ট করার সময় নিচের কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার:
• ন্যাপথল পদ্ধতিতে রং করতে হলে চোখ সাবধানে রাখতে হবে ও দস্তানা পরে কাজ করতে হবে।
• প্রিন্ট করার সময় কেমিক্যালগুলো খুব সাবধানে চামচ দিয়ে মেশাতে হবে ও খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরের কোথাও তা না লাগে৷ কারণ শরীরের কোথাও তা লাগলে চামড়া পুড়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:১৩