(১ম, ২য় ও ৩য় পর্বের লিংক কমেন্টে দেয়া থাকবে।)
ভোর পাঁচটার মধ্যেই আমরা আমাদের ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নৌকায় উঠে গেলাম। ভাতঘর হোটেল থেকে রাতে অর্ডার দিয়ে রাখা খিচুড়ির প্যাকেটও নিয়ে নিলাম। চারপাশ এখনো অন্ধকার। কিছুটা আলো ফোটার অপেক্ষায় মাঝি খানিকটা সময় নিয় ট্রলারের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দিলো। আমরা এখন যাবো উলুছড়ি। যাওয়ার পথে দুটি আর্মি ক্যাম্পে আমাদের এনআইডি জমা দিয়ে অনুমতি নিতে হবে
এখন বৃষ্টি না হলেও আকাশে মেঘের দাপাদাপি চলছেই। কিছু মেঘ ছুটাছুটি করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। আবার কিছু মেঘ পাহাড়ের গায়ে অলস ভাবে শুয়ে আছে। শুয়ে থাকা শুভ্র মেঘগুলোকে দেখে মনের মাঝে কেমন যেন মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে যায়।
পনের মিনিট পরেই আমরা প্রথম আর্মি ক্যাম্পে চলে এলাম। রিপোর্টিং সেরে যখন রওনা দেই তখন অন্ধকার পুরপুরি কেটে গেছে। রাতে বৃষ্টি হওয়াতে আরো বেশি সজীব লাগছে।
বৃষ্টিস্নাত সকালের শীতল বাতাসে কিছুটা হিম হিম লাগছে। রোদের আনাগোনার কোন খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সঙ্গে করে নিয়ে আসা খিচুড়ি খেয়ে নিজেদের চাঙা করে নেয়ার চেষ্টা করলাম।
লেকের স্বচ্ছ পানি এখন কিছুটা ঘোলা। আবার স্রোতও আছে। গতরাতের বৃষ্টির পানি পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে আর সাথে করে নিয়ে আসছে পাহাড়ি পলি।
লেকের পাশ ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। আমরা গহীন থেকে আরো গহীন অরন্যের দিকে যাচ্ছি। মোবাইল নেটওয়ার্ক আরো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। এভাবে চলতে চলতে আমরা একসময় উলুছড়িতে এসে পৌঁছলাম। একটু আসতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘন্টা লেগেছে।
এখান থেকে আমাদের একজন গাইড নিয়ে কোশা নৌকায় করে যাত্রা শুরু করতে হবে। গাইডের জন্য খরচ হবে ৬০০/- টাকা আর প্রতি নৌকার ভাড়া ৩০০/- টাকা। এক নৌকায় চারজন করে যেতে পারে। এ নৌকাগুলো অনেকটা তালগাছের খোলের মতো, যেটাকে আমরা আঞ্চলিক ভাবে কোন্দা বলে থাকি। এতে একটু নড়াচড়া করলেই উল্টে যায়।
আমাদের এক বন্ধু বললো তার পায়ের রগে টান লেগেছে। সে যাবে না। ট্রেকিংয়ের ভয়ে বলেছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমাদের কাছে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। ঘাটে যে আমাদের নৌকা ও গাইড ঠিক করে দিল, তার কাছেই দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। কথা মতো আমাদের মাঝি মুরগী জবাই করে দেবে, কেননা উপজাতিদের জবাইয়ের উপর আমাদের আস্থা নেই। রান্নাবান্না করে সব খাবার নৌকায় নিয়ে আসা হবে।
এক বন্ধুকে ট্রলারে রেখে কোশা নৌকা নিয়ে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর গিয়েই সমতল ভূমি। এখানেও ধান চাষ করা হয়েছে। দূুরের পাহাড়ের গায়ে এখনো পেঁজা তুলার মতো মেঘ জমে আছে। পাহাড়ের গায়ের গাছগুলো ভেজা শরীর নিয়ে রোদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের হাঁটার রাস্তা খুবই পিচ্ছিল। কাদার মাঝে জুতা গ্রিপ করছে না। তার উপর রয়েছে জোঁকের ভয়। বৃষ্টি হলে জোঁকের উপদ্রোব বেড়ে যায় বহুগুণ।
এর মধ্যেই এক বন্ধুর হাতে কোথা থেকে একটি জোঁক এসে পড়লো। সে তো ভয়ে অস্থির। আমাদের গাইড "মঙ্গল সেন" দৌড়ে এসে গাছের পাতা দিয়ে জোঁকটিকে সরাল। সে তখন পরামর্শ দিল, যথা সম্ভব গাছের সংস্পর্শে না আসার জন্য। এ জোঁক গাছের পাতা থেকেও লাগতে পারে।
এর মধ্যে আমরা সমতল ভূমি পার হয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছি। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ে উঠাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বার বার পা পিছলে যাচ্ছে। গাইড জানালো আমাদেরকে দুটো উঁচু ও একটি ছোট পাহাড় ডিঙাতে হবে।
প্রথম পাহাড়ে উঠতেই আমাদের জান প্রায় বেরিয়ে যায় আর কী! এর পর আগের দিনের মতো ঝিরি পথ। পাথর, পানি আর বালু-কাদা দিয়ে হেঁটে চলা। পথে আমাদের কিছু উপজাতির সাথে দেখা হলো। এদের মধ্যে একদল আবার পাংকু। এরা নাকি খ্রিষ্টান। গতকাল নিজাম ভাইয়ের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম, এরা বিদেশ থেকে প্রচুর সাহায্য পায়। আমরা তাদের সাথে দু'একটা বাক্য বিনিময় করলাম।
একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মুগ্ধ বিস্ময়ে চারপাশে তাকালাম। কাছে দূরে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়। মাঝে মাঝে খাড়ি। কোথাও কোথাও লেকের পানি দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে উঁচু উঁচু বনজ গাছের সারি। এতো এতো সবুজ দেখলে মনটাও সবুজ হয়ে যায়।
বহু কষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা শেষ পাহাড়ের উপরে এসে পৌঁছলাম। এখানে একটি দোকান রয়েছে। আমরা কিছু খেয়ে শরীরে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। এ পাহাড়ের নিচেই রয়েছে আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত সেই ধুপপানি ঝর্না।
ঝর্নার উপরে একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। সেখানে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ধ্যান করে। তার সম্পর্কে কিছু গল্প প্রচলিত আছে। আমরা সে দিকে আর মনোযোগ না দিয়ে ঝর্না দেখার জন্য পাহাড়ের নিচে নামতে লাগলাম। হাঁটার রাস্তা মোটেও সুশোভিত নয়। অনেকটা হাড়ভাংগা খাটুনি খাটতে খাটতেই আমরা নিচে নামছি। একটু অসতর্ক হলে পিংপং বলের মতো লাফাতে লাফাতে নিচে নামতে হবে। তখন আমাদের হাড্ডি মাংস কোনটা কোন দিকে যাবে, তা অনুমান করাও দুরূহ।
ঝর্নার জল পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শব্দ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে আর আমাদের মনের মাঝে হর্ষধ্বনি ফেটে পড়ার জন্য ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর তর সইছে না। আবার পথও ফুরাচ্ছে না। পাহাড় থেকে নেমে আবার কিছুটা ঝিরি পথ। এবং এ পথটিও বিপদজনক। খুব সাবধানে সে পথ পাড়ি দিয়ে একেবারে ঝর্নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। মুখের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। চোখে পলক পড়ছে না। আহা কী সুন্দর! আহা কী সুন্দর! সুবহানাল্লাহ।
আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ঝর্না এটি। প্রায় চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা। এর উচ্চতা অনুমান করা সহজ নয়। তবু আমাদের মনে হয়েছে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ ফিট হতে পারে। দেরি না করে নেমে পড়লাম ঝর্নার পানিতে গা ভিজাবো বলে। ঝর্নার পেছন দিকে সুড়ঙ্গের মতো আছে। ওখানে চলে গেলাম। আহা কী শান্তি! আহা কী শান্তি! আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাকে এতো সুন্দর একটি ঝর্না দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সময় কীভাবে বয়ে যাচ্ছে, জানি না। আমাদের কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমাদের গাইড তাড়া দিল, এখন যেতে হবে। বৃষ্টি আসতে পারে। তখন পাহাড় ডিঙানো কষ্ট হবে। আমরা আকাশের দিকে তাকালাম। বৃষ্টির কোন লক্ষ্মণ দেখতে পেলাম না। ভাবলাম সে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য এমনটা বলছে। তবু তার তাগাদার প্রেক্ষিতে অগত্যা আমাদের অনিচ্ছা সত্যেও ফেরার পথ ধরতে হলো। বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছি। আর কী আসা হবে এখানে? আর কী হাঁটা হবে এ পথ ধরে?
ফেরার পথে সেই বৌদ্ধ মন্দির হয়ে আমরা চলে গেলাম ঝর্নার ঠিক উপরে। গাইড আমাদের সাবধান করে দিলো, সামনে যাওয়া যাবে না। নয়তো পা পিছলে পড়ে গেলে জলের ধারার সাথে সাথে আমরাও ভেসে যাবো আর পড়বো একেবারে নিচে। আল্লাহ না করুক, তেমন যেন না হয়।
এখান থেকে ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি, তখনই গাইডের কথা সত্যি হলো। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। কিন্তু আমাদের তো থেমে থাকলে চলবে না। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। কী আর করা, খেয়েছি ধরা। পার হতে হবে গিরি খাত ছড়া।
শেষ পর্যন্ত দেহের শক্তি প্রায় নিঃশেষ করে যখন আমরা আমাদের ট্রলারের কছে পৌঁছলাম তখন দেখি, দুপুরের খাবার রেডি। দেরি না করে খেতে শুরু করলাম। আলুর ভর্তা, শুটকির ভর্তা, মুরগির গোস্ত আর ডাল। গোগ্রাসে খেলাম। মনে হলো জীবনে এতো মজার খাবার কখনো খাইনি। শুটকির ভর্তা ছিল প্রচন্ড ঝাল। আর খাবারগুলো লাকড়ির চুলায় রান্না। কী যে মজা করে খেলাম বলে বোঝাতে পারবো না। এ খাবারের গল্প হয়তো জীবনে বহুবার বহুজনের কাছে করবো।
ফেরার পথে প্রতিটি আর্মি ক্যাম্পে আবারো রিপোর্ট করে আসতে হলো। এবার অবশ্য সময় অনেক কম লাগলো। চারটা বাজে বিলাইছড়ি এসে লেকের পানিতে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে হোটেলে ফ্রেস হয়ে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এ ফাঁকে ভ্রমণ ইচ্ছুকদের জন্য প্রয়োজনীয় মোবাইল নম্বরগুলো এখানে দিয়ে নেই।
ট্রলারের মাঝি শাহাদাত ভাই - ০১৮২৫৪২৫৭৯৬
নিরিবিলি বোডিং ও শশী ভাই- ০১৮৫৯২১২৭৭২, ০১৫৫৩১২৮৬৭৩
ভাতঘর হোটেল ও নিজাম ভাই- ০১৮৬০০৯৯০৪৯
নীলাদ্রি রিসোর্ট ও সাত্তাই ভাই - ০১৫৫৬৫৫১৭১৪
কাপ্তাই যখন পৌঁছেছি, তখন সন্ধ্যা সাতটা। আমাদের গাড়ি সাড়ে আটটায়। এতক্ষণ কী করি? বাস কাউন্টারে কোন টয়লেট নেই। এখন ফ্রেস হই কীভাবে? এর মাঝে ঝাল খেয়ে এক বন্ধুর পেটে জোয়ার এসেছে। মসজিদে গিয়ে দেখে টয়লেটে তালা ঝুলানো। এখানে নাকি একটি পাবলিক টয়লেট আছে। সেটি আবার সরকারি অফিসের শিডিউল মতো নয়টা-পাঁচটা খোলা থাকে কিন্তু মানুষের টয়লেট তো আর সরকারি টাইম টেবিল মেনে চাপে না। হায় হায়, কী ভয়াবহ সমস্যা!
শেষে কোনরকমে এক খাবার হোটেলের ম্যানেজারকে রিকুয়েষ্ট করে তাদের যাওয়ার জায়গায় গিয়ে পেটের চাপ সামাল দিয়ে বন্ধু আমার গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি ছাড়তে ছাড়তেই প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমাদের চোখ বুঁজে এলো।
বিদায় বিলাইছড়ি, বিদায় নকাটা ঝর্না, বিদায় মুপ্পোছড়া ঝর্না, বিদায় ধুপপানি ঝর্না। হয়তো আবার কখনো দেখা হবে, হয়তো হবে না। বিদায় বিদায়।।
আবদুল্লাহ আল মামুন
রচনাকাল - ০৭ নভেম্বর ২০২০ ( ভ্রমণকাল ২৯-৩১ অক্টোবর ২০২০)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:১৫