(১ম ও ২য় পর্বের লিংক কমেন্টে দেয়া থাকবে।)
বিকেলে চারটায় আমাদের বেরুবার কথা। এক একজনকে ডেকে উঠানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাদেরকে উঠাতে হলে ক্রেন ভাড়া করতে হবে। এখন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রেন কোথায় পাই? শেষ পর্যন্ত সারে চারটায় বেরুলাম। এখন অবশ্য তাড়াহুড়ো নেই। খুব আয়েশি ভঙ্গিতে নীলাদ্রি রিসোর্টের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। এখান একটাই রাস্তা, যা বাজার হয়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। সকালের জমজমাট বাজার এখন প্রায় জনশূন্য।
এক দোকান থেকে গাছপাকা বাংলা কলা কিনলাম। পাহাড়ের এ কলাটি অসম্ভব মজার। যে একবার খেয়েছে, সে আবার খেতে চাইবে। কলা খেতে খেতে হাঁটছি আর রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘরগুলোকে দেখছি। বেশিরভাগই কাঠের পাটাতনে মুলিবাঁশের দিয়ে তৈরি। এখানে কিছুটা ঘনবসতি হলেও পুরো পাহাড়ি অঞ্চলটা এমন না। বিলাইছড়িতে আমরা যতটুকু দেখলাম, তাতে পাহাড়ি আর বাঙালি প্রায় সমান সমানই বলা যায়।
কিছুদূর হাঁটার পরই দেখলাম রাস্তার উপর দিয়ে একটি ছোট ঝুলন্ত ব্রিজ। মনে হয়, রাস্তা বানানোর জন্য যে পাড় কাটা হয়েছে, ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে তা আবার জুড়ে দেয়া হয়েছে। আরেকটু সামনে এসে বুঝলাম, এটিই "নীলাদ্রি রিসোর্ট"। পাহাড় বেয়ে উঠে ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে খুব অবাক হলাম। সত্যি খুব সুন্দর একটি রিসোর্ট।
একপাশে কাঠের পাটাতন দিয়ে খুব সুন্দর বসার জায়গা করা হয়েছে। ওখানে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালে গা হিম হয়ে যায়। নিচে বিশাল খাড়ি। দূরে অন্য অনেকগুলো পাহাড়ের সারি। এর একটু ডানে ঘুরলেই দেখা যাবে লেকের নীল জলরাশি।
কাছেই রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। আমরা ওখানে উঠে গেলাম। এখন থেকে চারপাশটা খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে। এই রিসোর্টে তিনটি পৃথক ঘর রয়েছে। সাথে সুন্দর বারান্দা। দেখলেই মন ভরে যায়। আগে জানা থাকলে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করা যেতো। দূরের পাহাড়ে বৃষ্টির পতন দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হয় এখানেও চলে আসবে। আমাদের মতো আরো দর্শনার্থী এখানে এসেছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য তারাও ওয়াচ টাওয়ারে এসে উঠেছে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি আমাদেরকে ঘিরে ফেললো। এ আবার অন্য রকম অনুভূতি। বৃষ্টিতে গোসল করতে থাকা পাহাড়গুলোকে দেখছি। ভেজা ভেজা বাতাস আমাদেরকেও হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার যেন চারপাশটাকে দ্রুত ঢেকে দিচ্ছে। আজ ভরা পূর্ণিমা হলেও চাঁদের কোন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মেঘ চাঁদকে উঁকি দেয়ারও সুযোগ দিচ্ছে না।
বৃষ্টি যখন প্রায় থেমে এসেছে তখন আমরা নিচে নামলাম। রাস্তার পাশে সুন্দর একটি রেস্টুরেন্টে। প্রসস্ত বসার জায়গা। আমরা নামাজ পড়তে চাচ্ছি জেনে তারা খুব দ্রুত একটি জায়গা পরিষ্কার করে দিলো। নামাজ পড়ে চা খেয়ে বৃষ্টি পুরোপুরি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সবাই ঢাকা শহরে থাকলেও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের সাথে আগের মতো আর আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয় না। চাকরি, সংসার আর নাগরিক ব্যস্ততার ভিড়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলি। আজ শহর থেকে এতো দূরে এসে আমরা যেন আবারও আমাদের হারানো শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনে ফিরে গেলাম।
বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তা ধরে সামনে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে একটি ব্রিজ রয়েছে। ট্রলারের মাঝি, শাহাদাত ভাইকে ফোন করে দিয়েছি সেই ব্রিজের কাছে আসার জন্য। এখানে রবি আর টেলিটক ছাড়া অন্য মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। তাই যারা এখানে আসতে চান, তারা এদুটোর যেকোনো একটি সিম সঙ্গে আনবেন। নয়তো আপনাকে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যেতে হবে।
লেকের মাঝখানে ট্রলার ভাসিয়ে পূর্ণিমা দেখার পরিকল্পনা আমরা আগেই করেছিলাম। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই ট্রলারকে নিয়ে গেলাম লেকের মাঝখানে। কিন্তু চাঁদ তো মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে। এমন রোমান্টিক পরিবেশে দেখা দিতে মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে। একটু পরে বেরসিক বৃষ্টি আবার আমাদের তাড়িয়ে ভাতঘর হোটেলে নিয়ে বসালো।
এটি মূলত হোটেল নয়। নিজাম ভাই ও তাদের যৌথ পরিবারের থাকার জায়গা। পারিবারিক ভাবে রান্না করেই তারা ট্যাুরিস্টদের খাবার আয়োজন করে থাকেন। এখানে আবাসিক ব্যবস্থাও আছে। এটি নিজাম ভাইয়ের নতুন সংযোজন। নিজাম ভাই চমৎকার মানুষ। দারুণ স্মার্ট। তার কথা বলার ধরণ যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। তিনি আমাদের এ অঞ্চলের অনেক তথ্য জানালেন। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও আমরা জানলাম। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন ভিশনারি মানুষের দেখা পেয়ে সত্যি আমরা ভীষণ অবাক হয়েছি।
ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরাও খাওয়া-দাওয়া সেরে আবারও ট্রলারে উঠে পড়লাম। মিশন "লেকের পানিতে ভেসে ভেসে চন্দ্র-স্নান"। ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ। দূরের পাহাড়গুলো অন্ধকারে ডুব দিয়ে আছে। প্রায় নিস্তরঙ্গ লেকের পানি। সামান্য স্রোত আমাদের ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘের ছুটোছুটি। আমাদের মনেও অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারা বহমান। এমন একটি নিস্তব্ধ রাত অনেক অনেক প্রতিক্ষার পরে হয়তো পাওয়া যায়।
কিন্তু যে পূর্ণিমা দেখবো বলে এতো আয়োজন, তার তো দেখা নেই। মেঘের দল বুঝি পণ করেছে, আজ কিছুতেই তাকে বাইরে আসতে দেবে না। ওদিকে ঘড়ির কাটা তো থেমে নেই। রাত অনেক হয়েছে। ধুপপানি ঝর্নায় যাওয়ার জন্য আমাদের ভোর পাঁচটায়ই ট্রলারে উঠতে হবে। তাই মেঘের আড়াল থেকে সে যতটুকু আলো ছড়ালো তা দেখেই সন্তুষ্ট চিত্তে আমরা রুমে ফিরলাম।
গভীর রাতে ভীষণ বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙলো। ভাবলাম, সকালেও যদি এতো বৃষ্টি থাকে, তাহলে কী হবে? আমরা ধুপপানি ঝর্না দেখতে যেতে পারবো তো?
(চলবে)
আবদুল্লাহ আল মামুন
রচনাকাল - ০৪ নভেম্বর ২০২০ ( ভ্রমণকাল ২৯-৩১ অক্টোবর ২০২০)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৩৩