(১ম পর্বের লিংক কমেন্টে দেয়া থাকবে।)
নিরিবিলি বোডিং হলো বিলাইছড়ির পুরোনো বোডিংগুলোর একটি। কাঠের পাটাতনের উপর টিন ও মুলিবেড়া দিয়ে রুমগুলো বানানো হয়েছে। পশ্চিম পাশের জানালা দিয়ে লেক দেখা যায়। এখানে দুটি কমন বাথরুম রয়েছে। মোটামুটি স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। আবাসিক হোটেল বলতে যা বুঝায়, এখানে তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। তবে নীলাদ্রি নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে যা আমরা পরে জানতে পেরেছি। এর বর্ণনা পরে দেবো।
ফ্রেস হয়ে রুমে ব্যাগ রেখে আমরা চলে গেলাম স্থানীয় বাজারে। পাহাড়ে ট্রেকিং করার জন্য ট্রেকিং সু বা বেল্টওলা সেন্ডেল প্রয়োজন। এগুলো নিয়ে আসার জন্য সবাইকে আগে থেকে ইন্সট্রাকশন দেয়া হলেও আমাদের দুই বন্ধু তা আনেনি। এমনটি সবসময়ই হয়। সবাই কথা শুনে না। তবে আশার কথা, এ বাজারে তা পাওয়া যায়। বাজারে উপজাতি ও বাঙালিরা তাদের পশরা সাজিয়ে বসে আছে। হাওরের মাছ, টাটকা সবজি, পাহাড়ি বাংলা কলা, আরো কত কী! পাহাড়ি ধানি মরিচ দেখে লোভ লাগলো। এগুলো অনেক ঝাল। তড়িঘড়ি করে ১২০/- টাকায় এক কেজি কিনে নিলাম। ঢাকায় গত সপ্তাহেও ৩০০/- টাকা কেজিতে মরিচ কিনেছি। অনেক কম টাকায় মরিচ কিনতে পারায় মনে বাড়তি আনন্দ যোগ হলো।
ট্রলারে ওঠার আগে ভাতঘর হোটেলে আমরা আমাদের দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। আইটেম ভেদে জনপ্রতি একজনের একবেলা খাবারের খরচ ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো, ট্রলারের মাঝির খাওয়ার ব্যবস্থাও আমাদের সাথে।
অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ট্রলারে এসে উঠলাম। সাথে যুক্ত হলো আমাদের গাইড "সাজে"। তার নামটি উচ্চারণ করতে আমার অনেক বেগ পেতে হলো। সে উপজাতি। আরো একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ট্যাকিং এর সময় কোন ভাবেই কোট-টাই পরে ফুলবাবু সাজা যাবে না। আমরা যথা সম্ভব ঢিলেঢালা পোশাক পরে নিলাম। লেকের পানিতে ২৫ মিনিট চলার পর ট্রলারটি একটি সমতল ভূমির পাশে ছোট খাল বা ঝিরিতে এসে থামলাম। চারদিকে পাহাড়। এর মাঝে কিছুটা সমতল ভূমি। তার মাঝেই ধান চাষ করা হয়েছে। খালের পাড়ে দেখলাম কলার ছড়া কেটে কেটে জড় করা হচ্ছে, হাটে নেওয়ার জন্য।
সমতল পথ ধরেই আমাদের ট্যাকিং শুরু। কিছুটা পথ হাটার পরই ঝিরি পথ ধরে পাহাড়ে উঠা শুরু। দুপাশের গাছগুলো নুয়ে এসে পথটিকে অন্ধকার করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর। কোন কোন পাথর উচ্চতায় আমাদের কয়েকগুণ। কোন কোন পাথরে শেওলা জমে খুব পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমরা সবাই একটা করে লাঠি নিয়ে নিয়েছি। পাহাড়ি রাস্তায় হাটার জন্য এটি খুব কাজে দেয়।
পাহাড়ে হাঁটার জন্য অনভ্যস্ত পা কিছুটা সময় পরই ভারি হয়ে গেলো। সময়ে সময়ে পা পিছলে যেতে লাগলো। হাতের লাঠির মাধ্যমে কোন রকমে তাল সামলে এগিয়েছে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই ঝিরি পথের পাশে পাহাড়ে উঠতে হচ্ছে। একপাশে পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা হাজারো গাছের ঝোপ। যে দিকে তাকালে দিনের বেলাও গা হিম হয়ে যায় আর অন্য পাশে বিশাল খাড়ি। একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে পড়ে যেতে হবে নিচে। আর নিচে পড়ে গেলে দেহের মাঝে প্রাণপাখি থাকলেও চামড়া আর মাংস থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। কেননা, খাড়ির পাশে পাথরের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরণের গাছ ও গুল্মলতা। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে গেলেই কোন কোন লতা পিছন থেকে টেনে ধরে। এমন গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়েই এগিয়ে চলছি।
ইতোমধ্যে পরনের জামা-কাপড় ঘামে ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছে। বিলাইছড়ি বাজার থেকে নিয়ে আসা আখ এখন আমাদের দারুণ তৃপ্তি দিল। মনে হলো এতো ভালো আখ জীবনে খাইনি। মাঝে কিছুটা দম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করি। ঝর্নার পানির বিমোহিত শব্দ কানে ভেসে আসছে। ভাবছি আর একটু পরেই হয়তো দেখতে পাবো তাকে। কিন্তু আমাদের গাইড জানালো, যাত্রা পথের প্রথমে "নকাটা" ঝর্না পড়লেও আমরা আগে যাবো "মুপ্পোছড়া" ঝর্নায়। মূলত মুপ্পোছড়া ঝর্নার পানি থেকেই নকাটা ঝর্নার সৃষ্টি। সেটি এখান থেকে আরো দূরে। আরো প্রায় আধাঘন্টা হাঁটতে হবে।
পাহাড়ের আরো উঁচুতে উড়তে গিয়ে দুই বন্ধু কয়েকবার আছাড় খেলো। ভাগ্য ভালো বড় কোন অঘটন ঘটেনি। দুই পাশে উঁচু পাহাড় আর মাঝখানে ঝিরিপথ। অন্য সব শব্দকে ছাড়িয়ে ঝিরি পথ ধরে পানির নেচে নেচে চলার শব্দই আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। শত ক্লান্তির মাঝেও মুপ্পোছড়া ঝর্না দেখার অদম্য ইচ্ছা আমাদের শক্তি যোগাচ্ছে।
আরেকটু পরেই দেখতে পাবো সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ঝর্না। জল পতনের শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলছে। হ্যাঁ, ঐ তো দেখা যাচ্ছে। সুবহানাল্লাহ। কী সুন্দর! কী সুন্দর! এ সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সে ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি। অনেক উঁচু খাড়া পাহাড় থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। তিন দিকে পাহাড়ে ঘেরা এ ঝর্নার রূপ সত্যি অতুলনীয়। মোবাইলে ছবি তোলা বা ভিডিও করা বন্ধ করে নেমে গেলাম ঝর্নায় গোসল করার জন্য। ঠান্ডা পানিতে তনু-মন একবারে ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনের সবটুকু তৃপ্তি নিয়ে গোসল করলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, আমাকে তাঁর এতো সুন্দর সৃষ্টি দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
এবার আমাদের ফিরে চলার পালা। ফিরে চলা মানে যে রাস্তায় এসেছি সে রাস্তা ধরে আরেকটু নিচুতে এসে নকাটা ঝর্নার রূপে ডুবে দেয়া। পাহাড়ে উঠার চাইতে নামা কষ্ট। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ। আমরা চলে এসেছি নকাটা ঝর্নায়। পাহাড়ের উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে সেসময় এ ঝর্নাটি আমরা সামনে থেকে দেখিনি। এর চূড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। সামনে থেকে এর সৌন্দর্য অসামান্য। পাথরে পা রেখে ঝর্নার কিছুটা উপরে উঠে গেলাম। পানির ধারা মাথার উপর আছড়ে পড়ছে। আহা কী আনন্দ! আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! বয়সের হিসাব ভুলে বসে বসে আনন্দে নৃত্য করতে লাগলাম। আহা কী আনন্দ! আহা কী আনন্দ!
কিছুতেই পানি থেকে উঠতে মন চাইছে না। অনেক অনেক সময় ধরে এর রূপের সবটুকু সুধা পান করে, মনের সাধ মিটিয়ে গোসল করে ফিরে চললাম। বারবার পিছন ফিরে চেয়ে দেখছি, আবার কী আসা হবে, আবার কী হাঁটা হবে এ পথ ধরে?
ভাতঘর হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমাদের চোখ বুজে এলো। বিকালে আমাদের গন্তব্য নীলাদ্রি রিসোর্ট। কিন্তু সময় মতো ঘুম থেকে উঠতে পারবো তো?
(চলবে)
আবদুল্লাহ আল মামুন
রচনাকাল - ০২ নভেম্বর ২০২০ ( ভ্রমণকাল ২৯-৩১ অক্টোবর ২০২০)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:০১