অল্প অল্প গল্প: “ফুলির আকাশ”
ঝনঝন করে শব্দ হল। শব্দটা প্রথমে জোরে, তারপর একটু আস্তে, তারপর আরেকটু আস্তে, তারপর আরো একটু আস্তে ... এভাবে মিলেয়ে যেতে পারতো কিন্তু তার আগেই ঝনাত করে শব্দটা শেষ হয়ে গেল। কেউ একজন স্টিলের বাটিটা চাপা দিয়ে ধরেছে।
টেবিল থেকে বাটিটা কিভাবে পড়লো কে জানে? তবে ঝনাত করে শব্দটা থেমে যাওয়ায় এখন ঝড়ের পূর্বাবাস পাওয়া যাচ্ছে।
- এই ফুলি, ফুলি।
গৃহকর্ত্রীর চিকন ধারালো গলা শোনা যাচ্ছে। এই গলার ধার ধারালো ছুরির চাইতে কোন অংশে কম না। ফুলি এই ধারালো গলাকে খুব ভয় পায়। এর ধারে তার চৌদ্দ পুরুষ প্রতিনিয়ত কুচিকুচি হচ্ছে। চড়-থাপ্পর কিংবা গরম খুন্তির বাড়ির ব্যথা সে ভুলতে পারে কিন্তু যখন তার বাপ-মা তুলে গালাগাল দেয় তখন আর সে সইতে পারে না। মেম সাহেবের মুখের উপর কিছু কইতে পারে না, শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলে।
ফুলির বয়স বেশি না। কৈশোরের শেষ সীমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। বাপ-মা থাকে গাঁয়ে। ছয় ভাই-বোনের সংসারে দুবেলা ঠিকমত খাবার জুটতো না। গেল বছর চোখের পানি নাকের পানি এক করে সেই বাপ-মাকে ছেড়ে তাকে এখানে আসতে হয়েছে। গাঁয়ে থাকতে বাপ-মার প্রতি রাজ্যর অভিযোগ অনুযোগ থাকলেও এখন তাদের জন্যই তার মন পোড়ে। তাদের নামে কেউ কিছু কইলে সে সইতে পারে না, চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে।
- জি মেমসাব।
দুপুরের খাবার শেষে সব কিছু গুছিয়ে বারান্দার মেঝেতে একটু গা এলিয়ে দিয়েছিল, ফুলি। সারাদিনে ঐ অতটুকুই তার অবসর। এর মাঝে আবার কোন উপদ্রোব এসে হাজির হল কে জানে।
- বলি তোর কি জ্ঞান বুদ্ধি কোন দিনই হবে না? তোর বাপ-মা তোরে ...... .... । বটিটা কেউ এ ভাবে রাখে?
এই বলে ফুলির গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে মেমসাব হন হন করে চলে গেলেন। হয়তো বাটিটা তার হাতে লেগেই পড়েছে।
ফুলি বটি গুছিয়ে রেখে আবার বারান্দায় চলে এলো। তার কেবলই বাপ-মায়ের কথা মনে হতে থাকে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে অন্য বাড়িগুলোর ছাদ পেরিরে একটুকরো আকাশ দেখা যায়। গাঁয়ে কত বড় আকাশ দেখা যেতো!
ফুলি সেথায় সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতো। যে কটা পান্তা ভাত থাকতো তা মা সবাইকে ভাগ করে দিতো। সাথে লবন মরিচ আর কপাল ভালো থাকলে পিয়াজ। কি যে অমৃত ছিল সেই খাবার! মনে হতো সব খেয়ে ফেলি। কিন্তু তা তো হবার নয়, অন্য ভাই বোন আছে না? তারপর কোথায় কোথায় যে ও চলে যেতো তার হিসেব থাকতো না। কখনো ওপাড়ার সালমার সাথে কুতকুত খেলা, কখনো রাস্তার ধারের বরই গাছতে বরই পেড়ে খাওয়া, আবার কখনো পুকুরে ঐ পাড়ে বেত ঝাড় থেকে কাঁটার আঁচড় খেয়েও বেতুইন পাড়া, অথবা পুকুরে ডুব সাঁতারের খেলা। এত কিছু করার পর রাজ্যের ক্ষিদা লাগতো। বাড়িতে আসলে মা বাকার সাথে সাথে কি যে মাইর দিতো! মনে হতো মার বুঝি কোন মায়া দয়া নাই। তবু রাতে মার ঘামে ভেজা গায়ের সাথে লেপটে ঘুমাতে কি যে ভালো লাগতো। আজ কত দিন মার গায়ের গন্ধ পায় না ফুলি। কত দিন বাবার মুখটা দেখে না! ভাই-বোনগুলো কেমন আছে কে জানে?
এই শহরে এসে তার আকাশটা কতই না ছোট হয়ে গেছে। ছাদ পেরিয়ে ঐ এক টুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুলির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। টপ টপ করে বৃষ্টির ফোটা পড়ে। ছাদ পেরুনো ঐ আকাশ থেকে নয়। ফুলির চোখের ভেতরে যে ছোট্ট আকাশ আছে, সেখানে কখন যে মেঘ করেছে তা ফুলি বুঝতেই পারে না। এই নোনা জলের বৃষ্টি বুঝি কেউ কখনো দেখবে না।
ওদিকে আবার মেম সাহেবের গলা শুনা যাচ্ছে।
- এই ফুলি, ফুলি।
#আবদুল্লাহ আল মামুন ..০৪-১০-২০১৮।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৯