গোধূলি বেলায় তাকে আমার ঠিক সূর্য বলে মনে হয় না।
সে তখন লাল শাড়ি পরিহিতা কোন এক গ্রাম্য কিশোরী। সোনা রঙের নূপুর পায়ে দীঘির নীল জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা এই মেয়েকে দেখে আমি অবাক হই! এইতো কিছুক্ষন আগে ভরদুপুরে সমস্ত আকাশটাকে সে একাই শাসন করেছে তেজস্বিনী নারীরূপে। অথচ এখন তার মুখ জুড়ে মায়াবতীর ছায়া।
গোধূলি আর আমি সেদিন একই রঙে সেজেছিলাম লাল শাড়িতে। মায়ের দেয়া লাল জামদানী, সাথে চোখ ভর্তি কাজল। আমার সাজ বলতে ওইটুকুই, খুব সখ হলে না হয় একটা ছোট্ট টিপ! এতো তাড়াহুড়ো ছিল আমার যে চুলগুলোকে মানানসই ভাজে খোঁপা করা হয়নি, বরং এলেবেলে হয়ে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল বটের ঝুড়ির মত। এসবে তোয়াক্কা না করে আমার তখন ছাদে যাবার তাড়া, এ শহরের আকাশে মায়াবতীর দ্যাখা মেলে খুব অল্প সময়ের জন্য কিনা!
শহরের আর অনেক দালানকোঠা ছাড়িয়ে মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এই আমি তখন রেলিঙে চিবুক ঠেকিয়ে নীড়ে ফেরা পাখিদের দেখি, গোধূলি মেয়েটাকে দেখি। আর টের পাই নির্লজ্জ হিমেল হাওয়া আমার শাড়ির আঁচল, খোলা চুলে লুকিয়েচুড়িয়ে হাত বুলিয়ে যায়।
সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে একশ একটা ধূসর পাখি দলবেঁধে উড়ে গেলো আমার কাছ ঘেঁষে। ওরা ভালবেসে এতো কাছে এসেছিল যে চাইলেই আমি তাদের ডানা স্পর্শ করতে পারতাম। সেই কবে প্রিয়তমেষুর বাড়িয়ে দেয়া হাত আমায় যতটা মুগ্ধ করেছিল, আজ সে একই রকম মুগ্ধতায় বুঁদ হই। তারপর না হয় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমেষুর মতই তাদের দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া দেখি ঝাপসা চোখে।
শহরে তখন রুটিন মাফিক বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। আশেপাশের দালানগুলোর জানালা গলে বেড়িয়ে আসছে হলুদ আলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমি গোধূলি মেয়েটাকে খুঁজি, অথচ সেখানে তখন রাতের কালো আকাশ। সত্যই কি রাতের আকাশ ? নাকি সে দুরন্ত মেয়েটা দীঘির জলে নাইতে নেমে গ্যাছে? মেয়ের লম্বা কালো মুঠি মুঠি চুলগুলো দীঘির জলে ছড়িয়ে আছে বলেই বোধহয় আকাশটাকে কালো ভেবে ভুল করছি!
জানি, মেয়ে সারারাত ধরে সাঁতার কেটে বেড়াবে নীলদীঘির এপাড়-ওপাড় জুড়ে। থাকুক না নিজের মত, ভেবে তাকে একা রেখে সিঁড়ি ধরে নেমে আসি আমি, লোকালয়ের কাছাকাছি।