হলদে রঙের ভারী গেটটা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই চোখে পড়ত তা্দের। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মধুমঞ্জরীলতা গাছটা, আর তার সই বাগানবিলাস। ফুল গাছেদের অতো লম্বা হতে নেই জেনেও বেহায়ার মত বেড়ে উঠেছিলো অনেক উঁচুতে! দ্বাররক্ষী এ দুজনকে হাতের ডানে রেখে দশ কদম এগিয়ে গেলেই সিঁড়ী্র দ্যাখা মিলতো। এরপর এক ধাপ দুই ধাপ করে ঠিক তিনতলা।
অতঃপর একটা সদর দরজার ওপাশে ছোট-বড় ঘরগুলো ছাড়িয়ে করিডোরের ঠিক শেষ মাথায় সেই ছাদহীন খোলা জায়গা। মাটি থেকে অতখানি উপরে হলেও তাকে চট্ করে উঠোন বলে ফেলা যায়। রেলিঙে ঘেরা এ জায়গাটুকুই আমার শৈশব।
খেলার মাঠ বলে কিছু ছিলো না আমার। সাদা বাড়ীটার ওই তিনতলাতে বন্দিনী রাজকন্যা হয়ে কেটে গেছে আস্ত একটা শিশুকাল। ছুটোছুটি হুটোপুটি করে বেড়ে ওঠা কাকে বলে আমি জানি না। কেবল ওইটুকুন খোলা জায়গা আর এক চিলতে আকাশ ছিল আমার সম্বল।
ভর সন্ধ্যায় রেলিঙের ধারে চেয়ার টেনে দিতেন আমার মা। ছোট্ট আমি তাতে পা ঝুলিয়ে বসেছি লক্ষী মেয়েটি হয়ে। মা তখন আঙুল তুলে দূর আকাশে পাখিদের উড়াউড়ি দেখাতেন,’ দ্যাখো নিন্ ওই দ্যাখো একটা পাখি উড়ে যায়! ওই যে, ওই যে আরেকটা! কই যায় বলতে পারো ?’
আমি কি করে জানবো? ওরা কি আমায় বলে যায় নাকি! মায়ের বোকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে ডানে বাঁয়ে মাথা দুলাতাম আলতো করে। মা আমায় বুকের কাছে টেনে নিতেন। ঝুঁটি বাঁধা ছোট্ট মাথায় হাত বুলিয়ে পাখিদের গল্প শোনাতেন। সেই কালো পাখিদের গপ্পো..... ভর সন্ধ্যায় ওদের বাড়ি ফেরার গপ্পো......। মা বলতেন ওদের গুণে রাখতে হয়, তা না হলে জানা হবে কি করে আজ কয়টা পাখি বাড়ি ফিরলো?
আমায় পাখি গোনার গুরুদায়িত্ব সঁপে দিয়ে মা ঘরে চলে যেতেন ধূপ জ্বালাতে। আর রেলিঙে চিবুক ঠেকিয়ে গম্ভীর মুখে আমি একেকটা উড়ে যাওয়া পাখিদের গুনে রাখতাম......এক……দুই……তিন……
সেসব দিন ফুঁড়িয়েছে বহু বছর আগেই। বেহায়া মধুমঞ্জরীলতা গাছটার মত না বলেকয়ে মেয়েটা্ও কিনা বড় হয়ে গেছে আজ অনেক দিন হয়! তবু বোকা শহরটার কোন এক খোলা ব্যলকনীতে দাঁড়িয়ে আজও সে কেউ উড়ে যাওয়া পাখিদের হিসেব রাখে, এ খবর জানার কথা নয় কারো, জানে না কেউ………