সে আমার কে হয় জানি না। তবু বুকের বাঁ পাশটায় চিনচিনে ব্যথা হলেই আমি উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে যাই তার কাছে। হাওয়াই গাড়ির মত উড়তে উড়তে রিকশা এসে দাঁড়ায় জব্বার মামার টঙের দোকানে। আমি জানি, হয়তো দেখবো ডান দিকের কোনার বেঞ্চিটায় বসে সে ভুসভুস করে ছাঁড়ছে নিকোটিনের ধোঁয়া ।
মানুষটা জানে বোধহয় আমার অস্থিরতার মৃত্যু কোথায়। জানি আসবেই ধরনের মুচকি হাসি দিয়ে সে এগিয়ে আসে আমার কাছে। আলতো হাত ছুঁয়ে আমায় নিয়ে ফিরতি হাঁটা দেয় সেই কোনের বেঞ্চিটার দিকে, ভাবখানা এমন যেন রানী অরুন্ধতী আরোহণ করছেন সিংহাসনে, পাশে তার সর্বশক্তি দিয়ে আগলে রাখা সেনাপতি।
‘ছোট্ট পাখিটার মত পেলে-পুষে যত্নে রাখবো দেখিস।‘ আড়চোখে তাকিয়ে বলে দিলো সেদিন। আমি জানি কথাটি মিথ্যে নয়। তবু পালটা উত্তর খুঁজে পাইনা বলে চুমুক দেয়া চায়ের কাপ পাশে নামিয়ে রেখে মনযোগ দেই কড়মড় করে বিস্কুট খেতে থাকা দোকানীর শিশু ছেলেটার দিকে। এদিকে খুব সন্তর্পণে সে তার চায়ের কাপ বদলে আমার কাপ খানা তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। কাজটা সে প্রায়শই করে থাকে। তারপর মুচকি মুচকি হাসি দিয়ে পরমানন্দে ঠোঁট রাখে কাপের গায়ে। আমি কখনই তার এই দুষ্টুমি টের পাই না কিংবা প্রতিবার টের না পাবার ভান করি বরং অধীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আজ কবিতা শোনাবে না?’
কবিতা। এমন কখনো হয়েছে কি, আমি এসেছি অথচ সে আমায় কবিতা শোনায়নি? না বোধহয়। সেদিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। টঙের দোকান ছেড়ে আমরা চলে আসি তুরাগ নদীর পার ঘেঁষে চলে যাওয়া হাইওয়েতে। এরপর হেঁটে গেছি অনেকটা দূর। তার শক্ত মুঠোয় তখন আগলে রাখা আমার মেহেদি পড়া রঙ্গিন হাত, তার কন্ঠে তখন জয় গোস্বামীর সেই প্রেমকবিতার টুকরো টুকরো শব্দগুলো...............
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন.............
হারিয়ে যাবার জন্য বুঝি এর চেয়ে ভাল সময় আর হয় না, আমিও হারিয়েছিলাম। এতোটাই ডুবেছিলাম সেদিন, পায়ের নিচের ধুলোবালির স্তরগুলোকে সৈকতের নীলজল ঢেউ বলে মনে হয়েছিল। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলা গাড়িগুলো পাশ ঘেঁষে যাবার সময় আমার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দেবার মত দারুণ অপরাধ আমি মুহূর্তেই ক্ষমা করে দিয়েছিলাম সেদিন।
একসময় রাস্তা শেষ হয়, তার কবিতা পাঠ শেষ হয়। এবার নাহয় বাড়ি ফেরার পালা। কেউ জানে না কি দারুণ অস্থিরতা নিয়ে এসেছিলাম, আর ফিরে যাচ্ছি রাজ্যের মন খারাপ অনুভুতি নিয়ে। অতঃপর সেই হাওয়াই গাড়ির মত উড়তে উড়তে রিকশাটা ফিরে যায় আমায় নিয়ে। আর পেছনে থেকে যায় মানুষটা্, যে আমার কে হয় জানি না........