যেদিন স্রষ্টার সাথে আমা্র দেখা হবে, তাঁকে খুব করে বলবো দুটো ডানা দেবে আমায় ? ভীষণ উড়তে ইচ্ছে করে, পাখিদের মত, চিলেদের মত। তিনি আমায় ভয়ানক ভালবাসেন, অনেক-অনেকবার তার প্রমান পেয়েছি। তাই হলফ করে বলতে পারি, আমার আজগুবী ইচ্ছেটাকে তিনি হয়তো মেনে নেবেন। পায়রার পালকের মত শুভ্র সাদা দুটো ডানা আমার হাতে তুলে দিয়ে মহাবিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলবেন, এমন সব আবদার কেন যে করিস!
শহরের ক্লান্ত মানুষগুলো যখন খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে, উঁচু-নিচু দালানগুলোর জানালা গলে বেড়িয়ে আসা হলদে আলো যখন এক এক করে নিভে যেতে থাকে, আমি তখন ডানাদুটো বুকে জড়িয়ে বসে থাকি মাঝরাতের অপেক্ষায়। একসময় দূরের গীর্জায় বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি, আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। খুব লুকিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসি। গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াই আমার সেই খোলা ব্যালকনীতে।
আকাশে তখন আস্ত একটা চাঁদ, এমন ঝলমলে রুপালী আলো দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় আজ স্বর্গদ্বার খুলে রেখেছে কেউ। সে আলো মেঘ ডিঙ্গিয়ে আমার ব্যালকনীতে নেমে এসেছে স্বর্গের সিঁড়ি হয়ে। এ আলোর সিঁড়ি বেয়ে আজ আমি স্বর্গে যেতে পারি, কিন্তু উড়ে যাবার ইচ্ছেটা যে তার চেয়েও প্রবল!
নিজেকে টেনে তুলে রেলিঙের উপর দাঁড়াই। পিঠে আমার শুভ্র সাদা ডানাদুটো ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, ছড়িয়ে পরে উত্তাল সমুদ্র স্রোতের মত। আমি দুপাশে মেলে ধরি তাদের, এরপর কেবল শরীরটাকে ভাসিয়ে দেবার পালা। বাতাসে আঁচড় কেটে এই আমি সত্যি সত্যি উড়তে থাকি, ভাসতে থাকি। ঘুমন্ত শহরটাকে অনেক নিচে রেখে আমি পাড়ি জমাই মেঘেদের দেশে। হয়তো উড়তে উড়তে ক্লান্ত আমি মেঘের উপর পা দুলিয়ে বসবো। ভেসে চলা মেঘ আমায় নিয়ে পেড়িয়ে যাবে শহর-বন্দর, লোকালয়, জঙ্গল, নদী, দীঘি, পাহাড়............
একটা উড়ে যাওয়া লক্ষ্মীপেঁচা আমার কল্পনার বারটা বাজিয়ে হারিয়ে যায় দূরে, অন্ধকারে। নিজেকে তখন আবিষ্কার করি আমার সেই ব্যালকনীর এক কোনায়। একটা মন খারাপ করা ভাব ভর করে মনে। সেই যে শৈশবের ভর দুপুরে জানলার ধারে উড়তে থাকা প্রজাপতিদের দেখে মা আমায় ঘুম পাড়াতেন, সেই যে রেলিঙে চিবুক ঠেকিয়ে কালো পাখিদের বাড়ি ফেরার হিসেব রাখতাম, ওড়াউড়ির ইচ্ছেটাকে বুকের ভেতর পুষে রেখেছি ঠিক সেদিন থেকেই।
এই ডানাহীন আমি তখন আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকাই। বাড়ির নিচের রাস্তাটাকে তখন কালো অন্ধকার ঢেকে রেখেছে যত্ন করে। ঠিক তখনই ইচ্ছে পূরণের বুদ্ধিখানা ধপ্ করে চলে এলো মাথায়! হ্যাঁ, আমি চাইলেই উড়তে পারি, হয়তো কয়েক মুহূর্ত মাত্র, কিন্তু পারি।
ঠিক কল্পনার মত নিজেকে টেনে তুলে রেলিঙের উপর দাঁড়ানো, এরপর কেবল শরীরটাকে ভাসিয়ে দেবার পালা। আমি জানি, ভেসে থাকার পরিবর্তে আমি আছড়ে পড়বো মাটিতে। আমি জানি, এ শরীরটা থেতলে পড়ে থাকবে সেই অন্ধকার গলিতে। হয়তো মাথার খুলি ফেটে আতাফলের মত টুসটুসে সাদা মগজটা ছড়িয়ে পরবে এদিকওদিক, লালরঙ রক্তধারা বেয়ে যাবে ঢালু পথে। কিন্তু আছড়ে পরার কয়েক মুহূর্ত আগে আমি বাতাসে ভেসে ছিলাম, খুব খুব খুব অল্প সময় হলেও আমি ঠিকই উড়েছিলাম, এ কথা কেউ জানবে না।
আচ্ছা ! আমার তো কেউ নেই, তবে কাকে বলে যাবো এ ইচ্ছেমৃত্যু ছিলো না, কেবল ইচ্ছেপূরণ ছিল.......কাকে বলে যাব !!