আমি গালে হাত দিয়ে শুনতে থাকি । চোখেমুখে আমার মনোযোগ স্পষ্ট। মা গল্পচ্ছলে বলে যান,
আমার মায়ের ধারনা তিনি মারা যাবেন কোনো এক অঝোরধারা বৃষ্টিদিনে। এলোপাথারী বৃষ্টিতে চারপাশ যখন সয়লাব, ঠিক তখন মা চলে যাবেন তাঁর শরীর খানা আমাদের কাছে রেখে। আত্মীয়স্বজনেরা আধভেজা হয়ে আসবেন একের পর এক আমার মাকে শেষ বারের মত দেখতে। ঘর ভর্তি মানুষ, পাকা মেঝে কাদায় মাখামাখি, সে এক হুলুস্থুল অবস্থা ! ওইদিকে গোঁড়খোদকের সে আরেক ঝামেলা, কোদাল এর আঁচরে মাটি যতই গভীর হয়, পাল্লা দিয়ে সেই গর্তে বাড়তে থাকে পানির উচ্চতা। এভাবে কি কবর খোদাই হয় ? তাও চলতে থাকবে শেষকৃত্তের কাজ।
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি , মৃত্যুর মতো একটা বিষয় নিয়ে মা কেমন সাবলীল ভাবে কথা বলে যাচ্ছেন ! ‘বুঝলা নিন, তারপরে কি হইব জানো ?’, মা একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছেন, গুরিগুরি বৃষ্টি মাথায় হবে শবযাত্রা । মজার ব্যাপার, দাফন করতে গিয়ে দেখা যাবে কবরখানা পানিতে টইটুম্বুর। ‘মা, কি শুরু করলা, please থামো!’, এমন কোনো কথাই আমি মাকে বললাম না, বরং চোখেমুখে বিশাল আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম,’ আচ্ছা মা, মৃত্যুর সাথে বৃষ্টির যোগসূত্রটা কই ?বুঝায় বলতো, মনে হইতাসে ব্যাপার টা Interesting!’ চশমার ফাঁক দিয়ে মা তাকান আমার দিকে,মেয়েটা রসিকতা করছে কিনা যাচাই করার চেষ্টা । আমি ঠায় বসে থাকি মুখে আগ্রহের ভাব ধরে । যেন পরের টুকু শোনার জন্য উদগ্রীব। এ কাজটা আমি বেশ ভাল পারি, সুতরাং মা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার শুরু করেন একদম শুরু থেকে।
সে বছর বেশ বন্যা হলো । উঠোন ডিঙ্গালো, চৌকাঠ পেরুলো। পানির উচ্চতা তাও বেড়েই চলেছে। ঘরের চৌকিটাও তার ছয় পা নিয়ে পানির উপর দাঁড়িয়ে । এমনই জলভরা দিনে এক কিশোরী তার প্রসব ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে । কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া মেয়েটির কান্না জানান দেয়, হ্যাঁ... সময় এসে গেছে। এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই । তবে কি পানি আরও বাড়বে ? এখন উপায় ? শেষে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় ছৈওয়ালা নৌকা । গর্ভধারিণীকে নিয়ে ধাই ওঠে যান নৌকায় আর জলে ভাসতে ভাসতে কিশোরী মেয়েটি জন্ম দেন আমার মা কে ।
মা তার জন্মমুহূর্তের কাহিনী শুনেছে তার বু’র কাছ থেকে। (মা তাঁর দাদীকে বু বলে ডাকতেন)আমার নানীও নাকি এ গল্প শুনিয়েছেন অনেকবার । কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি অন্য কথা ভেবে । পুরো কাহিনী থেকে বেছে বেছে বৃষ্টি শব্দটাকেই কিভাবে যেন আলাদা করে ফেলেছেন আমার মা । তার বদ্ধমূল ধারনা , জন্ম থেকেই বৃষ্টির সাথে কোথাও একটা যোগসূত্র আছে তাঁর ।
এই মুহূর্তে আমি আমার মাকে দেখছি । মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট মেয়েটার মত কথা বলে যাচ্ছেন । মা তাঁর বিয়ের গল্প বলতে শুরু করেছেন । আমি এ ঘটনা আগেও অনেকবার শুনেছি । কিন্তু প্রতিবারের মত এবারো এত আগ্রহ ভাব মুখে ধরে রাখলাম যেন এই প্রথম শুনছি।
হ্যাঁ , বিয়ের দিনও বৃষ্টি ছিলো , সেকি উথালপাথাল বৃষ্টি! একসময় বৃষ্টি থামল কিন্তু সারা উঠোন যে কাদায় মাখামাখি । বরযাত্রী এসেছে, গ্রামসুদ্ধ মানুষ এসেছে। এরা বসবে কোথায়, খাবে কোথায় ? তখন ছিল সদ্য আঁশ ছাড়ানো সাদা পাটশোলার দিন ।সবাই মিলে পাটশোলা বিছিয়ে সারা উঠোন ঢেকে দিলো । কাদায় মাখা কালোমাটির উঠোন ঢাকা পরলো সাদা পাটশোলায় । আরে, সেকালে তো আর ডেকোরেটর ছিল না যে সাহেবী ধাঁচে চেয়ারটেবিলে বসে খাইদাই হবে । কলাপাতা সামনে রেখে সকলে লাইন ধরে বসে পরলো উঠোনে । বিয়ে হল ধূমধাম ।বৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিক ঠিক মা চলে এলেন অচেনা মানুষের শহরে ।
কথা বলতে বলতে মা উদাস হন, আমি আড়চোখে তাকে তাকিয়ে দেখি । মেয়েটা বুড়িয়ে গেছে অনেক । চুলে পাক ধরেছে সেই কবে ।তবু মাকে আমার পুরনো মনে হয় না । মা যানে না , গোসল করার পর পর মাকে কি অপরুপ দেখতে লাগে । মায়ের মাথার লম্বা চুলগুলো তখন আর খোপার ভেতর হাঁসফাঁশ করে না , বটের ঝুড়ির মত নিচে নেমে আসে, বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে , এই মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসি ।
একসময় মা-মেয়ের গল্প শেষ হয় । রুটিন মাফিক মা ঢোকেন রান্নাঘরে , হয়তো আমি ব্যস্ত হই ব্যাগ গোছাতে। লম্বা সময়ের জন্য বিদায় নিয়ে আবার ফিরে আসি ইটকাঠের প্রানহীন শহরে , স্বার্থপরের মত ব্যস্ত হয়ে পরি নিজেকে নিয়ে । আর মা আমার প্রতিক্ষায় থাকেন...কখনো আমার , কখনো বৃষ্টির...............