somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি সে হায়...

২৮ শে অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দীঘিটি ভীষণ স্মৃতির। ভয়ঙ্কর জলের পাড় ঘেসে স্কুলে যেতাম। কালুদের বাড়িটা দিঘির ধারে। পাশ পেরুলেই খোপ ভরা কবুতরের কিচমিচ আর মুরগি চিনাবতকের ঝাঁক।বিকেল হলে ফাহিমা আপার কাছে ছুটে যেতাম। পাতলা ছিপছিপে এই তরুণী তার সব ভালবাসা নিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিত। তারপর সরু সরু দু ডানা ধরে শূণ্যে তুলে ঘুরতেন। কিছুক্ষনের জন্য পাখি হওয়ার এ লোভ আমার বহুদিন ছিল। রোজ বিকেলে ছুটে যেতাম। ক'দিনপর পর আপা অসুখে পড়ত। একটা কাঠের খটখটে চকিতে শুয়ে থাকতো বারান্দায়। বিকেল গুলো মাটি হয়ে যেত আমার। আমি পাশে বসে থাকতাম দীর্ঘসময়। যতক্ষন না সন্ধ্যা আসে। আপার সৎমা গোয়াল থেকে গরু তুলতেন, মুরগী উঠাতেন খোয়াড়ে, কবুতরদের ঢোকাতেন মাটির ঝুলে থাকা হাঁড়িগুলোয় । আর শুয়ে থাকার অপরাধে ফাহিমা আপাকে বকতেন। চিকন জলের ধারায় তার মাথার তেল চিটচিটে বালিশটা ভিজে যেত। আমি এসব খুব অলক্ষ্যে দেখতাম। কি নিঃস্পৃহ ছিলাম আমি তখন। ফাহিমা আপা একদিন মরে গেল।

কদিনের মধ্যেই ভুলে গেলাম আপাকে। ততদিনে আমি উঠোন আলো করে বসে থাকা চায়না আপার প্রতি আসক্ত। বিকেল হলে আপা তার সুবিশাল চুল মেলে দিয়ে তেলের বাটি নিয়ে বসতেন। চপচপে তেল মাখিয়ে কালো চুলগুলোকে কষে বেনি বাঁধতেন লাল ফিতা দিয়ে।
এখন আমি পদ্মাবতীর কেশের বর্ণনা পড়ি আর দুচোখে ভেসে ওঠে পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চায়না আপার চুল।
সেবার খুব জ্বর হল আমার। সারাদিন শুয়ে থাকতে হত ঘরে। তারপর সারা শরীর ভরে গেল জলবসন্তে। আমি মশারীর তলে শুয়ে শুয়ে ছটফট করি। সাত রকমের মিষ্টি একটা থালায় রাখা থাকে মাথার কাছে। চিনির খাগড়াইএর একেকটা দানা মুখে তুলে দি অবহেলায়।
সেরে উঠে শুনলাম চায়না আপাকে নিয়ে গেছে এক রাজপুত্র।

গলির বাইরের বরই গাছে ঝেঁকে ফুল আসলো সেবার। সারা মেঝে ভরে থাকে দানা দানা ফুলে। দানা ফুল কুড়াতে চায়না আপাদের ওদিকটায় গিয়ে দেখলাম চায়না আপা ফিরে এসেছে। এখন লাল-নীল- হলুদ চাপা কামিজে বিকেল হলে চুল বাঁধতে বসেন না, একটা মোড়া পেতে উঠোন আলো করেই বসে থাকেন, তার পরনে সাদা থান। দৃষ্টি থাকে প্রশস্ত মাঠের দিকে ছড়ানো।
ওদিকে আমি আর যাইনি কখনো।

জোৎস্না আপা, জুলেখা আপা, সাবিনা আপা, শিউলী আপা সবার একে একে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শিউলী আপার বাবা মারা গেছেন অনেক ছোট বেলায়। মা মানুষ করেছেন তাকে শক্ত হাতে। দেখলেই বোঝা যায় সেই ছোট খাট মানুষটির ব্যক্তিত্ব কঠিন আলোর মত। সারা শরীর গয়নায় মুড়ে বরপক্ষ নিয়ে যাচ্ছে আপাকে। আমি রাজেন্দ্রাণী কখনো দেখিনি বলে আমার কোনো আফসোস নেই। নির্ঘাত কোনো রাজেন্দ্রাণী শিউলী আপার চেয়ে সুন্দর নয়। মাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না তিনি। সারামুখ কাজলে মাখামাখি। আমরা কাঁদছি। অবশেষে মাকে নিয়েই আপা শশুর বাড়ি গেল।

এদিকে আমার বয়সী সাথী তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। দীঘির পাড় ধরে স্কুলে যায়। ফিরে এসে মেতে উঠি বদ্দন খেলায়। কদিনপর পর খেলা বদল হয়। সাথীরা একই থাকে। ভালবাসা বুঝি গাঢ় ও হয়। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে গোপন অনেক কিছুর খবর জানা হয়ে যায় আমাদের। অভি, জলি, দিবা ,নাজু এরা আমাদের থেকে অনেক ছোট। তবু আমাদের খেলায় ওদের অংশগ্রহন অবধারিত। ওরা গল্প করে রাতের বেলার। গতরাতে বাবা খুব কষ্ট দিয়েছে মা কে। এসব নিয়ে কিছুদিন তুমুল গবেষনা চলে। আমরা খেলা পরিবর্তনের সাথে সাথে ভুলে যায় পুরোনো বিষয়।
কেউ বলেছিল আমরা প্রতিনিয়ত মরে যায়। শৈশব মরে যায়, কৈশর মরে যায়, যৌবন মরে যায়। শুধু নতুন জীবনের জন্য এসব মরে যাওয়াকে সাদরে গ্রহণ করি আমরা।

রবিবার হাটের দিন। কুইনের ছেলে পুতুলের সাথে আমার মেয়ে পুতুলের বিয়ে। ভয়ে ভয়ে আম্মুকে বললাম, কুইনরা ক'জন আমাদের বাড়ি আসবে বরযাত্রী হয়ে।
আব্বু শুনে বললেন তো আসবে! তা মেহমানদের কি খাওয়াবি? কেশর, পানি সিঙ্গারা, জিলিপি, চিনির গজা। আইটেম বাড়েনা। হাট থেকে বাবা ফিরতেই ব্যাগে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ছোটভাইয়া মনে করিয়ে দিলো নারকেলের নাড়ু আছেনা? আব্বু বললেন না না এটুকুতে হয়নাকি? মেয়ের বিয়ে বলে কথা। একটু বুঁদিয়া করে দিও গো, আর কয়টা পিঠা ভেজে দাও তেলে। আম্মু হেসে বললেন আচ্ছা।
এক জীবনে এমন আনন্দ বারবার আসেনা। না আসলেও হয়তো! আনন্দের রেশ থেকে যায় যে জীবনভর।

বড় ভাইয়া বহুদিন পর পর বাড়ি আসে। সাথে নিয়ে আসে আনন্দ আর উত্তেজনাময় ক'দিনের হাতছানী। ব্যস্ততার শেষ নেই। আসতেই ঘরকাটাকাটি শুরু। এখানে ব্যডমিন্টন খেলতে হবে।লুডুর বোর্ড ঝেড়ে মুছে প্রস্তুত। ক্যারামটা রোদে দেয়া। গুঠি গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। বোরিক টরিক লাগলে দ্রুত সব জোগাড় করে ফেলা। একদম সময় নেই। শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায় আনন্দের দিন। লুডুতে ভাইয়া পাক্কা গুঠি চোর। আমাদের পাহারাদার রাখতে হয় চুরি ধরতে। ভাইয়ার বাজী জিতলেই চকলেট।
আমরা হেরেই চকলেট খেতাম। ভাইয়া ইচ্ছে করে না হারলে কার সাধ্য আছে হারানোর!

আমার বড় আপু কম পাজি ছিল না। সারাদিন বকতো আমাকে। এই ঠিকমত পানি ঢালতে পারিস না? আবার নাকে হাত? ব্লেড কেন তোর হাতে? পেন্সিল কানে গুঁজেছিস কেন? রাত হলে মই বেয়ে আমরা ছাদে উঠে যেতাম হারিকেনটা জ্বালিয়ে। আপু দুলে দুলে পড়তে থাকতো আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত হলে তারা নেমে আসতো চোখের উপর। হয়ত অসংখ্য জোনাকী নিমের পাতার পাশে। আপু ঘুম থেকে তুলিয়ে নিয়ে আসতো। আমি হাত দিয়ে আকাশ আটকাতাম। আর আপু হেসে গড়িয়ে পড়ত। তারপর রাতে আমাকে একটা পাশবালিশ বানিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতো আপু।
ধারে শোবার লোভ আমার। আপু কিছুতেই দেয়ালের ধার ছাড়া ঘুমুতে দিতনা বলে সে কি দুঃখ আমার। ভাইয়া বাড়ি আসলে তাই আনন্দের শেষ নেই। ভাইয়া সেধে ধারে শুতে দিবে বলেছে। তারপর রাতভর কত রাজ্যের গল্প।

আঙ্গুল ধরার খেলায় , তর্জণী নাড়াতে নাড়াতে ধরতে গেলেই বুড়ো আঙ্গুল বের করতো, অমনি বুড়ো আঙ্গুল ধরলেই হেরে যাওয়া। যাদু দেখানোতে ভাইয়ার জুড়ি নেই। কতরকম জাদু যে দেখাতো আমাদের। এই পয়সা আছে হাতের তালুতে তো এই নেই। আরে আমার কানের মধ্যে থেকে ভাইয়া পয়সা বের করছে। কি লজ্জা। আরেক দিন আমার মুখের ভেতর থেকে। আমি নাকি আরেকটু হলেই গিলে ফেলতাম। তখন কি হত। হেনতেন হাবিঝাবি কত কি বলল, আমি যখন ঠিক কাঁদতে শুরু করব তখন বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে ধুর বোকা! ওটাতো জাদু। এবার পয়সা হাতের তালুতে। বল এবার কোথা থেকে বের করব!
গন্ধ শোঁকার যাদুটা আমি বলেছি। এক ঝলক আলোতে।

আপু গড়গড় করে পড়া মুখস্ত বলতো, সে পড়া আবার আমি আর আমার ছোট ভাই ধরছি। আমরা দুজনে দেখে কুল করতে পারছিনা। সে নিয়ে কি হাসাহাসি। আপুর পাশে বসলেই সারাক্ষন এই হাত চুলকে, পা চুলকে ,পিঠ চুলকে বিরক্ত করত। আমি রাগ হয়ে বলতাম দেখি, তোমাকে এমন করিতো তোমার কেমন লাগে। আপু বলত দে দে ,হু ঐখানে, আরে এখানে হুম, জোরে জোরে। রাগে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করত।
পড়তে বসলাম। আপু আমার ঘাড়ে পা তুলে দিয়ে বললো ঠিকমত পড়। পায়ের চাপে শুয়ে পড়েছি আমি আর সে নিয়ে হাসি। পরীক্ষায় রিভাইজ দিয়ে আসিনি বলে সেদিন ছিল আমার শাস্তির দিন।

পোষ্ট বড় হয়ে যাচ্ছে। কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল। লিখলাম। এসব সময়েরা মৃত। পৃথিবীর সব মৃতদের আমি এভাবেই দেখেছি। যেমনটা ঘাসের বনে পড়ে থাকে চাপা পড়া ফড়িং।
বিখ্যাত কবির মত আমিও বলতে পারি যেতে পারি,কিন্তু কেন যাব। অবশ্য আমার বলা হয়না। জল গড়ায়, ছায়ামরীচের জঙ্গলে রাত নামে। আমার বলা হয়না। যাবার ইচ্ছে করতে করতেই সময় চলে যায়। আর আমি আজন্ম এই ঝাউয়ের বনে আটকে থাকি।


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ২:৪৯
৬০টি মন্তব্য ৫৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×