লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশ দল ক্রিকেটের বাইরে। ক্রিকেটপাগল জাতি যেন ভুলেই গেছে, ক্রিকেট তাদের কতটুকু জুড়ে আছে। আমার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। তাই পুরোনো স্মৃতি শেয়ার করে সবাইকে একটু মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি। আগেই বলে নিই, লেখাটা পড়ে খুব ইমম্যাচুয়র বাচ্চার লেখা মনে হতে পারে। ক্রিকেট নিয়ে লিখতে গেলে কেন যেন বাচ্চামিটা ছাড়তেই পারি না।
১৭ই মার্চ, ২০০৭
সকাল থেকেই চৌদ্দ বছরের আমি খুব উত্তেজিত। কারণটা বিশ্বকাপ নয়, ওইদিন যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ- তা তো আমি জানিই না! তখন কি আর এমন ক্রিকেটখোর ছিলাম নাকি যে আগেরদিন রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে? ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করেছি বছরখানেক আগে। ক্রিকেটের আগামাথা তেমন কিছুই বুঝি না। খালি এটুকু জানতাম, একপক্ষ ব্যাটিং করে, অপরপক্ষ বোলিং। যারা বোলিং করে, তারা তেমন গুরুত্ববহন করে না!
কেবল ব্যাটিংটাই গুরুত্বপূর্ণ!
যাক গে, অইদিন যে কারণে অতি উৎসাহিত ছিলাম সেটা হলো, ছোট খালামনির বাড়িতে যাব- তাই। খালামনি আবার আমাকে খুব বেশি আদর করতো। উৎসাহের পরিমাণটা সেজন্যই বেশি।
খুশিতে ডগমগ হয়ে সদ্য বানানো লাল জামাটা পরে টরে আমি তৈরি। আম্মু আমাকে দেখে চোখ লাল করে তাকালো। ধমক দিয়ে বলল, সাদা জামা পর! আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আম্মুর চোখ ফুলে আছে। অনেক কাঁদলে যেভাবে ফুলে, সেইভাবে।
যেতে যেতেও আম্মু কাঁদলো খুব। আম্মুকে আমি ছোট থেকেই খুব ভয় পাই। তাই আর তাকে ঘাটালাম না। কিন্তু বুঝতেও পারলাম না, ঘটনা কী ঘটছে। জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেলাম না।
খালামনির বাড়ি যাওয়ার আগে বুঝলামই না, খালামনি আর নেই। আগে আমার আবেগ টাবেগ তেমন ছিল না। তাই মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করলো না।
সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি শেষে বাসায় যখন ফিরছি, তখন সূর্য পশ্চিম প্রান্তে ডুবে গেছে। ফিরতে খুব কষ্ট হয়েছিল, কোন যানবাহন পাইনি- বহুদূর হেঁটে এগুতে হয়েছে। বাসা ছাড়ার সময় আমি আর আম্মু ছিলাম, কিন্তু ফিরার সময় সাথে অন্য এক খালামনি আর তার ছেলেও ছিল। এত কথা অবতারণা করার কারণ হলো এই ভাইয়া। ভাইয়াটা সে রাতে আমাদের বাসায় না থাকলে আমার দেখা প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ, সেই সাথে আমার জীবনের স্মরণীয় ম্যাচ ওটা নাও হতে পারতো।
ভাইয়া বাসায় এসেই টিভি ছেড়ে দিল। তখন আমাদের ডিশ ছিল না। একটাই বাংলা চ্যানেল ছিল, "বিটিভি"। টসে জিতে রাহুল দ্রাবিড় যখন ব্যাটিং নিলো, কমেন্টেটর বলে উঠলো,
' To lay the entire blame on Rahul Dravid, for choosing to bat first on a juicy pitch, will be foolhardy.'
ভাইয়াও দেখি মাথা নাড়িয়ে বলছে, 'দ্রাবিড় খুব ভুল একটা ডিসিশন নিছে! তবে এতে আমাদের জন্য ভালোই হবে! '
আমি ভাইয়ার সমর্থনে তার সাথে তাল মিলানোর চেষ্টা করছি একই ভাবে মাথা নাড়িয়ে। কিন্তু যেহেতু কিছুই বুঝিনাই, ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন ভাল হবে?'
ভাইয়া এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়লো। হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিল, এই মেয়ের যন্ত্রণায় আজ আর শান্তিমত খেলা দেখা যাবে না …
আমাকে এই ভাইয়াটা খুবই প্রশ্রয় দিত। সেজন্যই হয়ত বিরক্তি চেপে রেখে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে এটা বোলিং পিচ। কিন্তু আমি কি ছাই তখন আর ব্যাটিং পিচ, বোলিং পিচ, পেস সহায়ক পিচ, স্পিন সহায়ক পিচ, পুল, শট, কাট, ফাস্ট বোলার, পেসার, স্পিনার, স্ট্যাম্প, উইকেট (!) এইসব বুঝি? আমিতো ভাবতাম ক্রিকেট খেলায় উইকেট থাকে তিনটা!
ব্যাটসম্যানের পিছনে যে তিনটা স্ট্যাম্প থাকে, ওই তিনটা!
ভাইয়া আমাকে বোঝানোর জানপ্রান চেষ্টা করলো। আর আমিও জানপ্রান চেষ্টা করে এটুকুই বুঝলাম, ক্রিকেটে ৫০ ওভার খেলা হয় আর এক ওভারে ছয় বল থাকে। (আগে কয় ওভারে খেলা হয়-সেটাও জানতাম না। ক্রিকেট তো দেখতামই তানভী আপুর (কাজিন। সব কিছুতেই ওর সাথে আমার কম্পিটিশন ছিল) সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য।
শুধু বুঝতাম… … … থাক, সেসবে আর না যাই।)
প্রথম বল। মাশরাফি ছুটে এসে ১৩০ কিলোমিটার পার আওয়ার বেগে বল ছুঁড়ে দিয়ে খেলার শুভ সূচনা করলো। এবং প্রথম ওভারের বিশ্ববিখ্যাত বেয়াদবকে (সাকিব নয়! ) প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখিয়ে দিল আমাদের সবার প্রিয় ম্যাশ! আমার প্রথম ক্রাশ!
আম্মুর চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে সবচেয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আমিই। কারণ ওইদিনই ক্রিকেটের আসল মজাটা বুঝতে পারছিলাম।
ধোনীর গোল্ডেন ডাকে আমি প্রচন্ড উত্তেজিত। চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়ার সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম, আজ আমি ক্রিকেট দেখছি।
আমি খুব ঘুমকাতুরে মেয়ে। সারাদিন ছোটাছুটির পর সন্ধা পেরুবার আগেই আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। মাশরাফি-রফিক-আব্দুর রাজ্জাকের বোলিং তান্ডব আমার ঘুম দমিয়ে রেখেছিল। তার সাথে গ্রামীণ ফোনের "চলো বাংলাদেশ, বিভেদ ভেঙে, সকল আঁধার, বাঁধা ডিঙে, নতুন ঠিকানায় … … …" প্রভাবক হিসেবে গানটা খুব কাজ করছিলো।
কিন্তু সৌরভ গাংগুলী ১২৯ বলের যে ইনিংস শুরু করছে, সেটা দেখতে গিয়ে আমার ঘুম এসেই যাচ্ছিল। মাঝের চারটা(!) চার দেখে ওদের হয়েই হাত তালি দিয়ে দিছিলাম। মনে হচ্ছিলো, এটা ওয়ানডে? নাকি টেস্ট?
যাইই হোক। বহুকষ্টে ঘুমকে দমিয়ে রেখে টিভির দিকে চেয়ে রইলাম। বাংলাদেশের ব্যাটিং তো দেখতেই হবে। সেটা কি কোনমতে মিস করা যায়?
খেলার বিরতিতে খেয়ে টেয়ে নিয়েছি। ততোক্ষণে আম্মু ,খালামনি আর আরমান ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছি আমি , আব্বু , ভাইয়া। বিরতিতে ভাইয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে যত শুনছি, আর আকাশ থেকে পড়ছি! এই ম্যাচ নাকি মুশি, তামিম, সাকিব, রাজ্জাক, শাহরিয়ার নাফিস... আফতাব, সৈয়দ রাসেলেরও প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ ছিল। একগাদা নবীন খেলোয়াড় নিয়ে বিশ্বকাপ! ভাবা যায়?
অবাক হয়ে তামিমের ব্যাটিং তান্ডব দেখতে দেখতে জানতে পারলাম, সে নাকি দলের সবচেয়ে ছোট খেলোয়ার! আমার চেয়ে মাত্র চার বছরের বড়। জন্মদিনটাও একই দিনে! তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশার মত ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ভাবলাম, এত মিল যেহেতু-তামিমের প্রেমেই পড়ি?
ম্যাশ তো বিয়ে করে ফেলেছে। কারোর সাজানো সংসারে আগুন দেওয়া আমার ধাতে নেই।
হাফ সেঞ্চুরি করেই তামিম আউট হয়ে গেল। সেই সাথে আউট হলো আফতাবও। তামিমকে ওয়েটিং এ রাখলাম। দেখি সামনে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
গুলুগুলু পিচ্চি পিচ্চি চেহারার মুশফিকুর নামটা ডাকতে কষ্টই হচ্ছিল। তাই শর্টকাট নাম, রহিমই ডাকছিলাম। আর বসে বসে কত উপদেশ যে দিচ্ছিলাম তাদের! বার বার একটা কথাই বলছিলাম, আর যাইই করুক- আউট যেন না হয়।
এইসব কথাবার্তা একা একাই বলছিলাম। কারণ ততোক্ষণে বাকিরাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি কিছুতেই ঘুমাইনি। একে তো পণ করেছি বাংলাদেশের জয় দেখেই ঘুমাব, তার উপরে পরদিন সকালে তানভী আপুর কাছে ভাব নিতে হবে না যে আমি সারারাত জেগে খেলা দেখেছি? এটা কি যেন তেন অর্জন?
তখনো কি আর জানতাম, যেই ম্যাচ দেখার জন্য আমি এত কষ্ট করে জেগে ছিলাম, এখন গুগলে "বিশ্বকাপের দশটি দুর্ঘটনা" লিখে সার্চ দিলে সেই ম্যাচের নাম উঠে আসে?
সাকিব আর মুশির জুটিটা জমে গিয়েছিল বেশ। সাকিব মুশির পরে নামলেও মুশির আগেই হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছিল। আর আমি দুহাত তুলি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলাম, "আল্লাহ! রহিমও যেন ফিফটি করার আগে আঊট না হয়!"
আল্লাহ আমার কথা শুনেছিলেন। মুশি শেষ পর্যন্ত আউট হয়নি। ৯ বল বাকী থাকতে মুনাফের বলে কভারে শট দিয়ে মুশফিক যখন বিজয় নিশ্চিত করে, আমার তখন ইচ্ছে করছিল আশেপাশের ঘুমন্ত সবাইকে চিৎকার করে ডেকে তুলি! আর চিতকার করে জানাই,
"তোমরা সবআআই দেখো!
আমরা বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জিতেছি!
আমার প্রথম দেখা বিশ্বকাপে আমরা জয় পেয়েছি!
ভারতকে হারিয়ে দিয়েছি আমরা!
একদল নবীন খেলোয়ার নিয়ে আমরা সফলভাবে বিশ্বকাপ শুরু করেছি! "
কিন্তু বলিনি। তখনো পাগল হয়ে যাইনি তো! এখন হলে এই উত্তেজনাকর মূহুর্ত আমি কখনোই একা একা উপভোগ করতে পারতাম না।
খেলাটা শেষ হবার পরও টিভি বন্ধ করে ঘুমাতে যাইনি। মনে হচ্ছিল, এত জলদি শেষ হয়ে গেল কেন খেলাটা? আরো কিছুক্ষণ কেন থাকলো না?
তখনই আসিফ আকবরের
"বেশ! বেশ!! বেশ!!!
সাবাস বাংলাদেশ!
যাও এগিয়ে!
আমার বাংলাদেশ!"
গানটা প্রচার করা হলো। সেই সাথে মাত্র শেষ হওয়া ম্যাচের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তের ছবি দেখানো হলো গানের সাথে।
ওইসব মূহুর্ত গুলির জন্য নাকি গানের সুরের জন্য জানিনা, আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করলো। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কেন কাঁদছি আমি!
সেই শুরু। আর থামেনি ক্রিকেটের সাথে পথচলা। সেই তখন থেকেই আমি ক্রিকেটখোর। ভাত ডালের সাথে ক্রিকেট খাই।
---
২০০৭ বিশ্বকাপের সময় গ্রামীণফোনের এর অনুপ্রেরণা যোগানো সেই টিভিসি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:১৪