বিদেশী কর্পোরেট বিনিয়োগের পক্ষে প্রধান যুক্তিই দেয়া হয় এই বলে যে এরা বিপুল মুনাফা দেশের বাইরে পাচার করলেও এরা ভালো বেতনের কর্মসংস্থান তৈরী করে।বাস্তবতা হলো,এসব বিদেশী কোম্পানি শুরুর দিকে তুলনামূলক ভালো বেতনে মেধাবী কর্মী নিয়োগ করলেও, কাজ ফুরিয়ে যাওয়ার পর অবলিলায় ছুড়ে ফেলে দেয়।এর সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বাংলাদেশের টিলিকম সেক্টর।
নেটওয়ার্ক তৈরীর সময় বহু মেধাবি তরুণদের তুলনামূলক ভালো বেতনে রিক্রুট করলেও, যখন নেটওয়ার্ক তৈরীর কাজটা মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে যায়, যখন কোম্পানি মুনাফা করতে শুরু করে, তখন এসব দক্ষ ও মূল্যবান মানব সম্পদ তাদের কাছে দায়ভার বা বার্ডেন এ পরিণত হয়।তাদেরকে ছাটাই করা শুরু করে। গ্রামীণ ফোন ইতোমধ্যেই এই কাজটি করেছে যার প্রতিবাদে গ্রামীণের কর্মীর গ্রামীণ ফোন এমপ্লয়িজ এসোসিয়েসান গঠন করে প্রতিরোধ তৈরী করেছে। এখন ছাটাই করছে দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর বাংলালিংক।
বাংলালিংক এ কর্মী ছাটাই এর খবর বেশ কিছুদিন ধরে গুজব আকারে শোনা যাচ্ছিল। সম্প্রতি ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলালিংকের সিইও বাংলালিংকের কর্মীদের সাথে এক সভায় সরাসরি বিষয়টি স্বীকার করেছেন।যদিও তিনি সরাসরি সংখ্যাটি বলেন নি,আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন মোটামুটি ৪০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে হবে। বাংলালিংকের মোট কর্মী সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৬২ জন। অর্থাৎ এক ধাক্কায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর্মী ছাটাই এর ধান্দা করছে বহুজাতিক ভিম্পলকম লিমিটেডের বাংলাদেশি সাবসিডিয়ারি বাংলালিংক।
বাংলালিংক বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের সরকার তথা জনগণ ও তার কর্মীদেরকে নানা ভাবে বঞ্চিত করছে।১১ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যাবসা করলেও নানা ভাবে খরচ বাড়িয়ে দেখিয়ে মুনাফার কথা স্বীকার করছে না। মুনাফার কথা স্বীকার করলে মুনাফার উপর সরকারকে কর দিতে হবে এবং কমীদেরকে মুনাফার অংশীদ্বারিত্ব প্রদান করতে হবে। অথচ একই বাজারে ব্যাবসা করে গ্রামীণ ফোন প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা করে মুনাফা করছে।এ বিষয়ে গুঞ্জনের সূত্র ধরে ২০১৫ সালে বাংলালিংকের তৎকালিন সিইও জিয়াদ সাতারা মুনাফা করার কথা স্বীকারও করেন। তিনি বলেন:
“We made profits during the first half of this year, but I can't provide the numbers right now,”
সূত্র: view this link
তাহলে প্রশ্ন হলো, ২০১৫ সালের প্রথম অর্ধে যে কোম্পানি মুনাফা করছে এবং এর আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি আয় করেছে বলে তৎকালিন সিইও বিটিআরসির কাছে স্বীকার করেছে, সেই কোম্পানি তে কি এমন ঘটলো যে ২০১৬ সালে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর্মী ছাটাই করা হবে? বাংলালিংক ২০০৫ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করার পর ১১ বছর হযে গেল- এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য যে এখনও পর্যন্ত কোম্পানিটি লস দিয়ে চলেছে, কোন মুনাফা করেনি, তারপরও এই দেশে বিনিয়োগ করে চলেছে? কোন পাগলে এটা বিশ্বাস করবে?
আসলে গত বছর বাংলালিংকের সিইও’র কথা থেকেই স্পষ্ট যে বাংলালিংক ইতোমধ্যেই মুনাফা করতে শুরু করেছে।এখন হলো মুনাফা আরো বাড়ানোর সময়, যে কারণে কোম্পানি পুনর্গঠনের অযুহাতে কর্মী ছাটাই করতে শুরু করেছে।
আশার কথা হলো, এই ছাটাই এর কথা বার্তার মধ্যেই বাংলালিংকের কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে ফেলেছে। সিইও এরিক অস আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার করার আগেই ৭১৯ জন কর্মীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ট্রেড্ ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশানের জন্য শ্রম অধিদপ্তরের শ্রম পরিচালক বরাবর আবেদনও করে ফেলেছে।
সরকার ও শ্রম মন্ত্রনালয়ের উচিত এখন দ্রুত এই ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রি প্রদান করা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি’র উচিত বাংলালিংকের কাছে কর্মী ছাটাই এর যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা চাওয়া, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
কিন্তু গ্রামীণ ফোনের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা থেকে সরকারের শক্ত ভূমিকার ব্যাপারে আশাবাদি হওয়া কঠিন।আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, দেশি বিদেশী কর্পোরেটরা তাদের শ্রমিক ও কর্মীদেরকে নানা ভাবে বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখে আর রাষ্ট্রের শাসকরা বিনিয়োগের পরিবেশের নামে এবং কমিশনের ধান্দায় এসব দেখেও না দেখার ভান করে।
এ অবস্থায় কর্পোরেট শ্রম শোষণ ও অন্যায় ছাটাইয়ের বিরুদ্ধে বাংলালিংক কর্মীদের এই লড়াইয়ের সাথে সংহতি জানানো, তাদের পাশে দাড়ানো, তাদের দাবী মেনে নিতে কোম্পানিকে বাধ্য করা সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দ্বায়িত্ব।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:২৪