রাজনীতিতে ঝগড়া দরকারি জিনিস; ইন ফ্যাক্ট, ঝগড়াই অনেকগুলি দল থাকার কারণ। আওয়ামী লীগের লগে কমিউনিস্ট পার্টির ঝগড়া না থাকলে ওইটা কমিউনিস্ট পার্টি না। বিএনপি আওয়ামী লীগের ঝগড়া এনজয় করি আমি। শেখ রেহানার বাড়ি বরাদ্দ বাতিল করার প্রতিশোধ নিতে খালেদা জিয়ার বরাদ্দ বাতিল করলে আমি খুশি। এনারা দোস্তি কইরা পাবলিক প্রপার্টি সব ভাগাভাগি কইরা নিলে আমার আনন্দ হবার কোনই কারণ নাই। যাঁরা দলগুলির মিলমিশ চাইছেন তাঁরা পাবলিকের শত্রু এবং বাস্তবিক, একটা ভিন্ন আর দল থাকার বিরুদ্ধে খাড়াইয়া আছেন।
একাধিক দল স্বীকার করলে আপনি বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগের মনের মতো চলার আবদার করতে পারেন না। সরকারের বিপদে বিএনপি কেন পাশে খাড়াইবে? বিএনপি বিপদ বাড়াইয়া তুলবে আরো। বিরোধী দলের কাজ-ই হইলো সরকাররে ফালাইয়া দেওয়া। যুদ্ধাপরাধীর বিচারে বিএনপির সমর্থন দিতে হইলে নিজের নির্বাচনী ইশতেহারের সাথে বেঈমানী করতে হয় তার! আওয়ামী লীগ যদি ইশতেহারের সাথে বেঈমানী কইরা বিচার বন্ধ কইরা দেয়, আপনি কি মানবেন? না মানলে বিএনপিরে কেন বেঈমানী করতে কইবেন?
কিন্তু দ্যাখেন, বিএনপি বেঈমানী কইরা ফেলছে অলরেডি; নিজের সাথে, নিজের মিত্রদের সাথেও। ট্রাইবুনাল নিয়া বিএনপির কিছু ক্রিটিক আছে মাত্র, বিরোধিতা নাই জামাতের মতো। ক্রিটিক তো আপনারো থাকার কথা! রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরদের একজনের নামও আগে শুনছেন লইয়ার হিসাবে? কোন ব্যারিস্টার নাই কেন? তুরিন আফরোজ বলছিলেন কিছুদিন আগে যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরেই ত্রুটি ছিলো! ওনারে এখন ইনক্লুড করা হইছে। সাক্ষ্য এবং প্রয়োজনীয় দলিল ঠিকভাবে কি দাখিল করা হইছিলো? মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বা বিবিসি বা আকাশবাণী ও দূরদর্শনের হাতে বহু প্রমাণ থাকার কথা; এদের সহযোগিতা চাওয়া হইছে বলে কখনো শুনছেন? গবেষকদের কাছেও দলিল থাকার কথা। সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধী কারা বা কী কী দলিল গবেষকদের কাছে আছে সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া হয় নাই। যদ্দূর মনে পড়ে, ঘাদানিক আর শাহরিয়ার কবিরও প্রসিকিউটরদের উপর পুরা আস্থা রাখতে পারে নাই। প্রসিকিউশন ফালতু হলে অপরাধীরা বেকসুর হিসাবে বাইর হইয়া আসে। যেই দুর্বল প্রসিকিউশন নিয়োগ দেওয়া হইছে তাতে জামাতের আনন্দই বেশি হবার কথা। ব্যারিস্টার রাজ্জাকরে সামাল দেবার মতো উকিল একজনও নাই প্রসিকিউশনে! কখনো কখনো বিচার বেকসুর খালাস দেবার উপায়! বিচার আর শাস্তি দুই জিনিস।
গোলাম আজমের নাগরিকত্বের মামলার কথা মনে করেন। সেই মামলায় গোলাম আজমেরই লাভ হইছিলো। কারণ, সংবিধান তাঁরে নাগরিকত্ব দিয়াই রাখছে আগে। উচিত ছিলো আগে সংবিধান অ্যামেন্ড করার দাবি তোলা। এবারেও সেই ধরা আবার খাইতে পারেন; সময় থাকতে আপীলে ভালো উকিল দেওয়ার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে নামেন। ট্রাইবুনালের প্রসিকিউশন পাল্টাবার দাবি করেন। অযোগ্য প্রসিকিউশন নিয়োগ দেওয়ায় আইন প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া উচিত বরং আপনাদের।
তো, বিএনপির ক্রিটিক আপনারে সুযোগ কইরা দিছিলো সরকারের উপর প্রেশার তৈরি কইরা প্রসিকিউশন বা আইন ঠিক করা।
তা না কইরা আপনে বিএনপির নিন্দা করেন। ফরহাদ মজহাররে গালি দেন! ফরহাদ মজহার উল্টা হইলে তো উল্টাই; সবাই আপনের পক্ষে থাকবে কেন? ওনারে গালি দিয়া তো আসলে ওনার অভিযোগরেই জাস্টিফাই করতেছেন? বরং ওনারে কাছে ডাকেন। দ্যাখেন, উনি আসলে বিচারে নৈতিক সমর্থনই দিছেন! বরং ওনার ক্রিটিকগুলিরে আমলে নেন। উনি তখন ভ্যাবাচাগা খাইয়া যাবেন। কারণ, আপনার এই ফ্লেক্সিবিলিটি ওনার অপ্রত্যাশিত! আবার, ওনারে বন্ধু ডাকার মাধ্যমে ওনার অভিযোগরেই ইনভ্যালিড বানাইয়া দেওয়া যায়! উনি একসময় জামাত নিষিদ্ধ করার জন্য লিখছিলেন। দ্যাখেন, উনি সেইটা প্রত্যাহার করেন নাই! নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ওনার অবস্থান পরিবর্তন করেন নাই তো এখনো! অবস্থান পরিবর্তন না করার জন্য ওনারে ধন্যবাদ দেন। উনি জামাত-শিবির হত্যা থামাইতে বলছেন; এই বলা তো নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা না! দোস্তি আর দুশমনি পরিষ্কার চেনা দরকার।
ফরহাদ মজহার যা যা বলেন নাই সেইগুলি বলাতে উনি যা বললেন তার সমালোচনা করা হয় না। জামাতের সমালোচনা করেন নাই উনি; কিন্তু এইটা দেখানো তো আপনাদের এবং রাষ্ট্রের যেই সমালোচনা উনি করছেন তার জবাব হয় না! বরং ওনার সমালোচনায় ভুল ধরেন। যেমন, উনি ‘ফ্যাসিস্ট’ বলছেন; এইটা তাত্ত্বিক ভুল! হিস্ট্রিক্যলি ফ্যাসিজম এইটা না; ফ্যাসিজম হিস্ট্রিক্যলি একটা স্পিরিচুয়াল প্রজেক্ট, আর উনি স্পিরিচুয়ালিটিরে প্রত্যাখ্যান করারে বলেন ফ্যাসিজম! ফ্যাসিজমের জাতীয়তাভিত্তিক নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক প্রস্তাব এবং বলপ্রয়োগমূলক বাস্তবায়ন আছে; রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার জোরালো প্রবণতা আছে; মুসোলিনি আর হিটলারকে দ্যাখেন। আর এদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচে উদার অর্থনীতির দেশগুলির একটা; এই রাষ্ট্রের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দিতে চায় সরকার, এশিয়া এনার্জির কথা মনে করেন। ফরহাদ মজহার ফ্যাসিজমের পুরা উল্টা অর্থনৈতিক ব্যবস্থারে বলছেন ফ্যাসিজম! ফ্যাসিজম অত্যন্ত গোড়া পুরুষতান্ত্রিক, ফ্যাসিজম নারী নেতৃত্ব সহ্য করে না। ফরহাদ মজহার নারী নেতৃত্বরে কন ফ্যাসিজম। ফ্যাসিস্ট স্টেটে মিলিটারাইজেশন ঘটবে; এতো পরিমাণ যে প্রতিবেশী দেশ আতংকিত হইয়া পড়বে! আর বাংলাদেশ ইন্ডিয়া পাকিস্তান তো দূরের কথা বার্মার চাইতেও দুর্বল এবং এইটা কাটাবারও কোন চেষ্টা নাই। বাংলাদেশের মিলিটারির প্রধান লক্ষ্য জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে জায়গা পাওয়া। এগুলি ফ্যাসিজমের লক্ষণ না আদৌ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইংরাজির ভক্ত; এই আত্মাভিমানহীনতা দিয়া ফ্যাসিজম হয় না। স্রেফ মতপ্রকাশে বাধা আর বলপ্রয়োগের কতক উদাহরণই স্টেটকে ফ্যাসিস্ট হিসাবে প্রমাণ করতে পারে না। অন্য নামে ডাকতে হবে মজহারের। এগুলিতেই ফ্যাসিস্ট হইয়া গেলে তো পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই কমবেশি ফ্যাসিস্ট! চীন বা কিউবা বা ইরান পুরা ফ্যাসিস্ট; ফালতু বিশ্লেষণ এইটা। মার্ক্সবাদে কোন অর্থনৈতিক প্রজেক্ট নাই—এইটা দাবি করার মতো বিশ্লেষণ মজহারের ফ্যাসিজম বোঝাবুঝি। ওনার বিশ্লেষণ চীন বা ইরান বা কিউবারে ফ্যাসিস্ট হিসাবে দেখায় বইলা ওইটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালি।
আপনারা কেন খেয়াল করেন না যে, বিএনপিও নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা করে নাই! কিন্তু নিষিদ্ধ করা মানে তো মানুষগুলিকে হত্যা না! তাঁরা স্রেফ অন্য নামে পলিটিক্স করবে! রি-ব্রান্ডিং মাত্র! একটেল যেমন রবি হইছে! জিনিসটা সত্যিই এই রকম সরল! ধরেন, সংবিধানের ধারাটা হবে এমন:
"রাজাকার, আল বদর, আল শামস্, জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ (এবং কিছু মার্ক্সবাদী দল--......) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার পাকিস্তান রাষ্ট্রের সহযোগী হিসাবে বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ড এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারে অংশগ্রহণ করিয়াছিলো। এই কারণে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ইত্যকার নামের আংশিক বা পূর্ণরূপ বা বানানভেদ ব্যবহার করে কেউ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাইতে পারিবে না।"
এনারা তখন রি-ব্রান্ডিং করে নেবে নিজেদের। আর এদিকে আপীলে ভালো প্রসিকিউটর নিয়োগের দাবি তোলেন। বিএনপির সমালোচনাগুলিরে পাত্তা দেন। মিডিয়া আপনারে দেখাইতেছে যে জামাত পুলিশরে আক্রমণ করছে; পুরাটা বিশ্বাস কইরেন না; বেশির ভাগই মিথ্যা কথা। যুক্তি দিয়া ভাবেন। পুলিশ আক্রমণ করতে চাইলে সবচে ভালো ট্রাফিক পুলিশ মারা; এনারা একজন কি দুইজন এক জায়গায় থাকে। কিন্তু এযাবত কোন ট্রাফিক পুলিশ আক্রান্ত হয় নাই! শিবিরকে মিছিল করতে দেবেন না কেন? সংবিধানে আছে:
"৩৭। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।"
মিছিল করতে দিতে হবে। মিছিল-সমাবেশ করা তো বেআইনী না! জামাতরে জঙ্গি বা সহিংস হিসাবে প্রমাণ করতে চাইছেন কেন? নিষিদ্ধ করতে তো এই লজিক দরকার নাই, একাত্তরে পাকিস্তানের দালালিই পর্যাপ্ত। সরকার বরং আমি নিষিদ্ধ করার যেই ধারাটা বল্লাম সেইটা সংবিধানে যোগ করুক; জামাত-শিবিরের মিছিল বেআইনী হইয়া যাবে অটোমেটিক। নিষিদ্ধ না কইরা রাজনৈতিক মোকাবেলার কথা বলেন কেউ কেউ। ফালতু কথা; আইন কি রাজনীতির বাইরে নাকি! ওনারা বাচ্চাদের বইতে পর্নোগ্রাফি ঢুকাইয়া সেইটার এক আধিভৌতিক রাজনৈতিক মোকাবেলা করুক।
ফরহাদ মজহার আপনাদেরই লোক। উনি আপনাদের সার্ভ করেন কেমনে দ্যাখেন: দাড়ি-টুপি মানেই জামাত না—এইটা বইলা উনি তো জামাতরে ছোটই করলেন! অথচ আপনারাই জামাতরে বড়ো বানাইতেছেন। মুসলমান আর জামাত গুলাইয়া বাংলাদেশে আপনাদের তুলনায় জামাতরে কয়েকগুণ বড়ো বানাইতেছেন তো আপনারাই! সবাইরে জামাত বইলা গালি দিয়া জামাতরে আওয়ামী লীগের চাইতে বড়ো দল বানাইয়া ফেলছেন প্রায়! উনি জামাত নিষিদ্ধ করার দাবিতেও আপনাদের সাথে আছেন। বিএনপি’রও বিরোধিতা নাই; করে না কেন সরকার—সেই প্রশ্ন করেন বরং।
জামাত বা ইসলামিস্টদের গোড়া, রক্ষণশীল বইলা সমালোচনা করেন আপনারা। কিন্ত দ্যাখেন এরা দাড়ি কামানো পনিটেইল অলা ফরহাদ মজহারকে নিতে পারে; ফরহাদ মজহার স্বরস্বতিরে নিয়া ছবি তুললেও নিতে পারে; অনেকখানি চৈতন্যদেবসহ লালনঅলা মজহারকে নিতেও আপত্তি করে না। নারী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাদের সমস্যা নাই। কিন্তু আপনাদের টেলিভিশন চ্যানেলে একজন দাড়ি-টুপি দেওয়া খবর পাঠক নাই; শেখ হাসিনা ছাড়া হেজাব দেওয়া মহিলাদের নেন না আপনারা; কিন্তু ইসলামী ব্যাংকরে দ্যাখেন; সে তো আপনাদের মতো চেহারার লোক নিতে পারে! তাইলে আপনাদের উদারতা কোথায়? যারে সমালোচনা করেন রক্ষণশীল বইলা, তার চাইতেও কম ফ্লেক্সিবল কেন হবেন আপনি!
মূল লেখা ঃ রেজাউল করিম (মনু ভাই)