বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সাধারণ নাগরিকদের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনসচেতনতার অভাব—এসবের কারণে গণপিটুনির মতো ভয়াবহ প্রবণতা বাড়ছে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ফলে জনগণের একাংশ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, যা পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক।
সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে, মব তৈরি করে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নিরীহ মানুষকে আক্রমণ করা হচ্ছে। শুধু প্রতিপক্ষকে দমন করাই নয়, ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেও এই সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ ঘটনাগুলোকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও গভীর বিশ্লেষণে বোঝা যায়, এর পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিভিন্ন মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনতাকে উসকানি দিচ্ছে এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাইছে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে মব তৈরি করে হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, জমি দখল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপদস্থ করা, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটেছে। একসময় যেখানে শুধু ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটতো, এখন সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মব তৈরি করে ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটানোর প্রবণতা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এই ধরনের অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। যখন মানুষ দেখে, অপরাধীদের দ্রুত ও যথাযথ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, তখন তারা নিজেরাই বিচার করার চেষ্টা করে। এতে একদিকে নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়ছে।
পুলিশ প্রশাসনের একাংশের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেও মব সৃষ্টির প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বা ধীরগতিতে তদন্ত হচ্ছে, যার ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে মব সৃষ্টিকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় এবং ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে সাহস না পায়।
সরকারের উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনা। নাগরিকদের সচেতন করাও অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা উত্তেজিত হয়ে আইন নিজের হাতে না তুলে নেয়। গণমাধ্যম এবং সামাজিক সংগঠনগুলোরও উচিত এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, বিচার করার দায়িত্ব আদালতের, সাধারণ জনগণের নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানো, জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং বিচারব্যবস্থার সংস্কার করা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পেতে আদালতের দ্বারস্থ হয়, মবের হাতে নয়।
এখন সময় এসেছে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে আমাদের সমাজ এক ভয়ংকর অরাজকতার দিকে ধাবিত হবে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:০২