একটা সত্তার তীব্র চিৎকারে সব ফিকে হয়ে আসে ! ভালোবাসার আর সব গান, চেতনার পরিচিত সেইসব ঘ্রাণ; চিরচেনা পৃথিবীটা খুব দ্রুত ফিকে হয়ে আসে; আমি সেই চিৎকার শুনিনি, কারণ সেখানে থাকার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি। এভাবে আরো অনেক দুর্ভাগ্য থেকে একে একে রেহাই পেয়েছি, কাদামাটি ছেনে বৃষ্টির দিনে সেই ধবল অবয়বটাকে আর সবার সঙ্গে বয়ে নিয়ে, টেনে হেঁচড়ে কবরে নামাতে হয়নি; খবরের কাগজ নিয়মিত দেখতাম না বলে সংবাদটাও জানা হয় আরো অনেক পরে, পরশ্রী কাতর বন্ধুর জেরার মুখে—সেসব শুনে প্রথমে বুঝতে পারিনি; খানিক বাদে কাদামাটি মাখা আরো অনেক কে দেখে ঘটনার আকস্মিকতায় তবু মুষড়ে পরিনি। সেই কান্নার জল মাটিতে পড়েছে কিনা জানিনা তবে বাইরের আকাশ তা একটুও দেখতে পারেনি। সেই গভীর আর্তনাদ ঘটনার বেশ ক’দিন আগে থেকেই আমার পিছু নিয়ে ছিল, পিছু নিয়ে ছিল আমার গিটারের সুরের, আমার গলা সাধার; আলো-আধারিতে বসে তাই বেশ কিছু দিন আর কোন গান গাইতে পারিনি—সেই হাতছানির পর থেকে; আমার ষষ্ট ইন্দ্রিয়েরা আগেভাগেই সেসব হয়তো বার বার জানান দিচ্ছিল; বার বার একই হাতছানি, অন্ধকারে কিযেন একটা একটানা করুন সুর; তবু বার বার আমারই মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল ঠিক কান্নার মতো; আবছা অবয়বে কে যেন সেদিন তার সব সাজ-পোশাক আর গহনা পরে রিনিঝিনি শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছিল সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে; গাঢ় অভিমানে সেই সুন্দরী অশরীরীকে সে দিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, যে আমাকে একদিন তীব্র অপমান আর অবহেলা করে দূরে চলে গিয়ে ছিল; আমিও আর ফেরাইনি তাকে, ফেরাবার চেষ্টা করিনি একটি বারও, আমার দৃষ্টিতে তবু সহস্র আকুতি তাকে বোঝাতে পারিনি, তাকে ফেরাতে পারিনি—সেই মোহ—সেই লোভ, কীএক জিঘাংসা, জানিনা তার সত্যিকার মানে, বুঝিনি, এখনও কি বুঝি ? এভাবে কেউ ফিরে আসে, যখন আর কাছে টানার কোন উপায় থাকে না, যখন আর কোন কথা বলার থাকে না, যখন আর চাইবার কিচ্ছু থাকে না, যখন আর তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে করে না ! তখনও আমি করুণ সেই সুরে বুদ হয়ে ছিলাম, তখনও নিজেকে আড়াল করবার আপ্রাণ চেষ্টা, ভিন্ন অনুভূতির কি যেন এক গভীর আকুতি দু’জনার মাঝে, চারদিক ঘিরে ভিনদেশী দামি পারফিউমের ঘ্রাণ, হিরের নেকলেস আর নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ তাকে গ্রাস করতে পারেনি একেবারেই; তাই বুঝি সে আর বেশী ক্ষণ অপেক্ষা না করে অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙ্গে একপা দু’পা করে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে সেই আবছায়াময় আঁধারে, নূপুরের রিনিঝিনি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল, আমি সেই শব্দ শুনেছি, সেই অদ্ভুত ঘ্রাণও যেন সরে যাচ্ছিল …..
আবারও এভাবে একদিন ফিরে আসবে ভাবিনি, আশাও করিনি, কিন্তু চিরতরে অন্যপারের দেশে চলে যাবার কথা একটি বারের জন্যে ক্ষণিকের তরে মাথায় আসেনি, কেননা একটু পরেই সারা ঘর কাঁপানো গগনবিদারী যেই হাসি শুনে ছিলাম, তাতে আমি না বুঝেই, অন্যের সুখ দেখে আমার গভীর দুঃখের সঙ্গে মনে মনে তার তুলনা করে, একটু হলেও বুকের গহীনে গভীর এক শূন্যতা অনুভব করেছি, বুঝিনি সেই কান্নার হাসি; আরো পরে স্বপ্নের ভেতরে ওর সেই চাপা কান্নার গভীরতাও বুঝতে পারিনি,—আমি তো এসবের কোন কিছুর জন্যই দায়ী নই, আমার বারণ তো তুমি কখনই কানে নাও নি, তবে এখন কেন আবার এভাবে ঘুমের মাঝে যেচে এসেছ বাসর ঘরের সাজ পোষাকে, কার নামে নালিশ করতে; আমি তো তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাইনি, তোমার নিজের ভুলেই এতসব অনাসৃষ্টি, তাও শান্তিতেই তো আছো সব পাওয়ার কোন দেশে ! না হলে সবাই মিলে কবরের কাদামাটির গভীরে রেখে আসার পরও এতো সব কোথা থেকে পেলে ?
আবারও অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে কাউকে যেন চলে যেতে দেখলাম, এবারের সিঁড়িটা অনেক দীর্ঘ হয়ে উঠে গেছে মেঘের ওপারে, আরো দূরে, অসীম দূরে, মিইয়ে গেছে একটানা শরীর জড়িয়ে থাকা ভারি কাতানের ওপরকার একরাশ গহনার শব্দ আর নূপুরের রিনিঝিনি, পরিচিত সেই ঘ্রাণ… …
তারপর থেকে স্বপ্নের সেই সিঁড়ি বেয়ে আর কেউই নেমে আসেনি, আর মাটির পৃথিবীতে যাদের দেখি ওরা কেউই তার মতো তো নয়, যেন এঁরা অন্যকেউ, ঠিক যেন অচেনা অজানা এঁদের ওভাবে আগের মতো করে আর কাছে টানার কিছু নেই, কাছে টানা যায় না কখনই… …
View this link