গুটি গুটি বৃষ্টি পড়ছে, শীত বেড়েছে । কুয়াশার গাঢ়ত্বের জন্য দুই ছাউনির মাঝখানের ফাঁকা অংশ দিয়ে কালো মেঘের আকাশটাকে ভালো মত দেখা যাচ্ছে না । সিয়াম রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছে, কেউ একজন আসবে । সে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে মোটা পিলারের চারপাশ ঘিরে গোল করে বসানো সিমেন্টের বেঞ্চিতে । রাত এখন ১ টা ১০, স্টেশন প্রায় খালি হয়ে গেছে, এদিক ওদিক কয়েকজন গার্ডের হাঁটাহাঁটি আর কুকুরের বসে বসে মাছি তাড়ানো ছাড়া তেমন শোরগোল নেই । সিয়াম যে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা আসার কথা ছিলো ১১টায় কিন্তু এখনো এসে পৌঁছাই নি । রেল মাস্টারের ওখানে খবর নিয়ে সিয়াম জানতে পারে ট্রেনটা আসতে লেট হবে, কোথায় নাকি লাইন খুলে গেছে, তা মেরামতের কাজ চলছে, তাই তারাও সঠিক কোন টাইম বলতে পারছে না । দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে সিয়াম বসে আছে, মুখে খুব টেনশানের ছাপ । সে বার বার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে একটি কলের জন্য, যার আসার কথা তার ফোন অনেকক্ষণ ধরে অফ পাচ্ছে ।
মোবাইলটা পাশে রেখে সিয়াম হাত দু'টো মুখের কাছে ধরে ঘষছে আর ফু দিচ্ছে, হাত দু'টো বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে । সে দেখছে একজন চা সিগারেট বিক্রেতা তার বাক্সপেট্রা নিয়ে এদিকে আসছে । এরা রাতের বিক্রেতা, রাত গভীর হলেই বের হয়, কাস্টমার খুঁজে খুঁজে চা সিগারেট বিক্রি করে । এদের বিক্রি দিনের চাওয়ালাদের থেকেও বেশি হয়, দিনে মানুষ থাকে অনেক কিন্তু কাস্টমার থাকে কম, প্রতি পঞ্চাশ জনে হয়তো এক দুইজন কাস্টমার মেলে । কিন্তু রাতের এই সময়টায় যা কয়জন স্টেশনে থাকে ধরা যায় সবাই কাস্টমার, কেউ সিগারেট নিচ্ছে নয়তো কেউ চা । আর কিছু নিয়মিত কাস্টমার থাকে যাদের জন্য শুকনো লতাপাতা, পাউডারও রাখে রাতের বিক্রেতারা, এতে রিক্স থাকে অনেক কিন্তু ইনকাম প্রচুর । সিয়ামের কাছে এসে লোকটা জিজ্ঞেস করলো চা সিগারেট কিছু লাগবে কিনা । সিয়াম চা দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালো ।
চাওয়ালা বড় ফ্লাক্সটার উপরের সুইচ টিপ দিয়ে কাপে চা পুরছে । চায়ের ধোঁয়ার সাথে তেজপাতা, এলাচের চমৎকার ঘ্রাণ বের হচ্ছে । রেললাইনের অপরপাশের চাউনি থেকে হঠাৎ একটা কুকুর তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে, নাইটগার্ড জোরে জোরে বাঁশি বাজাচ্ছে, ট্রেনটাও প্রায় এসে গেছে, ইঞ্জিনে টান দিয়ে দিয়েছে, ধীরে ধীরে ট্রেনটা স্টেশনের দিকে এগুচ্ছে, ট্রেনের টান টান হর্ণ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে চলে গেল । চাওয়ালা ধোঁয়া ওঠা কাপটা সিয়ামের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সিয়াম চাওয়ালার হাত থেকে চা নিলো, তখন ট্রেনও পুরোপুরি এসে থেমেছে । চাওয়ালা সিয়ামের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে চিতি পড়া বত্রিশটা দাঁত বের করে একটা হাসি দিল । সিয়াম লক্ষ করলো তার চারপাশে প্রচুর শোরগোল হচ্ছে, মানুষে মানুষে ছাউনিগুলো সব ভরে গেছে, যুবক, বৃদ্ধা, শিশু, মহিলা, হকার, চাওয়ালা, বাদামওয়ালা, ভিক্ষুক ।
স্টেশন গেইটের সামনের রাস্তা দিয়ে রিকশা করে যেতে যেতে এক ব্যাক্তি আরেক ব্যাক্তিকে বলছে, ....প্রায় বিশ বছর হয়, এই রেল স্টেশনটা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:১৩