তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
প্রথম পর্ব
সেকান্দ্রায় আকবর টম্ব। সেখানে তেমন ভীড় তখনো শুরু হয়নি। ভারতীয় রেটে টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম। ঢোকার সময় একজন গাইড তাকে নেয়ার জন্য খুব ধরলো। প্রথমে নিতে চাইনি। কিছুদুর এসে দেখি কাউন্টার থেকে আমাকে বাকি টাকা ফেরৎ দেয়নি। তাই আবারো কাউন্টারের দিকে গেলাম। বল্লাম এক্সচেঞ্জ কই? সে এই যে বলে গুনে রাখা টাকা গুলো ফেরত দিলো। পেছন থেকে ডেকে যে টাকাটা ফেরৎ দিবে তা আর তাদের মাথায় নাই। ফিরতি পথে আবারো গাইড নেয়ার জন্য অনুরোধ শুরু হলো। শেষে ১০০ টাকায় একজন গাইড নিলাম। তার নাম সেলিম। বয়স্ক দাড়ি ওয়ালা ভদ্রলোক। সে ঢুকতে পথে অনেক কিছুই জানালো। সে বল্লো যে আকবেরর কোন ছেলে হতো না। প্রথমে সে ছেলে হওয়ার দোয়া আনতে গেলো হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর দরবারে। খাজা সাহেব তাকে ফতেহপুরের এক জঙ্গলে (তখন জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা ছিলো) অবস্থিত হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এঁর নিকট যেতে বলেন। তাঁর কথা অনুযায়ী সম্রাট আকবর হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এঁর কাছে এসে আবেদন করেন। উক্ত সেলিম চিশতি (রহঃ) এঁর এক ছেলে ছিলো, বালাজি নাম। উক্ত হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এঁর দোয়া ও আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত বালাজির র পরিবর্তে আল্লাহপাক জুদাবাইয়ের গর্ভে আকবরকে একটি ছেলে সন্তান দান করেন, যার নাম রাখা হয় সেলিম।
ভেতরে ঢুকতে সিকিউরিটি পুলিশ চেক করলো। কাঁধে ঝোলানো সাইড ব্যাগ খুলতে বল্লো। খুলে দিলাম। পুলিশ পাসপোর্ট দেখে বল্লো এগুলো কি? আমি বল্লাম পাসপোর্ট। সে জিজ্ঞাসা করলো কোন দেশ থেকে এসেছি? আমি বল্লাম বাংলাদেশ। সে তখন বল্লো এই টিকেট দিয়ে তো তোমরা ভেতরে ঢুকতে পারবা না। আমি বল্লাম আমি তো কিছু জানি না। আমি টিকেট চেয়েছি, কাউন্টার থেকে টিকেট দিয়েছে। তখন সেই পুলিশ বল্লো বের হওয়ার সময় চা নাস্তা খাওয়ার জন্য কিছু দিয়ে যেয়ো। আমি বল্লাম আচ্ছা।
(সুরা মুলক এর কারুকাজ)
(আকবর টম্বে ঢোকার মুহুর্ত- এখান থেকে আরো ভেতরে ঢুকতে হয়। )
(দূরে হরিণ দেখা যায়)
গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে বেশ কিছুদূর হেটে যেতে হলো। দুপাশে সবুজ মাঠ। মাঠে হরিণ চরে বেড়াচ্ছে দূর দিয়ে। আকবরের সমাধিটা একটা ঘরের ভিতর। একটি সরু গলি দিয়ে ঐ ঘরে ঢুকতে স্যান্ডেল খুলতে হলো। অন্ধকার মতো। সেই ঘরের বাইরে দিয়ে দেয়ালের চারপাশ জুড়ে সুরা মুলক লেখা। গোলাকৃতির সেই ঘরের একদম ঠিক মাঝখানে তার সমাধি। একজন খাদেম দাড়িয়ে আছে মাথার কাছে। আমরা ওখানে পৌছালে সে আল্লাহু আকবার বলে একটি চিৎকার দিলো, সেই শব্দ ধ্বনিত হলো। সমাধির উপরে একটি ঝাড় বাতি ঝোলানো। এক সময়ের প্রতাপশালী সম্রাট জিল্লে এলাহী জালালুদ্দীন মোহাম্মদ আকবর আজ নিভৃতে একাকি নির্জনে শুয়ে আছে। ভাবতেই কেমন লাগে!! বিশাল এরিয়া জুড়ে তার এই সমাধি। কত একর যেনো বলেছিলো সেলিম সাহেব। ভুলে গেছি। চার দিকে চারটি একই রকম দরজা আছে এই সমাধির। ওনার সমাধি কক্ষ থেকে রেরিয়ে এলাম। ঐ কক্ষের পাশেই রয়েছে তার দুই মেয়ের সমাধি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সমাধি।
একটি ফাকা খোপ মত ঘরের এক কোনায় দাড়িয়ে সেলিম সাহেব আমাকে দেওয়ালের এক কোনায় কান পাতার নির্দেশ দিলো। আমি কান পাতলাম। উনি অপর এক কোনায় দাড়িয়ে হ্যালো হ্যালো করে আওয়াজ দিলেন। ওনার হ্যালো হ্যালো আওয়াজটি দেওয়ালের ভেতর দিয়ে আমার কানে এলো। এরই নাম বুঝি দেওয়ালেরও কান আছে!! এরপর সেলিম সাহেব ঐ ঘরের মাঝে দাড়িয়ে একবার তালি দিলো। তালিটা ভাইব্রেশন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো। এই সব কারুকাজ দেখে আমরা সমাধি স্থল ত্যাগ করতে উদ্যোত হলাম। ঐ বেটা পুলিশের জন্য ২০ রুপি হাতের মুঠোয় ভরে বাইরের দিকে হাটা দিলাম।
গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় দেখি ঐ বেটা উল্টো মুখো হয়ে একটি খাতায় কি যেনো লিখছে। আমি সোজা বেরিয়ে হাটা দিলাম। সেও দেখেনি, আমিও পিছু তাকাইনি ......! বের হয়ে সেলিম সাহেবকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় করলাম। এই পরিবেশ এই মুহুর্তগুলো যে মন দিয়ে অনুভব করবো, সেই সময় সুযোগ নেই। এখন আমরা রওনা দিবো ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে। মেয়েকে কাঁধে করে চলে এলাম পার্কিং এ। রামজি গাড়ি পার্কিং এ বসে ছিলো। আমরা রওনা হলাম। বেলা তখন ১০টা মতো বাজে।
বেলা ১২টা নাগাদ পৌছে গেলাম ফতেহ পুর - সিক্রী। রামজি গাড়ি পার্ক করলো। পার্কিং তখন বেশ পরিপূর্ণ। পার্কিং এ নেমে কিছুদূর হেটে এগোলাম। নির্দিষ্ট একটি ষ্টপেজ থেকে ছোট ছোট বাসে করে যেতে হলো মূল দর্শনীয় স্থানে। ছোট গাড়ি গুলো পাহাড় বেয়ে বেশ উঁচুতে একে বেকে উঠে যেতে লাগলো। মিনিট পাচেক পর নামিয়ে দিলো ফতেহপুর সিক্রীর দোর গোড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে একখানে দাড় করিয়ে টিকেট কাউন্টারে গেলাম। ভারতীয় দামে টিকেট কিনে যখন ফিরে এলাম ওদের কাছে, দেখি একজন গাইড হিসাবে কাজ করার জন্য ওদেরকে রাজী করানোর কাজে ব্যস্ত। প্রথমে একটু বুঝে নেয়া দরকার। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কি কি আমাদেরকে দেখাবে। সে প্রথমে বল্লো ডানে হলো সিক্রি, আর বামে হলো ফতেহপুর। এই দুই মিলে হলো ফতেহপুর সিক্রি। প্রথমে সে আমাদেরকে প্রস্তাব করলো ফতেহপুর দেখতে। ওখানে আছে বুলান্দারওয়াজা, হযরত সেলিম চিশিতি (রহঃ) এঁর মাজার। তারপর সে সিক্রি ঘুরিয়ে দেখাবে। যেটা কিনা আকবর- যুধাবাঈ ও অন্যান্য রানীর প্রাসাদ। আমরা কি করবো ? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই আগে সিক্রীতে ঢুকছে। কিন্তু এই গাইড আমাদেরকে আগে ফতেহপুর ঘুরাতে চাইছে। কারণটা কি? তাই সাত – পাচ ভেবে ওকে আর গাইড হিসাবে নিলাম না। আমরা টিকেট দেখিয়ে সিক্রির ভেতরে ঢুকে গেলাম। ওখানে ঢোকার পরে আবার পড়লাম এক লাইসেন্স ধারী গাইডের পাল্লায়। সেও প্রস্তাব করলো দুইটি স্থানই সে ঘুরিয়ে দেখাবে এবং সে এটাও বল্লো এখানে লাসেন্স ছাড়া কেউ গাইড করতে পারে না। তখনই বুঝলাম ঐ বেটা কেনো আগে আমাদেরকে ফতেহপুর দেখাতে চাচ্ছিলো, কারণ সে এই সিক্রীর ভেতরে ঢুকতে পরতো না!! কি চালাক!!! যাই হোক আমরা একে গাইড হিসাবে নিলাম। যেহেতু সে লাইসেন্স ধারী। তার সাথে প্রথমে সিক্রি ঘুরে দেখলাম।
(সিক্রির কিছু ছবি)
রানীদের থাকার ঘর, রান্না ঘর, আকবারের শোবার ঘর, বিচার করার উঁচু স্থান, যা কিনা ধর্মানুসারে রাস্তা সহ চার ভাগে ভাগ করা , তানসেনের গজল গাওয়ার স্থান সহ সব কিছুই ঘুরে ফিরে দেখলাম। দুই রানীর জন্য ছিলো আলাদা রান্না ঘর। কারণ যুধাবাঈ ছিলেন শাকাহারী। অন্য রানী ছিলেন মাছাহারী আমিষ ভোজী। বেশ গরম পড়েছে আজ। মাথায় একটি সান ক্যাপ কিনে নিয়েছিলাম ঢোকার মুখে, সেটা এখন কাজে দিচ্ছে। এই সিক্রি থেকে অনেক দুরে জলাধার নির্মান করা হয়েছিলো যাতে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়। সম্রাট আকবর এখানে গরমের দুই মাস এখানে অবস্থান করতেন। তার শোবার ঘরের উচ্চতা ছিলো ৫ফিট ৫ইঞ্চি মতো। সম্রাট আকবর ছিলেন ৫ফিট ৪ইঞ্চি। সৈন্যরা তার কামরায় ঢুকতে গিয়ে যাতে মাথা নত করতে বাধ্য হয়, তাই ছাদের উচ্চতা কমানো ছিলো। কারণ সৈন্যরা ছিলেন অনেক লম্বা লম্বা। কি বুদ্ধি!!
এক কোনায় দেখলাম গোলাপ জল তৈরীর মেশিন পড়ে আছে। ওখানে থেকে গোলাপের নির্জাস পানি দ্বারা প্রবাহিত হয়ে রাজা রানীদের হাম্মাম খানায় চলে যেতো। আহ কি ব্যবস্থা!! এসব ঘুরে ফিরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু এখনো ফতেহপুর বাকি!!
যে গেট দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেই গেট দিয়েই বের হলাম। বের হতেই আমাদের ঐ গাইড আমাদেরকে আরেক গাইডের হাতে হস্তান্তর করে দিলো এবং বল্লো আমার টাকাটা এই গাইডের হাতেই দিয়ে দিবেন। আমরা বল্লাম ঠিক আছে। বলে আমরা নতুন গাইডের পিছু পিছু চল্লাম। সে আমাদেরকে ফতেহপুরের দিকে নিয়ে চল্লো। পরিদর্শনের জন্য ফতেহপুর বলতে যেটা বোঝায় সেটা হলো বুলান্দারওয়াজা, হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এঁর মাজা শরীফ এবং সেই সাথে ওনার মুরিদানগনের মাজার সমুহ, আনারকলিকে যে সুড়ঙ্গ পথে করাচীর উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিলো, সেই সুড়ঙ্গ পথ, মসজিদ ......। এই দর্শনীয় স্থান গুলো একটি প্রাচীরে বন্দী। আমাদের নতুন গাইড প্রথমে আমাদেরকে আনারকলির সুড়ঙ্গ দেখিয়ে দিলো। ওখানে অনেক পাকা করা ছোট বড় অসংখ্য মাজার। সেই সব মাজারের ভেতর দিয়েই লোকজন হর হামেশা হেটে যাচ্ছে। এতো কবরের ভিতর দিয়ে শত শত মানুষ হেটে চলেছে, কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আনারকলির সুড়ঙ্গের পাশেই রয়েছে একটি দেয়াল আর একটি খোপ।
(আনারকলির সুড়ঙ্গ - ফতেহপুর)
অনেক দূর থেকে হিম শীতল বাতাস আসছে কোন এক সুড়ঙ্গ দিয়ে। হাত দিয়ে সেটাও অনুভব করলাম। এর পর আমাদের গাইড আমাদেরকে নিয়ে এগোলো মাজারের দিকে। যেতে পথে দেখলাম অনেকেই একটা ছোট ছোট বাক্স নিয়ে বসে আছে। এই গাইডটা একটু ছটফটে রকমের। সব কিছুতে কেমন কাঠ খোট্টা ভাবে দেখাচ্ছে। আমার মেজাজটা একটু খারাপ হতে শুরু করলো। সেটা আরো বেগ পেলো যখন সে মেয়ের মাকে একটি ছোট বাক্স নিয়ে বসা এক লোকের সামনে আদেশের সুরে বসতে বল্লো। আমার বউও বসে পড়লো। আমি বল্লাম এখানে বসতে হবে কেন? আমাদের গাইড বল্লো মাজারে যাবেন, গিলাফ কিনবেন না? ছোট একটা কিনে নেন। আমি বল্লাম না, আমি ওসব কিছু কিনবো না। আপনি চলেন। সে বল্লো মাজারে খালি হাতে যাবা? আমি বল্লাম হ্যা ! এই চাদর বা গিলাফ দিয়ে মাজারের কি উপকার হবে? ওটা তো আবার এই বিক্রেতার কাছেই ফেরৎ আসবে।
আমার কথায় বেচারা ব্যাথিত হলো কিনা জানিনা, সে মাজারের কাছে এসে আমাদেরকে বল্লো আপনারা মাজার জেয়ারত করেন, বুলান্দারওয়াজা দেখেন, আমাকে বিদায় দেন। আমি ঐ আগের গাইডের টাকাটা ওনার হাতে দিয়ে দিলাম। তখন সে বল্লো আমাকেও ঐ একই পরিমান টাকা দিন। আমি তখন আকাশ থেকে পড়লাম। মানে? আপনাকে কেন টাকা দিবো? আমি তো ঐ গাইডের সাথে আগেই চুক্তি করেছি ফতেহপুর আর সিক্রী দুটি মিলিয়েই ওনাকে টাকা দিবো। এখন সে আপনাকে এনগেজ করলে, তার খরচ আমি কেন দিবো? আমি এবার হিন্দী ছেড়ে ইংরেজি ধরলাম। মেজাজ গরম হলে কেন জানি মুখে ইংরেজি আসে! সে এবার বল্লো তাহলে ৫০ টাকা দেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। দিয়ে ওনাকে বিদায় করলাম।
(হযরত সেলিম চিশ্তি (রহঃ) এঁর মাজার)
তারপর মাজারের সামনে চৌবাচ্চায় হিম শীতল পানি দিয়ে অজু করে ঢুকলাম হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এর মাজারে। লাইন ধরে ধীর গতিতে সবাই ঢুকছে। আমরাও সবাই ঢুকলাম। জিয়ারত করে বের হয়ে আসলাম। ওনার মাজারের পাশেই রয়েছে মসজিদ। জোহরের নামাজটা আদায় করলাম ঐ মসজিদে। বালাজির কবর খুজতে গিয়ে মসজিদের পিছনে রগলাম। কিন্তু পরিবেশটা খুব একটা ভালো লাগলো না বিধায় এগোলাম না।
ওখান থেকে বুলান্দারওয়াজার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিশাল উচু সেই দরজা। এতো বড় গেট আমি জীবনেও দেখিনি।
এবার এখান থেকে বের হবার পালা। দুপুরে কিছু খাইওনি। খেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ ....... ! যেই দরজার দিয়ে ঢুকেছি, সেই দরজা দিয়েই বের হওয়ার জন্য এগোলাম। কারণ ওখানে স্যান্ডেল জুতা সব খুলে রাখতে হয়েছে। স্যান্ডেল জুতা কালেকশন করে বের হতেই আবার আনসারী ভাইদের সাথে দেখা হলো। ওখান থেকে এগিয়ে এসে যেখানে বাস থেকে নেমেছিলাম সেখানে আসলাম। বাস ধরে আবার নেমে এলাম প্রথম পার্কিং এর ষ্টপেজে। ওখানে একটি খাবারের দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে রামজির গাড়িতে উঠলাম। তখন বাজে প্রায় তিনটা। আমাদের এবারের গন্তব্য সোজা আজমির শরীফ। ......
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৪৫