০১
আমি কারো ভিতর থাকি কিনা, আজকাল আর নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কিন্তু আমার ভিতর অনেকেই থাকে। শ্রাবনে-চৈত্রে, জোসনায়-বৃষ্টিতে, শিউলী-কদমে আর অমাবস্যা-পূর্ণিমায় মিলে- মিশে বেশ আছে তারা। এক টুকরো কথা, এক চিলতে স্মৃতি, এক কলি সুর কিংবা এক মাত্রা ছন্দ এক পলকেই তাদের এক এক জনকে ভিতর থেকে টেনে এনে পাঠিয়ে দেয় ভাবনার অলিন্দে... অপাংক্তেয় মস্তিষ্কের নিওরোনে। আমার নির্লিপ্ততা তাতে আরও বাড়ে। আমার পথ চলার গতি আরও খানিকটা দ্রুত হয়...!
তারও পরে আরো অনেক অনেক বিষণ্ণ বিকেল আমি ‘সুখছড়ি’-র ঘাস বিছানো স্বপ্নমাখা পথে একলা হেঁটে পার করে দিয়েছি। ঘাসফুলগুলো মাথা উঁচু করে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছে আমার একাকীত্ব। আমায় তারা শুধোয় নি কিছুই। কিন্তু একে অপরের কানে ফিসফিসিয়ে বলে গেছেঃ ‘ও একা কেন?’ তাদের সেই ভাষাহীন জিজ্ঞাসার আকুলতা আমি অনুভব করেছি আপনমনে বয়ে চলা মলয়ানিলে-র মমতায়, নিশ্চুপ চেয়ে থাকা ঘনবিথী-র নীরবতায় আর নীলকমলের স্নেহমাখা পবিত্র পরিশুদ্ধ ছায়ায়।
তারপর আকাশজোড়া মেঘ। তারপর দিগন্ত ঘেরা কুজ্ঝটিকা। তারপর অবিমিশ্র চরাচরের শেষ প্রাণীটারও গৃহে প্রত্যাবর্তন। তারপর রিমঝিম বর্ষা আর ছাতিমের পাতায় নিঃসঙ্গতার একটানা বাজনা নিয়ে একলা আমার পরাজিত পথচলা...!
এভাবেই...বিষণ্ণ বিকেলের করুণ শুন্যতা পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায় বেদনার বিবর্ণ সৈকতে...!
০২
অনাগত সময়ের বিপন্ন অস্থিরতায় শ্যাওলা জমছে বিচ্ছেদের ‘মানবিক’ কিংবা ‘প্রায়-মানবিক’ দেয়ালে। ভাবনার আকাশে অস্তায়মান সূর্যের ম্লান কালিমায় শুনি নিশাচরদের উষ্ণ পাখার উল্লসিত ঝটফটানি। নিজে কে মনে হয় ঝড়ো হাওয়ায় উড়তে থাকা একটি লাওয়ারিশ ছিন্নপত্র। ক্ষণিকের সুখ আর প্রশান্তিও এই সময়ে বড্ড দামী হয়ে গেছে। কেনার সামর্থ্য হারিয়ে আমি তাই কান পেতে শুনে যাই ঝড়ের হু-হুঙ্কার। আর ভাবার চেষ্টা করিঃ ‘সুখ জিনিষটা আসলে মেলে কোথায়?’
স্বপ্নের চারপাশে দেয়াল উঠে গেলে মানুষ নাকি আত্মঘাতী হয়। নিজেই নিজেকে মেরে ফেলে। আমি তাহলে এখনো কেন বেঁচে আছি?
সমস্যাটা হল, তাকে আমার যখন-তখন মনে পড়লেও তার যে আমাকে মনে পড়ে না! আমি তাকে যতই ভাবি, সে যে আমাকে ভাবে না...! সমাজ-সংসার নিয়ে তার আনন্দময় ব্যস্ততার মগ্ন-চিত্র বিষণ্ণতায় ঢেকে দেয় আমার নিদ্রাহীন নিশিগুলো।
একটা ভীষণ অবসাদ, অবোধ্য শূন্যতা, নির্লিপ্ত পরাজয় আর অন্তহীন “না থাকা”-কে সঙ্গে করে আমি তাই প্রতিটি ভোরে ঘুমাতে যাই...!
০৩
পথে পথে দারুন অসুখ। অকথ্য আলোর অশোভন ঝলকানিতে অস্বস্তিতে ঘেমে যাই আমি ‘রাতমজুর’। নিরন্তর চলমান পদযুগলে অচঞ্চল ক্লান্তিহীনতা। দু’আঙ্গুলের ফাঁকে ঝুলে থাকে জলন্ত নিকোটিন কিংবা দু’নম্বর গঞ্জিকাঠি। এক নম্বর আজকাল...আর সবকিছুর মতই, দুষ্প্রাপ্য। খুঁজে বের করতেই পার হয়ে যায় আধাবেলা। অত সময় আর ধৈর্য কই? ভাবনার বর্ণমালার বর্ণসকল বদলে গেছে অচেনা সব সংকেতে। যেন ‘হায়রোগ্লিফিক্স’! প্রাচীন, দুর্বোধ্য আর নিষ্ঠুর।
ভুল জলে সাঁতার শিখতে গেলে শেষতক জীবন বুঝি এমনই হয়...!
তবু আমি হাঁটি। চারপাশের নিঃসীম আঁধার আমার অভ্যস্ত পথচলায় আড়াল তুলতে পারে না। কোন এক ক্ষমাহীন রুপসীর ‘সচেতন’ অসতর্কতায় একদা ঝরে পড়া খানিক ভালোবাসার হিরণ্ময় প্রভায় কাটে আমার আজন্ম অন্ধকার। ভাবনাহীন পা ফেলে আমি তাড়া করি পলাতক জীবন-টাকে। মৃত স্বপ্নকুলের গলিত শবদেহ সরিয়ে খুঁজে বের করি চলার পথ। আমার আনন্দময় অট্টহাসিতে শিউরে উঠে অশালীন সভ্যতার ঘুনে ধরা প্রাচীর। ভয় পেয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয় আমার সহিংস চলার পথ থেকে।
আমি হাসি। আমি হাঁটি।
আমি হাঁটি। আমি হাসি।
০৪
“এলোমেলো মানে যে আসলে কি? কতটা ‘অগোছালো’ হলে পরে তাকে ‘এলোমেলো’ বলা যায়, তোমাকে না দেখলে সেটা আমার বোঝা হত না...।”
প্রায় ‘ডাস্টবিনে’ পরিনত হওয়া আমার চার দেয়ালের দরজায় দাঁড়িয়ে হতাশ গলায় বলছিলে তুমি। মাথা নিচু করে আমি শুনছিলাম তোমার আক্ষেপ।কণ্ঠের উত্থান-পতন থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিলাম অভিমান,রাগ,মমতা ইত্যাদি সব স্বতন্ত্র মানবিক অনুভূতি কে। নিজস্বতা হারিয়ে যেগুলো আত্মাহুতি দিয়ে গেছে তোমার কণ্ঠে। শুধু এই-ই নয়! সেখানে আরও ছিল ছন্দ, সুর, ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
“রাতের বেলা একলা এখন জিরোচ্ছে সব শহরতলী
চোখ দুটো খুব পড়ছে মনে, এই কথাটা কেমনে বলি।”
অর্ণবের গাওয়াটায় সুরের খুব মাতামাতি নেই। আপনমনে কেমন ছাড়া ছাড়া ভাবে গেয়ে যাচ্ছে। আর সেটাই গিয়ে লাগছে বুকের সেই গহন কুঠুরিতে, যেখানে সযত্নে লুকিয়ে থেকে চাপা কৌতুকে হাসছে সেই একজোড়া চোখ ... যেগুলো খুব করে মনে পড়লেও আমি বলতে পারি না কাউকে। আর,যেগুলো দেখার তৃষ্ণা আমার এক জনমে মিটবে না।
০৫
তুমি মনে আসছো। সেতো আর নতুন কিছু নয়। আমার শুন্য মনে তোমার নিত্য আসা-যাওয়া। প্রতিক্ষণই তুমি আছো আমার অনুভবে-অস্তিত্তে। কিন্তু এখন, কিছুটা সময় কি ধার দেবে আমায়? আমি একটুখানি ঘুমাতে চাই। অনেক নির্ঘুম রাতের ঘুম জমে আছে আমার নির্লিপ্ত-নিমীলিত এই দু'চোখের আবডালে। খানিকটা সময় পেলে ঘুমিয়ে নিতাম।
দেবে আমায় কিছুটা সময়? একটু ঘুমাতাম... !!!