০১.
তুমি কথা বলতে, আমি শুনতাম। আমি শুধুই শুনতাম। কেবল শুনেই যে কেউ এত খুশী থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। আমার অবশ্য সবই ছিল অজানা। এটা বুঝেছি তোমাকে চেনার পর। তুমি আপন মনেই কথা বলে যেতে, আমি শুনতাম। যাই শুনতাম, মনে হতো প্রথম শুনেছি। আগে কেন শুনি নি, সে আক্ষেপ আমায় নাড়া দিতো না।
আমি জানি, তোমার কাছ থেকে শুনবো বলেই আমার আগে শোনা হয় নি।
০২.
:"আচ্ছা, ডাহুকের গলার কাছটা যে খানিকটা খয়েরী, জানো?" নিজের নখ দেখতে দেখতে আচমকা বলেছিলে একদিন।
ডাহুক আমি চিনতাম একরকম। কিন্তু খয়েরী রং কোনটাকে বলে, জানা ছিলনা। বরাবরের মত ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লাম। তুমি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখো নি আমার মাথা নাড়ানো। তার দরকারও নেই। তুমি জানতে,আমি কিছুই পারি না। নিজে নিজেই বললেঃ জানবে কিভাবে? তুমিতো চেনো কেবল সাদা আর কালো।
খয়েরী রং-টা পরে একদিন আমাকে চিনিয়ে দেবে, অনেক মনযোগ দিয়ে নখ দেখতে দেখতে তুমি বলেছিলে। আরো অনেক আশ্বাস, কিংবা কেবলই 'কথার কথা'-র সাথে এটাকে ও আমি যত্ন করে মনে রেখেছি।
খয়েরী রংটা আমার আর চেনা হয়ে উঠে নি।
তোমার হাতের কিংবা পায়ের একটি নখ হতে সেদিন খুব ইচ্ছে করেছিল।
আজো করে।
০৩.
:"তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না"! এই বলে তুমি চলে গেলে। তোমার চোখে ছিল অবাক করা মেঘলা বিষণ্ণতা আর খেয়ালী অভিমান।
তার পর বৃষ্টি শুরু হল। স্বর্গ-নদী "মন্দার" থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হাজার হীরের টুকরার মত আছড়ে পড়ছিল আমার চারপাশের মাটিতে-ঘাসে-আর পাথরে। ভিজতে ভিজতে আমি ভাবতে থাকি, আমি জপতে থাকি "আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।"
এ কথা আমি তোমার মুখে শুনেছি অযুতবার, কিংবা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী। তুমি বলেছো বলে, কিংবা তোমার মুখে শুনে শুনে আমি ও বিশ্বাস করি, "আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।"
তার ও পরে আমি সতেজ কিংবা বিষন্ন শিশিরে খালি পা ফেলে ফেলে হেঁটে যাই। আমি একা। অবশ্য নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের অন্য নাম যদি "তুমি" হয়, তাহলে তুমি আমার সাথেই আছো। আমার সাথেই থাকো।
০৪.
দু'হাত ভরে শিউলী নিয়ে কুয়াশার্ত কার্তিকের এক ছয়-সকালে তোমার দুয়ারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেবীর কাঠগড়ায় পূজারীর মত। চোখে প্রশ্ন আর বিরক্তি নিয়ে তাকিয়েছিলে তুমি। তোমার চাহনির তীব্রতায় ম্লান হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আমি আর শিউলীরা।
সেই ঝরে পড়া শিউলীগুলোকে আর একবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে কোথায় যেন বেঁধেছিল খুব। পারিনি। বুকের কাছটায় করে ফিরিয়ে এনে রেখে দিয়েছিলুম।
মধ্য শ্রাবনের সেই সজল দিনান্তে, বৃষ্টিরা যখন তোমার বাড়ীর সামনে খুব হৈ-চৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো…. হঠাৎ খুঁজে পাওয়া তিনটে কেবল কদম নিয়ে আমি গিয়েছিলাম তোমায় দেখতে।
তুমি চাদর মুড়ি দিয়ে তোমার বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিলে। তারপর যখন মূর্তিমান দূর্ভাগ্যের মত আমার উপর তোমার চোখ পড়ল, খানিক তাকিয়ে থেকে তুমি নীচে নেমে এলে। তোমার হাতে ছিল সেই সাদা তোয়ালেটা, স্নানের পর যেটা তুমি জলস্নাত অলক গুচ্ছে জড়িয়ে রাখ। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেঃ "মাথা মোছো।"
দেবীর বাড়িয়ে দেয়া প্রসাদের মত করে আমি নিলাম।
মাথা মোছা হয় নি। বুভুক্ষুর মত মুখের উপর চেপে ধরে রেখেছিলাম তোয়ালেটাকে।
তুমি তাকিয়ে দেখলে।
তুমি তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভেজা গলায় বলেছিলে "কেন এমন করো?"
তার পর যখন আমি আবার পথে নামলাম, ততক্ষনে আমার সবটুকু অতীত বর্তমান-আর ভবিষ্যত সেই একটুকু বাক্যের মধ্যে লীন হয়ে গেছে। নায়াগ্রার গর্জন আর অতলান্তিকের গভীরতা নিয়ে বুকের ভেতর আজো বেজে যাচ্ছে 'কেন এমন করো?'
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১:২৬