০১
আমার সব পছন্দই তোমার কাছে প্রশ্ন বিদ্ধ। কথার পিঠে কথা গেঁথে গেঁথে খুব সহজেই তুমি বুঝিয়ে দাও, “আমার পছন্দ কোন পছন্দই না।” আমি চুপ করে শুনি। তারপর একসময় অবাক হয়ে দেখি, “তোমার মোটেও ভালো না লাগা আমার সেই ‘পছন্দ’-গুলোই কিভাবে কিভাবে যেন তোমার পছন্দে বদলে গেছে।”
“এখন তুমি কোথায়?”, “কটা বাজে? এখনও বাসায় যাওনি কেন?”, “আচ্ছা,তুমি কবে মানুষ হবা?”, “এত বেলা করে ঘুম থেকে জাগো কেন?”, “বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি একদম ভাল লাগে না”, “আমার জোনাকের মালা কই?”, “আজকে ভাবীর সাথে ফুচকা খেতে গিয়েছিলাম”, “শিমু বললঃ সেদিন তোমাকে দেখেছে ভর দুপুরে ছন্নছাড়ার মত রাস্তায় হাঁটছিলে, মাথা নীচু করে। কেন?”...
এমন অসংখ্য কথা সে বলে যেত। আমি চুপিচুপি শুনতাম। এতগুলো ‘কেন’-র উত্তর আমার কাছে নেই। তারপরও শুনতেই থাকতাম। তার গলার স্বরের উত্থান-পতন আমাকে বুঝিয়ে দিত, হৃদয় গহীনের অচেনা সব অনুভূতির কথা। রাগ-অভিমান-মমতা আর ভালোবাসার কুসুমিত গন্ধ আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াত।
তুমি ভাল থেকো।
০২
সমস্যা টা হল, সেও আমার জন্য কষ্ট পায়। অথচ কোনভাবেই টা প্রকাশ করতে চায়না। ভয়...! আমার কষ্ট যদি তাতে আরও বাড়ে...!
এইসব নিয়ে কথা বলতে আর ভাল লাগেনা। তারপর আমি খালি পায়ে হিম শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাই। তখনও ছয় সকাল। কার্ত্তিক খুড়োদের শিউলি গাছটার নীচে রাতভর ঝরে পড়া শিউলিরা পুজারীর প্রতীক্ষায়। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। আমি তিনটে কিংবা একটা কিংবা একমুঠো ফুল ধুলো থেকে তুলে নিয়ে ঠোঁটে স্পর্শ করি। আমার চোখ ভিজে যায়। কম্বলের আরাম- উষ্ণতায় লুকিয়ে রাখা তোমার কোমল চরণদ্বয় আমি দেখতে পাই না। না দেখেই সেই চরন যুগলে আমি উৎসর্গ করি পৃথিবীর সবকটি শিউলি।
ভোরের বাতাসে এলোমেলো উড়তে থাকে এলোমেলো চুল। চশমার কাঁচে কুয়াশার বাসা। ঝাপসা রাস্তায় আমি পা ফেলতে থাকি চেনা আগন্তুক। আমি হাঁটতে থাকি। আমি হাঁটতেই থাকি।
আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ...!
০৩
কিছু কথা কখনই বলা হয়ে উঠে না। সেইসব না বলা কথা পৃথিবীর আলো-বাতাসে শ্বাস নিতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠে। আমি তাদের বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি। পরাবাস্তব কল্পনার অন্ধকারে তারা আরও ডুবে যায়।
কবিতা মানুষকে কি কি দেয়, জানিনা। তবে জীবনটা কে শুষে নেয়। যে একবার এর পাল্লায় পা দিয়েছে, সেই বোঝে। পথহারা পথিকের মত তখন কেবলই হাতড়ে বেড়ানো... অক্ষর, ছন্দ আর ভাষা। কবির বেদনা কেবল কবিই বোঝে।
আমার এইসব কথা শোনার জন্য সে বসে থাকেনা।
আমার এইসব কথার কোন অর্থও তার কাছে নেই।
সপ্নান্ধ হৃদয়ে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতিদের রং সে দেখেনা।
কল্পনার লাল হিজলের কথা শুনে সে হাই তোলে।
অন্ধকারের বুকে জোনাকির মেলার চেয়ে চেনা শহরের চেনা নিয়নসাইন তার বেশী প্রিয়।
টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দে তার মাথা ধরে।
পথের ধারে অবহেলায় ফুটে থাকা ‘ঘাস ফুল’ তার চোখে ‘সস্তা’ আর ‘ক্লাস লেস’।
এই-ই আমাদের জীবন।
সভ্যতার বর্বর অসভ্যতা খুব সহজেই পারে প্রিয়জন কে ছিনিয়ে নিতে। সেইসব আজ আমার কাছে ধুসর পাণ্ডুলিপি। তারপরও আমি ঠিকই বেঁচে আছি।
একটি সূর্যমুখী ফুল-রং দিনের প্রতীক্ষায় এই বেঁচে থাকা...।
০৪
একদিন তাকে বলেছিলামঃ “আমাকে যদি আরও ১৬০০ জীবন দেয়া হয়, আমি সবগুলো জীবনেই কেবল তোমার আশে-পাশে থাকতে পারার বর চেয়ে নিয়ে আসব।”
এটা একটা সত্যি কথা। সাহস করে বলে ফেলেছিলাম। তুমি শুনলে। খানিক চুপ করে থাকলে। ঠোঁট বাঁকিয়েছিলে কিনা, দেখিনি। তুমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলে, তাই দেখিনি। কিংবা, আমি মাথা নিচু করে ঘাস গুনছিলাম, তাই দেখিনি। তারপর কথা বললে। কি বললে?! একটা সত্য কথা। একটা নির্জলা স্বীকারোক্তি।
“আমার আর কোন জীবন দরকার নেই। এক জীবনেই ১৬০০ জীবনের সমান ত্যক্ত হয়ে গেছি।”
আমি তার সামনে থেকে সরে আসি। অবাক সুন্দর চোখ তুলে সে আমার চলে যাওয়া দেখে। সে তখন যেন হিরণ্ময় রুপকথা। তারপর সেও চলে যায়।
রয়ে যায় মেঘলা আকাশ, একলা শালিক, কোমল ঘাস আর বিষণ্ণ বিকেল...।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৩:০৪