বড় আপা আমার মাথায় তেল দিয়ে দুই বেণী করে কলার মত দুই পাশে বেঁধে দিয়ে বলছে, আগামীকাল স্কুল বন্ধ। বেনী বাইন্ধা দিলাম, আগামীকাল একেবারে গোসলের সময় বেণী খুলে দিব ঠিক আছে। শৈশবের এই আমি মাথা নেড়ে বলছি আচ্ছা।!বড় আপার আবারও হুশিয়ারী, ” আর শোন ! তুই কিন্তু এখন পুকুর ঘাটে নৌকায় বসবি না-নৌকা চালাবি না। আমাদের বাড়ির মেয়েদের অনেক কিছু করতে মানা। কাকা কিন্তু একদম এসব পছন্দ করে না। মনে থাকব ”। খুব ভাল এই আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছি। আগামীকালের স্কুল ছুটিতে মন ভাসছে খুশিতে-আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। নৌকা যেন আমায় ডাকছে-কিসের নিষেধ আর কিসের কি !
:
কৈশর বিকাল। আমি ধীর পায়ে চলে আসি পুকুর ঘাটে। ছোট নৌকাখানি পুকুর ঘাটে বাঁধা। চারদিকে শুনশান নীরবতা। নৌকায় উঠে বসি। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। আকাশে হালকা মেঘ হেলেদুলে যেন আমাকেই স্বাগত জানাচ্ছে। নৌকা ছেড়ে বৈঠা হাতে নেই। বৈঠা মাঠিতে ঠেলা দিয়ে নৌকাকে ঘাট হতে পানির দিকে ঠৈলে দেই। চারিদিকে দেখে নেই কাকা আর আব্বা আছে কিনা। ওহ্! কেউ কোথাও নেই—আমিই রাজা, আমার রাজার রাজত্বে আর কেউ নেই—আমি পানিতে বৈঠা চালাচ্ছি। নাও চলছে হেলেদুলে।চারিদিকে নিরবতার মাঝে বৈঠা আর পানির শব্দে যেন ছপ ছপ আওয়াজ হচ্ছে।পুকুর পাড়ের অড়হড় গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে পানিতে।বৈঠার পরশ পেয়ে পানিতে ছোট ছোট ঢেউ তৈরি হচ্ছে আর তা হাটি হাটি পা পা করে অড়হড় গাছকে গিয়ে ছুঁইয়ে দিচ্ছে। আরো জোরে বৈঠা চালালাম। পুকুর চক্কর দিয়ে নৌকা বেড় করে দিলাম পুকুরের পাশের ধানের জমিতে-।
:
রসিয়া গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমার প্রিন্টের ফ্রক ভিজে যাচ্ছে। আপার বেঁধে দেয়া কলা বেনীতে বৃষ্টি পড়ছে। আমার দৃষ্টি ফুটে থাকা শাপলা ফুলে। নৌকার গতি কমিয়ে শাপলার ফুলে টান দিয়ে শাপলা নৌকায় তুলছি। ধানের ক্ষেত পেরিয়ে এবার সোজা পানির রাজ্যে—যেখানে কয়েকদিন আগেও ছিল পাট গাছে ভরা ক্ষেত। এখন পানি, বাতাস আর ঢেউয়ে ছড়াছড়ি। আমি বৈঠা বাই আর পানির মৃদ নাচন দেখি। রাস্তায় ছেলেরা একজায়গায় জড়ো হয়েছে। একটা ছেলে আগ বাড়িয়ে বলছে আরে ও লায়লা ! আমারে নাওয়ে নে- আমি নাও বাইয়া দিমু”। আমি বৈঠা উঁচু করে বলি, আমার নায়ে কাউরেই নিমু না।” ওদিকে আমার বয়সী কিছু মেয়ে জড়ো হয়ে আমার দিকে হাত তুলে ডাকছে- ওরে ও লায়লা! আমাগো নিয়া যা, আমরা কিন্তু কাউরেই কমু না।” আমি আবার বৈঠা নাড়িয়ে বলি ’’আমি একলাই নাও বামু-কাউরেই আমার নায়ে উঠামু না”। এবার এ বাড়ির বউ-ও বাড়ির বউ উঁকি মারে। তারা বাড়ির সামনে বেড়িয়ে বলে, ওমা ! কোন বাড়ির মাইয়া তুমি। আর তুমি নাও বাইতেছো। হায় হায় ! এইডা কি যুগ পড়ছে গো মা। আমার বৈঠায় এবার বাতাসের নাচন। আমার নাও আর আমার বৈঠা এখন আমার কাছে সবচেয়ে দামী-।আকাশে ছেয়ে আছে কালো মেঘ- আর সেই মেঘ হতে চুইয়ে বৃষ্টি পড়ছে পানিতে ভেসে থাকা ধান গাছে আর আমার কলা বেনীতে।আমার বৈঠা পানি কেটে কেটে চলছে সামনে-
:
আকাশে কালো মেঘগুলো বড় বড় ফোঁটা হয়ে আমাকে আর নৌকাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় ছেলেগুলোর আর বাড়ি যাওয়ার খবর নেই। পাড়ার বৌদেরও আর ঘরে যাওয়ার সময় নেই-।তারা ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।তারা আমার শেষ পরিণতি দেখার অপেক্ষার খুশিতে ভিজছে । আর আমি ভিজছি নৌকা বাওয়ার খুশিতে। গ্রামের বৌয়েরা হয়তো এতক্ষণ মায়ের কানে কানপড়া দিয়েছে কিনা কে জানে। কে কি বললো আমার তাতে কি আসে যায়—
:
পুকুরের গাছের ফাঁক দিয়ে নীল শাড়িতে কেউ হেটে আসছে। ধীরলয়ে আরো এগিয়ে আসছে কাছে। একেবারে পুকুরের চালার শেষ সীমানায় এসে স্থির হয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো। আমি আমার বৈঠা নৌকার উপরে উঠিয়ে পা মেলে বসলাম-বাতাসে ইচ্ছেমত হেলে দুলে নৌকা চলছে--। আবার নীল শাড়ি পড়া নারী আমায় হাত ইশারা করে ডাকছে। ভয়ে আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে। যদি প্যাদানী দেয় তো আমি শেষ। এবার বড় আপার কথাখানি খু-উ-ব মনে পড়ছে। যদি কাচা কনচি দিয়ে মারে তো আমার সাড়া শরীর ফুটে যাবে-আমি ব্যাথায় আর স্কুলে যেতে পারবো না। ধীর লয়ে ঘার ঘুরিযে গ্রামের বৌদের দেখছি। এবার ওদের সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে দেখলাম। মনে মনে ভাবসি তোমরাই সবচেয়ে দুষ্ট। দূরের ছেলেগুলো গলা ফাটিয়ে বলছে” আরে নৌকা বেয়ে তোর মায়ের কাছে যা-এবার তোর পিঠে কিছু কিল-ঘুষি পড়বে—হা হা হা। দুইজন একই সাথে সুর করে বলছে-
ওই ছেড়ি !
তোর খুব ফুটানী
তুই খাবি ঝাকানী
মা দিব পিটানী
কাকা দিব প্যাদানী
বাপে দিব আছড়ানী
:
ওদের কথায় আমার জিদ বেড়ে গেল। আমি আবার অলস ভঙ্গিয়ে নৌকা বাইছি। আবার শাপলা তুলছি। পুকুরের পাড় হতে এবার ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম । কেমন যেন একটা ভরসা পেয়ে ধীরে বৈঠা বেয়ে পুকুরের পানিতে নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। মা আর বড় আপা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের হাতে কাচা কনচির লাঠি। উপর হতে মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি এখন আসামীর কাঠগড়ায়। নাও এবার ঘাটে ভিড়িয়ে দিলাম। আমি নেমে আসলাম মাটিতে-পানিতে আমার সোনার নাও আর পবনের বৈঠা পুকুরের পানিতে ভাসছে-। ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিলাম-চোখ দিয়ে ঝর্ণাধারা গড়িয়ে পড়ছে। ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আরে লায়লা ! তুই এত সুন্দর নৌকা বাইতে পারিস তা তো আগে জানতাম না। আমার শরীরকে জড়িয়ে ধরেছে বড় ভাই আর বড় আপা। আমার ফুপানো কান্নায় আশে পাশের বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। মা কাঁচা কঞ্চি পানিতে ফেলে দিয়ে তর্জন গর্জন করতে করতে কাঠ আর টিন দিয়ে তৈরি দোতালা ঘরে প্রবেশ করলো। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি আমার কষ্টগুলোকে ধুয়ে পুকুরের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলছে।
:
লায়লা, ০১ জুলাই, ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২৪ সকাল ১১:১৮