সমস্ত দিন ধরে অকৃপণভাবে আলো বিলিয়ে যাওয়া ক্লান্ত সূর্যটা গোধূলি বেলায়, যখন পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আয়োজন করে, তখনও সূর্যটা শেষবারের মতো আকাশ প্রকৃতিকে নিয়ে এক অপরুপ বর্ণিল খেলায় মেতে ওঠে।গোধূলি বেলার এই রক্তিম সূর্যটা যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে মিলিয়ে যায়, তখন শিমুর মনে এক অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি কাজ করে।সেই অনুভূতিতে কিছুটা ভালোলাগা; খানিকটা বিষন্নতা জড়িয়ে থাকে।আবদ্ধ ঘরের উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে শিমু আনমনে বসে প্রতিটা সাঁজের বেলা উপভোগ করে।কখনও কখনও গাছের পাতার আঁড়াল ভেদ করে পড়ন্ত বিকেলের লাল রঙা সূর্যটা শিমুকে কিছুটা রাঙ্গিয়ে দিয়ে যায়।শিমুর খুব ইচ্ছে করে এই সময়টাতে কোন এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল উড়াতে।সেই কত বছর আগের কোন এক বিবর্ণ গোধূলির কাছে শিমুর সকল স্বপ্ন, চাওয়া, পাওয়া গুলো প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হয়।এই বুবু, বুবু! তুই এখনও সেই একইভাবে বসে আছিস? শিমুর ছোট বোন ঝুমুর ডাকে শিমু চমকে ফিরে তাকাল।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অথচ ঘরের বাতিটা পর্যন্ত অন করিসনি।আমার একদম ভালো লাগছে না; এটা আবার কেমন বিয়ে! সানাাই বাজবে না; গায়ে হলুদ হবে না; কনে বধুবেশে সাজবে না।বর আসবে চুপিচুপি; কোন প্রতিবেশী পর্যন্ত জানবে না।অদ্ভুত! ছেলেপক্ষ তো তোর ব্যাপারে সবকিছু জানেই; তাহলে এত ডাক গুড় গুড় কিসের।মায়ের যত্তসব আজাইরা চিন্তা।বিয়েটা যতক্ষণ অবধি না হচ্ছে; মায়ের দুশ্চিন্তা নাকি কিছুতেই দূর হচ্ছে না।যদি প্রতিবারের মতো এবারও বিয়েটা ভেঙে যায়।তোর বিয়ে নিয়ে আমার কত রকমের পরিকল্পনা ছিলো।আমার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করবো।সব পরিকল্পনা একবারে ভেস্তে গেল।আমি যাচ্ছি, ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে, মা তোকে ফ্রেশ হয়ে হালকা সাজগোজ করতে বলেছে।
শিমুদের বাড়ি থেকে সাত-আট মিনিটের পথ হাঁটলেই একটা বিশাল খোলা মাঠ।যেখানে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া পড়তেই হৈচৈ কলরব তুলে সন্ধ্যা অবধি খেলে।কৈশোরে শিমুও গাঁয়ের ছেলে- মেয়েদের সাথে সারাটা বিকেল জুড়ে খেলতো।সিমি, রিয়া, রাতুল ওরই সমবয়সী ওরা।একই ক্লাসে পড়তো।সিমি , রিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।রাতুল একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে।শিমুও এই বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছে।তারপরও ওকে নিয়ে মায়ের টেনশনের শেষ নেই।স্বামীর ঘরই নাকি মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।তাই যতক্ষণ না মেয়েকে কোন উপযুক্ত ঘরে পাত্রস্থ করতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত মায়ের শান্তি নেই।
ছেলেবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর গোসল খাওয়া দাওয়া শেষে দুপুরে ঘুম পড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করতো মা।কিন্তু শিমুর কিছুতেই ঘুম আসতো না।ওর মন পড়ে থাকতো গাঁয়ের খেলার মাঠে; কখন রিয়া, সিমিদের সাথে খেলবে।অবশেষে দুপুরের রোদের তেজ কমে বিকেলের ছায়া পড়তেই বিছানা ছেড়ে উঠাার ছুটি মিলতো।মা পই পই করে বলে দিতো সন্ধ্যা নামার খানিক আগেই সিমির সাথে একসাথে ঘরে ফিরবি।খবরদার দেরি করবি না।যা দিনকাল পড়েছে।একসাথে ঘরে ফিরবি; এই কথাটা মা সিমিকে ও অনেকবার বলেছে।
শিমু চল বাড়ি যায়; আজ আর খেলতে হবে না।
আর একটু থাকি।কিছুক্ষন পরে যাই।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।দেরি করলে তোর আম্মু বকা দিবে।
দ্যাখ সিমি সূর্যটা কেমন আস্তে আস্তে লাল হয়ে আসছে।সূর্য পুরোপুরি আকাশে মিলিয়ে গেলে তারপর বাড়ি যাবো।
তুই থাক, আমি গেলাম।
শিমু জলাশয়ের ধারে মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে।জলাশয়ের স্বচ্ছ পানিতে সূর্যের লাল রং খেলা করছে।সূর্য যখন পুরোপুরি মিলিয়ে গিয়ে প্রকৃতিতে সন্ধ্যার আলো-আঁধারী জড়ানো অন্ধকার নেমে এসেছে ঠিক তখনই শিমু বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে; সেই সময় গাঁয়ের দুইজন ছেলে ওর পথ আগলে দাঁড়ালো।তোমরা আমার সামনে এসে কেন দাঁড়িয়েছো? সরে যাও।আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।এমনিতেই আজ দেরি করে ফেলেছি; মায়ের কাছে বকুনি শুনতে হবে।দেরী যখন করেই ফেলেছিস, আর একটু দেরি করলে ক্ষতি কি? তারপরই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।যার জন্য বারো বছরের কিশোরী শিমু একেবারেই প্রস্তুত ছিলোনা।কিছুক্ষনের মধ্যেই শিমু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো।জ্ঞান ফিরে শিমু নিজেকে নিজের ঘরের বিছানায় আবিষ্কার করেছিলো।অশ্রসজল চোখে মা পাশে বসে আহত পাখির মত ছটফট করছিলো।
সেই রক্তিম গোধূলি বেলা শিমুর জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।আর কখনো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কোন গোধূলি বেলার সূর্য ডোবা দেখা হয়নি ওর।সেই সন্ধ্যায় ওর সাথে যে জঘন্য অপরাধ হয়েছিল; তার শাস্তি অপরাধীরা পায়নি, শাস্তি পেয়েছে শিমু জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৬