প্রভাতের রক্তিম সূর্যটা রাত্রিশেষের শিশিরার্দ্র অন্ধকারকে তখনো বিদায় জানায়নি।আবছা আলো আঁধারি জড়ানো অন্ধকারে ঘাটের একটি কাঠের বেদিতে এসে বসল অবন্তীকা ভৈরবের মৃদ্ ঢেউয়ের সাথে উঠে আসা এক ঝটকা শীতল বাতাস যেন মুহুর্তে তার ক্লান্ত শরীরকে শীতল পরশে জুড়িয়ে দিলো।পাখির পালক ঝরার মতন আঁধারকে বিলীন করে পূর্ব দিগন্তের উদিত সূর্যটা কোন এক অজানা জাদুমন্ত্রে আস্তে আস্তে সমগ্র পৃথিবীটাকে আলোয় ভরিয়ে তুলছে।নদীর পাড়ে ফুটে থাকা হালকা বেগুনী মিশ্রিত সাদা থোকা থোকা আকন্দ ফুলগুলো শিশিরে সিক্ত হয়ে আছে।
সান বাঁধানো নদীর ঘাট।নদী পার হয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই অবন্তীদের সেকেলে একতলা বাড়ি।নদীর ওই পারে বিস্তীর্ণ বালুচর আর শরৎ শুভ্র কাশবন।ভোরের মৃদু বাতাসে শরতের কাশফুলগুলো হেলেদুলে নদীর ঢেউয়ের সাথে যেন সমানে তাল মিলিয়ে চলেছে।ওই বিস্তীর্ণ নদী চর থেকে নিশুতি রাতে বেজে ওঠা বাঁশির সুর ভেসে যায় দূর থেকে দূরান্তে।
একবছর! ঠিক একবছর পর অবন্তী এই ঘাটে এসে বসল।কিন্তু ওর মনে হচ্ছে যেন পুরো এক যুগ পার হয়ে গেছে।অবন্তী যে বেদিটাতে বসে আছে,সেও বসে থাকে কখনও কখনও চোখে কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে।শেষ যেবার অবন্তী বাড়ি এসেছিলো তখনও দেখেছিলো-মনে হয় যেন কত পথ পাড়ি দেওয়া ক্লান্ত পথিক।
অবন্তী যে বাড়ি আসছে সেটা বাড়িতে কেউ জানেনা,জানলে এতকিছু ভাববার অবকাশই পেত না।আচমকাই অবন্তীর ভাবনায় ছেদ পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অনেক মানুষ ঘাটের দিকে আসছে।
আশ্চর্য! এতো সকালে কার লাশ নিয়ে আসছে ওরা।অবন্তী বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে....
সোহেল এগিয়ে এসে বলল," আপু আপনি!কেমন আছেন?"
ভালো।তোমরা কোথা থেকে আসলে ? ওটা কার লাশ?
হাসান ভাইয়ের।গত পরশু রাতে বন্ধুদের সাথে নদীর চরে যখন নেশায় মগ্ন ছিল তখন পুলিশের গুলিতে....
সোহেলের হাতে একটি বাঁশের বাঁশি।এই বাশিঁ যার তার সুর চিরদিনের জন্য থেমে গেল।আর কখনো সে তার সুরের জাদুতে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধ করবেনা।আর কখনো বেজে উঠবে না নিশুতি রাতে তার মোহন বাঁশির সুর।যে বাঁশির সুরে উত্তাল হতো অবন্তীর এলোমেলো মন।কিন্তু মানুষটা! মানুষটা কি কখনও তার মনের কোথাও কোন.....
একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় সোমা একদিন বলেছিলো,হাসান ভাই তোকে খুব পছন্দ করে।
অবন্তী চুপ করে ছিলো।তুই কিছু বলছিস না যে?
কি বলব?
হাসান ভাই নিজে তোকে কথাটা বলতে পারছে না তাই তার হয়ে আমি তোকে বলছি।কিছু তো বল!
বলার কি আছে।শুধুমাত্র সুন্দর চেহারা আর বংশমর্যাদা ছাড়া তার আর কি আছে?
কাউকে ভালোবাসতে হলে বুঝি আরও কিছু দরকার আছে?
জীবন আবেগ দিয়ে চলে না সোমা।তোমার হাসান ভাই তো স্বপ্নের রাজ্যে বাস করে।নিশুতি রাতে নদীর বালুচরে বাঁশি বাজিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।
তারপর থেকেই অবন্তী জানত নিশুতি রাতে নদীর বালুচর থেকে নিত্য যে সুর ভেসে আসতো সে একান্তই তার জন্য।
সোহেল বলল,"আপু নৌকা ছেড়ে দিবে,আপনী যাবেন না?"
তোমরা যাও ।আমি পরে আসছি।
শরৎ প্রভাতের সূর্যকিরন নদীর জলে পড়ে চিকচিক করছে।অবন্তী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:০২