মণিপুরি ধর্মে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া বিষয়টি হলো আপোকপা উপাসনা। এজন্য মণিপুরীদের আদিধর্মকে অনেকে 'আপোকপা ধর্ম' হিসাবেও চিনে থাকেন। আপোকপা শব্দটি এসেছে মণিপুরি মৈতৈ ভাষার 'পোকপা' শব্দ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘যিনি জন্ম দিয়েছেন’ বা ‘যার কাছ থেকে আমি সৃস্ট হয়েছি’। আদিধর্মে স্পস্ট ভাষায় পুর্বপুরুষকে দেবতা জ্ঞানে আরাধনা করার কথা বলা হয়েছে [১]।
মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি প্রাক-শ্রেনীসমাজে পৃথিবীর অনেক জাতির মধ্যেও পুর্বপুরুষকে দেবতা জ্ঞানে পুজা করার এই সংস্কৃতিটি (Ancestor Worship) প্রচলিত ছিল। বিষু বা বছরের শেষ দিনটিতে রাস্তায় পুর্বপুরুষের স্মরণে খাবারের ভোগ দেয়ার রীতিটির মুলে রয়েছে আপোকপা সংস্কৃতি। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের মধ্যে আপোকপা পুজা প্রায় অবশ্যকর্তব্য। গোষ্ঠি বা শিংলুপগুলো বছরে কমপক্ষে একবার হলেও আপোকপা পুজার আয়োজন করে থাকে। মণিপুরী পুরাণগুলোতে তিন ধরনের আপোকপার উল্লেখ পাওয়া যায়[২]-
ইমুঙপোকপা (Family Ancestors):
ঘরের আপোকপা। মৃত পুর্ব্বতন তিনপুরুষকে ইমুঙপোকপা বা গরর দৌ বলে ধরা হয়। সাধারনত নতুন ধান ঘরে তোলার সময় এর পুজা দেয়া হয়। পুজার উপকরন হচ্ছে চিনিমাখা খই, মুড়ি/চিড়া/তিলের তৈরী মোয়া, কলা, মিস্টিআলু, পেঁপে, কাঁঠাল ইত্যাদি।
সাগেইপোকপা (Group Ancestors):
গোষ্ঠির আপোকপা বা কুলদেবতা। কোন সাগেই/গোষ্ঠির পুর্বপুরুষকে ঐ গোষ্ঠির আপোকপা বলা হয়। গোষ্ঠিভেদে এরা ভিন্ন তাই, এক গোষ্ঠির আপোকপা পুজায় অন্য গোষ্ঠি অংশ নেয় না। সাধারনত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বড় পরিসরে কুলদেবতা আপোকপার পুজা হয়ে থাকে। পুজার উপকরন গোষ্ঠিভেদে নিরামিষ-ভাত, টাকিমাছ, শোলমাছ, বোয়ালমাছ ইত্যাদি।
য়েকপোকপা (Clan Ancerstor )
গোত্রের আপোকপা। মুলগোত্র বা আদিম কৌমদের ভিন্ন ভিন্ন আপোকপা রয়েছে। মণিপুরিদের সাতটি গোত্রের সাতজন ভিন্ন আপোকপা আছেন। যেমন- আঙম গোত্রের আপোকপা হলেন পুরেইরঙবা, লুয়াঙ গোত্রের আপোকপার নাম পৈরৈতন, খুমন গোত্রের থাঙগরেন ইত্যাদি [৩]। পুজার অন্যান্য উপকরন হলো ফুল, ধূপ, সরিষার দানা, চাল, চালের গুড়া, পানপাতা, সুপারি, মাটির কলস, কাপড়, তামার পয়সা ইত্যাদি।
আপোকপা উপাসনার মূল উদ্দেশ্য কেবল পুর্বপুরুষকে স্মরন নয়। এই সংস্কৃতি থেকে বুঝা যায় মনিপুরিরা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে থাকে। তাদের বিশ্বাস করে মানুষ মারা গেলে কেবল শরীরটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তার আত্মা বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পরেও পুর্বপুরষেরা কাছে কাছে থেকে আগের মতোই বংশধরদের প্রতিপালন ও রক্ষার দ্বায়িত্ব পালন করে চলেন। তাই দেবতা জ্ঞানে তাদেরকে উপাসনা করে তাদের সন্তুষ্টি বিধান করা সবারই দ্বায়িত্ব।
তথ্যনির্দেশ:
১. Saroj Nalini Parratt, Religion of Manipur, 1980. p 69
২. এন কুলচন্দ্র, আপোকপা থৌনিরল, ইম্ফল ১৯৩৭, পৃ ১৩
৩. T.C. Hudson, The Meitheis, Reprinted Edn 1989, p 100
আগের পর্বগুলো পড়ুন:
* মণিপুরি ধর্মের উৎস ও বিবর্তন
* বাংলাদেশের মণিপুরি সমাজ: তাদের আদিধর্ম ও ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি
পরবর্তী পর্ব: মণিপুরি মিথলজির দেবতারা
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:১৮