পৃথিবী যে কোনো ডুমুর ভাঙলে দেখা যাবে তার ভেতর থেকে কয়েকটা কালো ডানাওয়ালা পিঁপড়ের মতো পোকা হঠাৎ ছাড়া পেয়ে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে, লাফিয়ে উঠে যেখানে পারছে সেখানে পড়ছে। এরা বিভিন্ন ধরনের ওয়াস্প। ওয়াস্প ইংরেজি শব্দ। বোলতা ভিমরুলরাও এক-এক ধরনের ওয়াস্প, কিন্তু তারা থাকে একজোটে, বাসা বেঁধে। এ ওয়াস্পরা সবাই একা-একা। কী করছে এরা ডুমুরের ভেতর? আর ঢুকলই বা কী করে? কিন্তু ডুমুর ফল, না ফুল? আসলে দুটোই। ডুমুরের গোলাটাই সেই ফুল। গোড়ায় ফুল, বেড়ে উঠলে ফল। চারপাশ থেকে মুড়িয়ে ফুলের শরীরের যা কিছু সব সবজু আবরণীতে ঢেকে ফেলা হয়েছে। তার পুংকেশর, গর্ভকেশর সবই রয়েছে, সেগুলোকেই ভেতরে সরু কেশরের মতো দেখা যায় ফলটা ভেঙে নেয়ার পর। ফুল যখন আছে তখন পরাগমিলের কাজটাও তো করতে হবে কাউকে না কাউকে। সেই কাজের জন্যই আছে ওই ওয়াস্পগুলো, কিন্তু সিন্দুকবন্দি ফুলের কাছে তারা পৌঁছেবে কী করে? একটা ডুমুর নিয়ে একটু ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, তার মাথার কাছে, মানে বোটার উলটো বিন্দুতে রয়ে গেছে একটা অতিসূক্ষ্ম ছিদ্র। এটাই এই ওয়াস্পদের ফুলে ঢোকার পথ। কিন্তু ফুলের ভেতর তারা মধুর আশায় ঢোকেনি, ডুমুরের ফুলে সে বন্দোবস্তও নেই।
ওয়াস্পগুলো আসে গাছকে বোকা বানাতে, উলটো গাছ তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। গাছের বীজ বেশ পুষ্টিকর খাদ্য। মা-ওয়াস্পগুলো ডুমুরের গোলার মধ্যে ঢুকে কয়েকটা ফুলের ভেতর ডিম পাড়ে। নিজেরা আর বেরোতে পারে না অবশ্য, কিন্তু তার দরকারও তখন ফুরিয়ে গেছে- নিজের জীবনেও, গাছের জীবনেও। কারণ, অন্ধকার গোলার ভেতর ঘুরে ঘুরে ডিম পাড়তে গিয়ে মা ওয়াস্প ডুমুরের অনেক ফুলে পরাগমিলন ঘটিয়ে ফেলে নিজের অজান্তেই। কোথা থেকে এল ওই পরাগ। কেন? ওই মা ওয়াস্পটিও তো জন্মেছে কোনো ডুমুরের গোলার ভেতর। সেখান থেকে বেরোনোর সময়ই তো সে সঙ্গে এনেছে ওই গাছের পরাগ, ঠিক যেভাবে এই ডুমুরের ভেতর জন্ম নেয়া ওয়াস্প এখানকার পরাগ নিয়ে চলে যাবে অন্য ডুমুরে ডিম পাড়তে। পৃথিবীর সব ডুমুর কোনো না কোনো ধরনের ওয়াস্পের ওপর নির্ভর করে আসছে পরাগমিলনের জন্য। আর সেই ওয়াস্পগুলোও ডুমুরের ফলের ভেতর ছাড়া জন্মাতে পারে না। পরস্পর নির্ভরতার এ এক আশ্চর্য উদাহরণ।
কিন্তু যে কোনো ওয়াস্প যে কোনো ডুমুরে ঢুকতে পারে না। আগে জানা ছিল, একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির ডুমুরের সঙ্গে এভাবে জোট বেঁধেছে শুধু একটাই নির্দিষ্ট প্রজাতির ওয়াস্প। ২০০৩-এ আমেরিকার স্মিথসনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী ড্রুড মালবো আর তার সহকারী বিজ্ঞানীরা সেই ভুলটা ভেঙে দিলেন। তারা দেখলেন, ডুমুরগাছ অতটা কড়াভাবে পরাগমিলনের প্রার্থী বাছাই করেনি।
একই ডুমুরগাছে তারা যেমন কখনও দু’রকমের ওয়াস্প পেয়েছেন, তেমনই একই ওয়াস্প বেরিয়েছে অন্তত দুই প্রজাতির ডুমুর থেকে, এও দেখা গেল। কিন্তু তাতেও জুটি বাঁধার ব্যাপারটা খুব খাটো হয়ে যায় না। ডুমুরেরগাছে সকালের নাশতা সারতে আসে বসন্ত বৌরি, হরিয়াল, আসে বুলবুলি, কোকিল। তারা জানেও না, এ যে ফলটা তারা উদরসাৎ করছে, সেটা ‘কো-স্পন্সরড বাই...।’ হ্যাঁ, একটা অতি ছোট্ট প্রাণী যাকে আতশকাচ ছাড়া ভালোভাবে দেখাই যায় না। একটা জঙ্গলে যত ডুমুরগাছ আছে, তাতে পালা করে ঘুরে ফিরে ফল আসা জরুরি। কারণ সব ক’টা গাছে একবার ফল এসে গেলে একটা গাছ থেকে বেরিয়ে পরের প্রজন্মের ওয়াস্পগুলো ঢুকবে কোথায়?
আর তার ফলেই বছরভর কোনো না কোনো ডুমুরগাছে ফল থাকে। জঙ্গলের প্রাণীদের খিদে মেটানোর এ বরছজোড়া বন্দোবস্তের কারণেই ডুমুরগাছকে বিশেষ সম্পদ হিসেবে ধরা হয়। জঙ্গলের জীবনে তার আসন ভারি মর্যাদার। আমাদের দেশে কোনো বড় মানুষের তুলনা দেয়া হয় বটগাছের সঙ্গে। বট এক ধরনের ডুমুর আবার অশ্বত্থও। এভাবে বছরের পর বছর ডুমুরের গাছে কয়েকটা বীজের দখল নিতে আসে এক পোকা আর অন্ধকার বোকা বানিয়ে তাকে দিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছে গাছ। অথবা এক পক্ষ ছাড়া অপর পক্ষের বাঁচা অসম্ভব। সবচেয়ে পুরনো ঘনিষ্ঠতম এ সম্পর্কের বয়স কম করে আট-নয় কোটি বছর।
---সংগৃহীত