মা ঘরে ঢোকার এই সময়টায় বাবা কখনোই বাইরের ঘরে থাকবে না। শোবার ঘরের বারান্দায় বসে থাকবে, কিংবা বাথরুমে অযথাই সময় কাটাবে। টুক করে চাবি ঘুরিয়ে মা ঢুকবে ঘরে। আমি বসে থাকি বসার ঘরের সোফাতেই। কিন্তু আমাকে যেন দেখেও দেখবেনা। খুঁজবে পিচ্চিটাকে। টুকটুক করে সে হেঁটে বেড়ায় বাড়িজুড়ে। দেখতে পেলেই মা কোলে তুলে নেবে। দশ মিনিটের আগে ছাড়া পাবেনা বাবু। শুরুতে একটু না চেনার ভান করবে। হাঁচড়েপাচড়ে কোল থেকে নেমে যাবে। অনেকদিন পর পর তো দেখা মার সঙ্গে। কিন্তু একটু পরই মার ঘাড়ে মাথা গুঁজে দেবে। কানে কানে কত কথা। ওর সঙ্গেই তো যত কথা মার।
বাবা ওদিকে একটু অধৈর্য, বারান্দার চেয়ারটা নেড়েচেড়ে জানান দেয়ার চেষ্টা করবে। তবে লাভ নেই। মা এখন আমার পাশে এসে বসবে। বাবু ঘুরঘুর করতে থাকবে আশেপাশে। আমার সঙ্গেও কথা তেমন হবে না। চুলে একটু হাত বুলিয়ে দেবে। কী বলব মাকে, তার সঙ্গে চোখাচোখি যাতে না হয় সেই চেষ্টাই করতে থাকব।
হালকা ছাই একটা শাড়ি পরে এসেছে মা। নতুন কিনেছে। শরীফ কাকু কিনে দিয়েছে? জানিনা, জিজ্ঞেস করতেও পারব না। তবে শাড়িটা সুন্দর। আমিও পরতে পারব। চাওয়া তো হবে না, যদি নিজে থেকেই বলে। মা একটু শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। আবার চাকরি করছে বোধহয়। নানু ভাল আছে তো? কি জানি, ভাল লাগে না। জানতে ইচ্ছা করে, কিন্তু কী লাভ। খামোকা মায়া বাড়ানো।
আমার চুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে মা। ঠিক একবছর পর দেখা। মুখ দেখে মনে হল বলতে চাইছে, একদম যত্ন নিস না। চুল তো লম্বা হয়নি একটু। বলল না কিছু কী ভেবে যেন। বোধহয় ভাবছে সে কাছে থাকে না, কে দেখবে এসব। মা আমি তোমার ওপর একদম রাগ করি না। আমি জানি তুমি আমাদের সঙ্গে এসেই থাকতে চাও। নানু তো দেবে না। বাবাও অবশ্য চায় না তুমি চলে আস। কিন্তু আমি জানি তোমার মনটা পড়ে থাকে এখানেই। রোজই তুমি আসতে চাও, নানুর ভয়ে পারনা।
মা এরপর রান্নাঘরে ঢুকবে। দুকাপ কফি বানাবে। আমাকে সাধবে। আমি তো খাবনা। সুন্দর করে ট্রেতে কফি সাজিয়ে তারপর বারান্দায় যাবে। কেন যে বানায়, সে নিজেও খাবে না। বাবা তো না-ই। দুজনের মাঝে পড়ে থাকবে কফির ট্রে-টা। ওরা কী কথা বলে? মাঝে মাঝে মনে হয়, আড়াল থেকে শুনি। তারপর ভাবি থাক, মা-বাবার এটুকু প্রাইভেসি বোঝার বয়স তো আমার হয়েছেই। মা কি বাবার হাতে হাত রাখে? বাবা কি এখনো মার গালে হাত বুলিয়ে দেয়? মার একটা ডাকনাম আছে, বাবার দেওয়া। এ নামে আমাদের সামনে কোনদিন ডাকেনি, মানে ডাকতে চাইতনা আর কি। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলত মাঝে মাঝে, জুনিপার। এ নামের কী অর্থ, কী বৃত্তান্ত বুঝিনাই। এখনো ডাকে? মনে হয় না। বাবা কেন জানি মার সঙ্গে কথাবার্তাই আর তেমন বলে না। কিন্তু মনে মনে যে মার আসার দিনটির জন্য অপেক্ষা করে তা বেশ বুঝতে পারি। আমার সঙ্গেও তো বাবা তেমন কথা বলেনা। বাবা বরাবরই এমন, এখন তো আরও যেন চুপসে গেছে। ঠিক সন্ধ্যে নামলেই বারান্দায় গিয়ে বসে, আলোটা জ্বালে না কখনোই। অবশ্য এ বাড়িতে এখন আর তেমন আলোই বা জ্বলে কই, মরাবাড়ি একদম। দুবছর ধরেই তো এমন।
অন্ধকারেই দুজন বসে থাকে অনেক্ষণ। বাবা বোধহয় আসলে চায়ই মা এসে থাকুক আমাদের সঙ্গে। কিন্তু বলবে কীভাবে। মা নিজেও তো কিছু বলে না। হয়তো চায় বাবাই আগে তুলুক কথাটা। অবশ্য মা এখানে এসে পড়লে নানু কষ্ট পাবে খুব। মা মনে হয় সেকথা ভেবেই বলে না কিছু।
খুৃব বেশি সময় এসে থাকতে পারে না মা। নানু অস্থির হয়ে যায়। একা ছাড়তে চায়না মাকে। মা ফোনটা বন্ধ করে রাখে নিশ্চয়ই। নাহলে তো ফোনের পর ফোন দিতে থাকত। মা না থেকেই যায় এখানে, নানুর ভয় তো সেটাই। অবশ্য মা কি জানিয়ে আসে নানুকে? না বোধহয়। বাবাকে কোনদিনই নানুর তেমন পছন্দ ছিল না। এখন তো রীতিমত আতংক তাঁর। আমাদের কথা শুনলেই রেগে যায় মার ওপর। একই শহরে আমরাও আছি, কই কোনদিন তো এলনা দেখতে। বাবুকেও যেন ভুলে গেছে একদম। অথচ ও হওয়ার পর কী খুশি। মা-বাবার বিয়েটা যে নানু শেষমেষ মেনেই নিল, সেটা বোঝা গেল কিন্তু তখনই। আমি হওয়ার পরও নাকি এত খুশি হয়নি নানু। নাতি চেয়েছিল তো, নাতনির আদর নেই।
সামনের বাসা থেকে আলো এসে পড়ছে বারান্দায়। মা-বাবাকে দেখা যাচ্ছে আবছা। ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে বেশ দেখতে পাচ্ছি। উঠে দাঁড়িয়েছে মা। এই সময়টা খুব কান্না পায়। মাকে জড়িয়ে ধরে যদি বলি, মা প্লিজ থেকে যাও। যেওনা। মা কি শুনবে না? বাবা কি খুব রেগে যাবে? বাবুও বুঝতে পারছে মার যাবার সময় হয়েছে। ও কিছু বলে না কেন? কেন মার পা দুটো চেপে ধরে না। বাবাই বা কি, মা থেকে গেলে কী হয়। কিন্তু বাবা বলবে না। আমি বললেও রেগে যাবে খুব। মা হয়তো নিজে থেকেই এসে থাকতে চাইবে। কোনদিন হয়তো এসে আর চলে যেতে চাইবে না। হয়তো নানু মারা যাওয়ার পর। আমরা ছাড়া তো তখন আর কেউ থাকবে না মার।
যাওয়ার আগে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে মা। বাবুর গাল চেপে একটু আদর করবে। ওকে জড়িয়ে ধরলে যদি মার থেকেই যেতে ইচ্ছা করে! এই সময়ে অন্ধকারই ভাল। চোখাচোখি যাতে না হয়।
মার কাছে চাবি থাকে এই বাসার। দরজা খুলে লক করে দেবে বাইরে থেকে। তারপর নেমে যাবে নিচে। বোধহয় এখন নিজেই ড্রাইভ করে, নানু যাতে না জানে এখানে এসেছে।
আবার আসবে ঠিক এক বছর পর, এই দিনে। বছরের অন্য সময়ে এলে তো পাবে না আমাদের। এই একটা দিনই আমরা চেয়ে নিয়েছি মার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমাদের মতো আর কেউ বোধহয় এই সুযোগটা পায় না। বাবুর জন্যই মনে হয় পেয়েছি, ও তো খু্ব ছোট। মাকে না দেখে থাকতে পারে না।
দুবছর আগে ঠিক এই দিনে বাবু, আমি আর বাবা মরে গিয়েছি। গ্যাসের চুলাটা বন্ধ করা হয়নি। বাড়িতে আমাদের নিয়ে ঢুকেই কফি বানাতে গিয়েছিল বাবা। মা ছিল নানুর বাসায়। আমাদের আর দেখতে পায়নি মা। নানু দেয়নি, সহ্য করতে পারবে না বলে। তবে এরপর এই দিনে কিন্তু ঠিকই দেখা হয়। সারাবছর ধরে আমরা অপেক্ষা করি এই দিনটার। আমরা আলাদ হলাম এই দিনেই, এই দিনেই আবার এক হওয়া। আমার মনে হয় আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। মা একবারেই চলে আসবে, হয়তো নানুও তখন আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৪:০৯