ভাই
১.
চাইলেই ছোঁয়া যায়, যা খুশি করা যায়। মেয়েটা বাধা দেবেনা। পড়ে আছে ঘাসের ওপর সে। ওড়নাটা সরে গেছে একপাশে। বুকটা অল্প ওঠানামা করছে, শ্বাস কি একটু ঘন, পুরু ঠোঁটদুটো কি একটু কাঁপছে, বাঁকা একটা হাসির রেখা কি ফুটছে ঠোঁটে? মেয়েটার গায়ের ওম টের পাচ্ছে শমসের আলী। যেন চ্যালেঞ্জ করছে। কী কর দেখি তো! আর কতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখবে।
ঘন হচ্ছে সন্ধ্যা। তবে আলোর অভাব নেই। আজ পূর্ণিমা। আজ বিশেষ একটা দিন।
ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল শমসের আলী। থাকুক মেয়েটা এভাবেই। টুকটাক কিছু কাজ সারতে হবে। রাতটা তো পড়েই রইল।
ছাপোষা লোক সে। কথাবার্তায় পটু নয়। এই মেয়েটা যে কী দেখেছিল তার মধ্যে। অবশ্য মেয়েটা কি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? এত তাড়াতাড়ি? দশদিনও পার হয়নি আলাপের। আজ প্রথম দেখা। না তাও না, দেখা তো হয়েছে আগেই। আজ প্রথম দুজন একসঙ্গে ঘুরতে বের হওয়া। সারাদিন একসঙ্গেই ছিল তারা। মেয়েটা তার হাত ধরেছে দুবার। তার বোতল থেকে কোক খেয়েছে। নিজের বার্গারে কামড় বসাতে দিয়েছে তাকে। সাদাসিধে মেয়ে। কথা কম বলে সেও। আরও একটা মিল দুজনের, কারওই কাছের কেউ নেই।
এই কথাটাও বোধহয় ঠিক হলনা। শমসেরের তো ভাই আছে একটা। তা সে যেমন ভাই-ই হোক। এই পুরো পৃথিবীতে কারও জন্য যদি মায়া করে সে তো ওই হায়দারের কথাই বলতে হবে। হায়দার আলীও তাই। তারই বা কে আছে শমসের ছাড়া। হ্যাঁ, তাকে ভয় করে অনেকে, কাছে ভিড়তে সাহস পায়না। তবে অত যতœ, মমতা তাকে শমসের ছাড়া কেউ করবেনা। তারা দুটি ভাই-ই বটে। কখনো কখনো শমসেরের মনে হয়, তারা আসলে কে কাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কে কার ওপর নির্ভরশীল। হায়দার যা চাইছে, যা বলছে শমসের তা বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছে। তার খাওয়াপরার ব্যবস্থাটাও শমসেরকেই করতে হচ্ছে। কিন্তু তার বিনিময়ে শমসের কি পাচ্ছে। বউটা পর্যন্ত তাকে ছেড়ে গেল ওই হায়দারের জন্যই। শমসের যে আজ একা তার জন্য কি হায়দারই দায়ী নয়। হায়দারের ভরণপোষনের ঝামেলাতেই সে এত ব্যস্ত থাকে, নিজের জীবনটা তো তেমন করে বাঁচাই হলনা তার।
এই মেয়েটা অন্যরকম। আগেও তো এসব মেয়ে এনেছে সে। কারও মুখের দিকে ঠিকমতো তাকায়ওনি। নামটাও মনে নেই বেশিরভাগের। এই মেয়েটার নাম শুনেই সে বুঝে গিয়েছে এই নাম জীবনে ভোলা হবেনা।
২.
ফুলমালা ঢাকা শহরে এসেছে ঠিক তিন বছর আগে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেল। একটাই মেয়ে সে। তেল চুপচুপে বেণি দুলিয়ে স্কুলে যেত। সেবছরই তার এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। মা না মরলে আর ঠিকঠাক পরীক্ষা দিতে পারলে তাদের স্কুল থেকে প্রথমবারের মতো মানবিকে এ প্লাসও পেয়ে যেতে পারত। এটা অবশ্য সে একটু বাড়িয়েই বলেছে শমসেরকে। ক্যান্টিনে বসে বার্গারে কামড় দিতে দিতে এসব কথাই তো হচ্ছিল।
মা মরার পরই তার বাবার মাথায় একটু গোলমাল দেখা দিল। বউ বেঁচে থাকতে যে বউকে খুব সোহাগ করত লোকটা তা তো নয়। একা একা সংসারটা টেনে বেড়ানোই বোধহয় আর ভাল লাগছিলনা তার। লোকটা টানা তিনচার দিন বাড়ি ফিরত না। কই যেত কোন খোঁজ নেই। ফুলমালা বাড়িতে একা হলেও তাকে সঙ্গ দিতে চায় এমন লোকের অভাব নেই। সেসব লোকের ভয়ে সারাদিন সে আশপাশের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকত। রাতে বান্ধবীদের অনুরোধ করত তার সঙ্গে এসে থাকার জন্য। কিন্তু কোন বাপ-মা ছাড়বে নিজের মেয়েকে এভাবে।
এরচেয়ে যদি বাপ একটা বিয়ে করে সতমা নিয়ে আসত, তা-ও বোধহয় ভাল ছিল। অন্তত সব ছেড়ে এই শহরে তো আসতে হত না।
এভাবে দিন চলবেনা বুঝে গেল ফুলমালার বাপও। ফুলমালার একটা ব্যবস্থা করতেই হয়। বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাই সবচাইতে ভাল হত, কিন্তু অত ঝক্কি পোয়াবে কে। মেয়েকে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়াই সহজ। চেয়ারম্যানের বউটা তো কবে থেকে চাইছে ফুলমালাকে। ঢাকায় মেয়ের বাচ্চা হয়েছে, সবসময় দেখাশোনার একটা লোক চাই। তিন হাজার টাকা মাসিক বেতন আর দুটো নতুন সালোয়ার কামিজে ফুলমালা ঢাকার বাসিন্দা হয়ে গেল।
সে দেখতে ভাল, এটাই একমাত্র অসুবিধা। নইলে ঘরের কাজ তো সে জানেই। বাচ্চাটাকেও সে মায়া করত। প্রথম প্রথম আপা তার ওপর খুশিই ছিলেন। কিন্তু আপার জামাইটা যে এমন, তা কি সে জানত। অবশ্য শুরুতেই তার সন্দেহ করা উচিত ছিল। ভাইয়া ডাকতে গেলে সে কেন বলবে দুলাভাই ডাকার জন্য। তখন সেও বোকা ছিল। এখন কেউ এমন বললে দুকথা ঠিকই শুনিয়ে দিতে পারত।
আপা আর বাচ্চাটা সারাদিন ঘুমায়। আর প্রায়দিনই দুলাভাই জলদি ফিরে আসে অফিস থেকে। গ্রামে সে মানুষের অমন চাউনি দেখেছে। তার বুঝতে ভুল হয়নি। বাপকে ফোন করে নিয়ে যাবার কথাও বলেছে। বাপ পাত্তাই দেয়নি। নিজের ব্যবস্থা সে তাই নিজেই করে নিয়েছে। ভাগ্যিস ঢাকায় চাকরি করা খালাতো বোনের ফোন নম্বরটা বুদ্ধি করে সে রেখে দিয়েছিল। তার ভরসাতেই না সে বেরিয়ে এল ওই বাড়ি থেকে, মানসম্মান বাঁচিয়ে রেখে। গার্মেন্টসে এখনকার চাকরিটা সে-ই জুটিয়ে দিয়েছে। সেই বোনটার ছুতাতেই তো শমসেরের সঙ্গে পরিচয়। এই পরিচয় কি স্থায়ী হয়ে যেতে পারেনা? লোকটার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় তার এমন মনে হয়নি। রিকশায় পাশপাশি বসে সে কেন তবে এমন চাইছে? একটু ছোঁয়াছুয়ি হয়েছে তাই?
৩.
মিরপুরে গার্মেন্টসের অভাব নেই। বান্ধবীর অভাবও শমসেরের হয়না কোনদিন। তাদেরকে বাগে এনে হায়দারের হাতে তুলে দিতে তার খারাপ লাগত না তেমন। সে তো আর প্রেম-ভালবাসার লোক নয়। ফুলমালার বোনটাকেই পটাতে চেয়েছিল সে। মেয়েটা সময় নিচ্ছিল খুব। বুঝে নিতে চাইছিল শমসেরর ধান্দা। এই লোকটার ওপর ভরসা করা যায় কিনা। বয়স তার কম হয়নি, বিয়ে-শাদি, সংসারের লোভ তো সব মেয়েরই থাকে। শমসের এত মিথ্যে বলতে পারেনা। ফুলমালার দিকেই তাই নজর দিল সে। এই মেয়েটা বেশ বোকা বোকা, দেখতেও যেমন, কথাবার্তাও তেমনি। একটু নরম কথা শোনার জন্য অস্থির হয়ে আছে। খালাতো বোনের হলেও হতে পারত প্রেমিকই যদি সময় দেয়, তাতে ক্ষতি কী। বোনটা সারারাত কান খাড়া করে রাখে। বস্তির ছোট্ট ঘরে দুবোনের আড়াল বলে তো কিছু নেই। ফুলমালাকে ঘরের বাইরে আনতে শমসেরের তেমন বেগ পেতে হয়নি। দুদিনের বেশি তিনদিন ফোনে কথা বলতে হয়নি। ফুলমালা সানন্দে রাজি হয়েছে বৃহস্পতিবার সারা দিনটা তার সঙ্গে কাটাতে। একটু ঝামেলা করে ছুটি নিতে হয়েছে তাকে। শমসেরের সে ঝামেলা নেই। তার কাজের জায়গাতেই তো আসবে ফুলমালা। শুক্রবার ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছে শমসের। বড্ড ভিড় থাকে সবখানে।
হায়দার তাকে চোখে চোখে রাখে। শমসের ইচ্ছে করেই একটু দূরে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটাকে সে দূর থেকেই দেখুক। অন্যবার হলে সে হায়দারের সামনে গিয়ে ঘুরিয়ে আনত। ইশারায় কথা হয়ে যেত দুই ভাইয়ের। হলদেটে চোখটা অস্বাভাবিক জ্বলে উঠত হায়দারের। খুশিতে মুখটা হা হয়ে চোখা চোখা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ত। উত্তেজনায় পা টেনে টেনে চক্কর কাটত। শমসেরের মায়া হত খুব। না, রাগ হয়না তার। ঘৃণা তো নয়ই। প্রবৃত্তির বশ তার ভাই। কী-বা করার আছে তার। মেয়েমানুষ তার চাই-ই। আর তা জোগাড় করতে হবে শমসেরকেই। এই জীবন তো সে বুঝেশুনেই বেছে নিয়েছে। আর সব কিছুর আগে রেখেছে ভাইকেই।
হায়দার এমন ছিলনা। তার ভাইকে দেখে মুগ্ধ হত মানুষ। যেমন হাঁকডাক তেমন ডাকসাইটে চেহারা ছিল তার। কিছু করতে হতনা, হাঁক পারলেই পিলে চমকে যেত লোকজনের। তার চোখে চোখ রাখারও সাহস ছিলনা কারও। চেহারাটাই ছিল তার তেমনি। শমসেরকে চালাত সে-ই। ভয়েই হোক আর খুশি হয়েই হোক হায়দারকে যা বখশিস দিত লোকজন তা তো আসলে শমসেরই পেত। এখন হায়দার বুড়ো হয়েছে। পায়ে ঘা হয়ে পচন ধরেছে, হাঁটতে পারেনা ঠিকমত। সেই রমরমা তার আর নেই। তাই বলে এখন কি শমসের ফেলে দেবে তাকে? চুপচাপ মরে যেতে দেখবে? হায়দারের ওপর ভর করেই একসময় চলেছে যারা, তারা আর এখন তাকে পাত্তা দেয়না। শমসের তো আর তেমন করতে পারেনা। মায়ের পেটের ভাই না হোক, তার চেয়ে কোন অংশে কম জ্ঞান করেনা সে হায়দারকে। আর হায়দারও ভরসা রেখেছে কেবল তার ওপরই। একমাত্র তাকেই ভিড়তে দেয় সে কাছে। শমসের আর হায়দার অদ্ভুত জুটি হলেও এ জুটি ভাঙার নয়।
৪.
খাওয়াদাওয়ার পর থেকেই ফুলমালার কেমন জানি লাগছে। বাথরুমও ঘুরে এল সে একবার। শমসের খুব চিন্তায় পড়ে গেছে মনে হয়। আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। ফুলমালার হাসিও পায়। আহারে প্রথম দিনই কি বিপদে পড়ল বেচারা। এখন যদি সে আর হাঁটতে না পারে লোকটা কি কোলে তুলে নেবে তাকে, তার ঘরে নিয়ে যাবে? ফুলমালা শিউরে ওঠে। বার্গারটা বাসি ছিল। সে একটু কেমন গন্ধ পেয়েছে। কিছু বলেনি। বেচারা কত শখ করে এনেছে। তার থেকে চেয়ে নিজেও তো খেল একটু। অনেক বেলা করে খেয়েছে বলেই কি খারাপ লাগছে? বিকেল শেষে সন্ধ্যা প্রায়। আশপাশ ফাঁকা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরবে কখন সে? শমসের আর একটা কোক নিয়ে এসেছে। বোতলের মুখটা খুলে দেয় সে। ফুলমালা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল অনেকটা।
৫.
মেয়েটা নেতিয়ে পড়বে এখনই, বুঝতে পারছিল শমসের। ধরে ফেলল সে। মুচকি হাসল মেয়েটা। বুঝে গেছে যেন শমসের ঘরে নিয়ে যাবে, আপত্তি নেই তার। আচ্ছা হায়দার কি খুব রাগ করবে, মেয়েটাকে যদি নিজের কাছেই রাখে সে। অনেক তো করল হায়দারের জন্য। মাসে একবার, মেয়ে চাই তার। সে অবশ্য বলেনি। শমসেরই ঠিক করেছে এই বন্দোবস্ত। পূর্ণিমার দিনে দুই ভাইয়ের খেলা এটা। শমসের অবশ্য দর্শক। কেমন নেশার মত হয়ে গেছে ব্যাপারটা তার জন্য। দেখতে ভালই লাগে। মেয়েগুলো পড়ে থাকে হায়দারের নিচে। শমসেরই তৈরি করে দেয় তাদের। কোকের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মেশানোর মত সহজ কাজ আর নেই। ওষুধগুলো আবার হায়দারেরই। ধীরে ধীরে আয়েশ করে তৃপ্তি মেটায় হায়দার। চাঁদের আলোয় চকচক করে তাদের শরীর।
কত মেয়ে সে এনেছে হায়দারের জন্য? গুনে রাখেনি। খুব ভেবেচিন্তে আনতে হয়। একেকবার একেক এলাকা থেকে। এইবার মেয়েটা পড়ে গেল কাছের। মিরপুরেরই মেয়ে। থাক, যা হওয়ার হয়েই গেছে।
এই সব মেয়েরা হারিয়ে গেলে খোঁজ করার লোক নেই। বাবা-মা না থাকলেই ভাল। গ্রাম থেকে আসা একা মেয়েগুলোই তার নিশানা। এরা প্রেমে পড়তে সময় নেয়না। ঢাকায় একটা স্থায়ী আশ্রয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। পুরুষমানুষ বুকে নজর না দিয়ে মুখের দিকে তাকালেই মন কেমন করে ওঠে তাদের। এতবারের মধ্যে তেমন বিপদে পড়েইনি সে। কেউ সন্দেহ করেনা তাদের। ভাবতেও পারেনা বোধহয় চুপচাপ বোকা বোকা শমসের আর বুড়ো পঙ্গু হায়দারের মধ্যে এমন একটা বন্দোবস্ত আছে।
৬.
হায়দার গন্ধ পেয়েছে মেয়েটার শরীরের। সামলাতে পারছেনা আর নিজেকে। প্রতিবার এমন সময়ে শমসেরের মনে হয় তার ওপরই চড়াও হবে হায়দার। ভয় পায় সে। তবে না, হায়দার বোঝে তাকে।
ছোট্ট দরজাটা খুলে শমসের ভেতরে ঠেলে দেয় ফুলমালাকে। পরনের কাপড় খুলে নিয়েছে আগেই। পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কেউ যাতে কিচ্ছু টের না পায়। লাশটা তো আর সরানোর তেমন কিছু থাকেনা। হায়দারই ব্যবস্থা করে তার।
মিরপুর চিড়িয়াখানার একসময়ের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার হায়দার আলী এগিয়ে আসে তার খাবারের দিকে। প্রথমেই গলায় ছোট্ট কামড় বসিয়েই ছিঁড়ে ফেলতে হবে শিরাটা। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে গরম রক্ত। পূর্ণিমার হলদেটে চাঁদের মতই দেখায় তার চোখজোড়া।