‘আর একটু ভাত দেই।’ না করার আগেই এক হাতা সাদা ধবধবে ভাত এসে পড়ল আমার প্লেটে।
‘ঝাল লাগতেছে? ডাল দিয়ে ধুয়ে খান।’ এবার এক চামচ ডাল।
চোখে পানি এসেছে মানেই ঝাল লাগা নয়। চোখের পানির আরও অনেক মানে আছে। এসব তত্বকথায় না গিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম।
‘আপু মাংসটা বোধহয় আপনি খেতে পারবেন না। আপনি ডিম নেন।’
‘আমার মা রেঁধে দিয়েছেন। নদীর পাড়েই আমার বাড়ি। আপনারা নিশ্চিন্তে খান। চাপকলের পানি দিয়ে রান্না করি আমরা।’
ওকে ঘিরে বসেছি আমরা ১০ জন। হাত দুটো চলছেই তার। কারও পাতে শাক, কারও ডিম, কারও মাংস, কারও ঝোল-মাংস বাদে শুধু আলু। আর এর মধ্যেই কার পাতের ভাত কমে গেল, কে ঝোল বাদে শুকনা খাচ্ছে সেদিকে কড়া নজর।
পিয়ান নদীর পাশে পাত পেড়ে বসেছি আমরা। ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুলে আমরা শহুরে বাবু-বিবিরা। সে বসেছে পাটি নিয়ে, চারপাশে বড় বড় হাঁড়িতে নানা পদ। টকটকে লাল ঝোল, তার নিচে উঁকি দিচ্ছে মাংস,আলু। সস্তা মেলামাইনের প্লেট সে ধরিয়ে দিয়েছে সবার হাতে।
‘আজকে আর ফিরতে হবে না। এখানেই খেয়ে এখানেই ত্যাগ।’ বলল এক বাবু।
‘কিচ্ছু হবেনা ভাইয়া।’ গালভর্তি হাসি তার।
আমরা এসেছি জাফলং বেড়াতে। পিয়ান নদীতে নৌকা চড়া হল। ওপাশে গিয়ে ভারতের দারুন সুন্দর একটা সেতুও দেখা হল। ফটোসেশনও ভালই জমল। ফিরতি পথে নদীর ধারেই দেখি পাটি পেতে একগাদা হাঁড়িকুড়ি নিয়ে বসে আছে সে।
‘ওরা বোধহয় পিকনিক করছে।’
‘আর লোকজন কই?’
সেসময় সে ডাক দিল। ‘ভাত খেয়ে যান ভাইয়া-আপুরা।’
বয়স বিশের কোঠায়। পরনে হাল ফ্যাশনের সস্তা জ্যাকেট, জিন্স। মাথায় টুপি। এই ছেলেটার ডাক শুনেই বসে পড়লাম আমরা, এখানে বেড়ানো শেষে নাজিমগড় রিসোর্টে গিয়ে যাদের দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা।
সাতকড়া দিয়ে মাংস, কড়াই-মুরগি কত কিছু খাওয়ার প্ল্যান আমাদের।
সেসব বাদ, স্রেফ সাদা ভাত, অসম্ভব ঝাল ডিমের ঝোল, আলু দিয়ে গরুর মাংস, আর আলু ভর্তা দিয়েই দুপুরের খাবার সারছি আমরা।
ঝালে আহা-উহু করছি। ও ভাবছে আমাদের চোখে পানি এসেছে ঝালের জন্য। বেশ লজ্জা পেয়ে গেছে। ওকে কে বলবে বিয়ের পর থেকে এত যত্ন করে আমাকে আর কেউ খাওয়ায়নি। আগে আম্মা কতবার ডাকত, টিভি দেখছি বা ফেসবুক করছি বলে উঠে যাইনি। আম্মা একাই বসে খেয়ে নিতেন। শাক দিয়ে ভাত মেখে কয়েক লোকমা খাইয়ে দিতেন আমাকে। ‘আম্মা তুমি এত বড় লোকমা কর। আমি কি এত বড় হা করতে পারি!’
রাতে বাসায় ফিরে আমার বন্ধ দরজা ধাক্কাবেই আব্বু। কি বিরক্তি আমার! আমি তো আগেই খেয়ে নিয়েছি।
বিয়ের পর আর কেউ ডাকেনা এভাবে। টেবিলে সাজানোও থাকেনা এত পদ। ভাত কম খেলাম কি বেশি কেউ দেখেনা।
আমরা মাঝে মাঝে খেতে যাই রেস্তোঁরায়। বুফে টেবিল থেকে নিজেই নিয়ে নেই। অথবা দারুন পেশাদার ওয়েটাররা এসে পরিবেশন করে। কোন বাড়তি কথা বলেনা তারা। খুব বড় রেস্তোঁরা হলে শেফ এসে মাপা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, খাবার কেমন লাগল। আমরাও চাপা হাসি দিয়ে বলি- নাইস, রিয়েলি নাইস।
নদীর পাড়ের এই ছেলেটা দেখতে মোটেও আমার ছোট ভাইয়ের মত নয়। ভাই কোনদিন ভাত খেতে বলেনা। কিছুই বলেনা আসলে। আম্মার থেকে জেনে নেয় কবে আমি বাসায় আসব। আর আমার পড়ার টেবিলে রেখে দেয় ব্যাগভর্তি কিটক্যাট, প্রিনজলস, ক্যাডবেরি। তাও কেন এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছে ভাইটার কথা। আম্মা কোনদিন তরকারিতে এত ঝাল দেননা। হাঁড়ি নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা আমার আম্মার পক্ষে অসম্ভব। আলাদা বাটিতে ভাত-তরকারি বেড়ে তবেই তাঁর পরিবেশন। টকটকে লাল এই ঝোল দেখে কেন তা-ও মনে পড়ছে বাড়ির কথা।
আমার আশপাশে বসে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনজন ক্যাপ্টেন। যা পায় তা-ই খেতে এমনই ট্রেনিং পেয়েছে ওরা। ওদের দিকে তাকাতে পারছিনা আমি। জানি ওদেরও ঝাল লাগেনি। কেন ওদের চোখ আমার মতই ভেজা সেটাও আঁচ করতে পারছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৮