বাঘমারা টিকু লেনের একদম শেষ দিকের পুরাতন দোতলা বাড়িটার গেটে একটা লেখা ঝুলতে দেখা যায়।
লেখাটি হলঃ
"এখানে নৈপুণ্যের সহিত স্বেচ্ছাচারী মানুষ খুন করা হয়।(লাইসেন্স আছে আমাদের)
চার্জঃ১৫০ টাকা"
আমি এদিকটায় এসেছিলাম নিতান্ত কৌতুহলে হাটতে হাটতে ।'দেখা যাক গলিটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ' এই ছিল কৌতুহল ।কিন্তু এখানে যে মানুষ ভড়কে দেওয়ার এমন ভয়াবহ ব্যবস্থা করে রাখা আছে সে কথা কে জানত আগে? আমি আর কিছুমাত্র বিলম্ব করলাম না তখন,হন্তদন্ত হয়ে লম্বা লম্বা পায়ে গলিটা থেকে প্রায় পালিয়ে এলাম দ্রুত।এবং গলিটা থেকে বের হয়ে যখন বড় রাস্তায় উঠে পড়ার স্বস্তি পেলাম তখন অব্যর্থভাবে অনুভব করলাম যে, কোন এক অদ্ভুত কারণে ইশ্বরের আমি পেয়ারের বান্দা।
যাইহোক এই ঘটনার পর আট বছরের মধ্যে আর ওদিকটাই যায় নি কখনো এবং কারোর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব তারও প্রয়োজন বোধ করি নি।রাফা নামক এক বন্ধুকে অবশ্য গল্পের ছলে একবার জায়গাটা এবং লেখাটার কথা বলেছিলাম।কিন্তু ও তেমন গায় লাগায় নি বা আতকে উঠে ধাতস্থ হয়ে অন্য বিষয়ে চলে গেছিল কি না ঠিক মনে নেই।
এরই মধ্যে জীবনে আমার ঘটে গেল কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । প্রকৃতির নিয়মেই বর্ধিত হল বয়েস।হলুম যুবক নামক কঠিন যন্ত্রনা।কাজেই লাইলি নামক এক মেয়ের কাছে মজনুও সাজতে হয়েছিল কিছুদিন।তারপর বিষম ছ্যাকা খেয়ে যখন একবিংশ শতাব্দির দেবদাস তখন পথে পথে পানির বোতল নিয়ে হন্টন এবং থেকে থেকে মদস্বরূপ পানি পান করাই ছিল আমার প্রধান কাজ।
এবার বলি তার 'পরের' ইতিহাস ।পরের ইতিহাস বলে, আমি কোন মতে লেখা পড়া চালিয়ে কিছু কাগজ(সার্টিফিকেট)অর্জন করেছিলাম একদা।এবং টানা চার বছর ধরে যখন হন্যে হয়েও চাকরি খুজে কারোর চাকর হতে পারলাম না তখন আমার হতবুদ্ধিহীন মস্তিষ্কে একটা লেখার ছবি ভেসে উঠল।
"এখানে নৈপণ্যের সহিত স্বেচ্ছাচারী মানুষ খুন করা হয়(লাইসেন্স আছে আমাদের)"
হ্যা আমি আত্মননেরই পথ বেচে নি অত:পর
কিন্তু বাস্তবে আত্মহত্যা করা যতটা মুখের কথা ততটা কাজের কথা নয় ।অতএব সবচে কম ব্যাথা পেয়ে যাতে আত্মহত্যার মত শুভ কাজটি সুসম্পন্ন হয় সেই কথা মগজে রেখে এবং প্লেটের ঐ কথার উপর বিশ্বাস রেখে একদিন চলে এলাম টিকু লেনের ঐ বাড়িটার নিকটে।
কিন্তু (গিয়ে দেখি ) কোথায় কোন বাড়ি? এখানেতো আজ ধ্বংসের স্তুপ। যে স্তুপের পুরাতন কংক্রিট খন্ডের উপর লেগে আছে কিছু শ্যাওলা আর গজিয়ে আছে কিছু টেরিস।
আমি যেন এক দমকা হতাশ খেলাম হঠাৎ।যতটা না আমার আত্মহত্যা করার বাসনা ছিল তারচে বেশী ছিল ছেলেবেলার কৌতুহল মেটানোর ব্যপারটা।বাড়িটায় কি সত্যিই টাকার বিনিময়ে স্বেচ্ছাচারী মানুষ খুন করা হত?নাকি কেউ সম্পূর্ণ মজা করার জন্য নিছক লেখাটি ঝুলিয়ে রাখত?
আমি কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চলে আসার জন্য মনস্থির করেছি এইসময় ঝোপঝাড়ের ফাকে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে গুজে থাকা কালো কোন কিছুর উপর চোখ স্থির হল আমার।
এগিয়ে গেলাম আমি ।একটা চারকোনাকার টিনের প্লেট ওটা। প্লেটটায় সুন্দর করে কিছু লেখা
"এখানে আত্মহত্যা করার সুব্যবস্থা আছে।(লাইসেন্স আছে আমাদের)
চার্জঃ২৫০"
লেখাটি আমাকে আজ আরো বেশী আকৃষ্ট করল এবং ভাবনায়ও ফেলল বিস্তর।বুঝলাম যে, ভাষাটাকে আরেকটু শিষ্ট করা হয়েছিল এবং মূল্যও বাড়ানো হয়েছিল পরে।
আর এ বিষয়টিই আমার মুখে বিস্ময়ের মুচকি হাসি এনে দিল।
তবে কি সত্যিই এরকম একটা প্রতিষ্ঠান ছিল? যদি না থাকত তাহলে নতুন করে এই লেখাটি লেখার প্রয়োজন হল কেন?
প্রশ্নের উত্তর হয়তো জানা যেত এলাকাবাসীর কাউকে জীজ্ঞেস করে।কিন্তু হঠাৎ করেই যেন আমি তার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম।কি দরকার বাপু?জগতেতো কত অদ্ভুত মানুষ এবং বেচে থাকার তাগিদে তাদের কত না অদ্ভুত কর্ম কান্ড। এটাও হল সেই অদ্ভুত কর্ম কান্ডের অন্তর্ভূক্ত।তাতেতো এত উদ্বেলিত হওয়ার কিছু নেই।
মনে মনে এরকম উচ্চমানের দর্শনের কথা চিন্তা করে প্লেটটাকে ছুড়ে মরলাম কাছে কোথাও এবং মনে মনে যেন এ স্বস্তিও পেলাম আত্মহত্যার কাছ থেকেতো রেহাই পাওয়া গেল।