নিচের কবিতার স্তবক দুটি লক্ষ্য করুন।প্রথমটি এক নবীন কবির।দ্বিতীয়টি একজন বিখ্যাতের।
১) বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের
কিনারায়
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের
কুয়াশায়
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার
ক্ষোভে,-
সে কোন বোঁটের ফুলের ঠোটের মিঠা
মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে
অবেলায়।
২) কে বাঁধে শিথিল বীণার তন্ত্র
কঠোর যতন ভরে
ঝংকারি উঠে অপরিচিতার
জয় সঙ্গীত স্বরে।
নগ্ন শিমুল কার ভান্ডার
রক্ত দুকূল দিল উপহার
দ্বিধা না রহিল বকুলের আর
রিক্ত হবার তরে।
স্তবক দুটির প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর সমালোচনাঃ
""বলাই বাহুল্য,প্রথম স্তবকটি অতি দুর্বল,নিরেস।প্রায় অকবিতাই বলা যায়।বনের চাতক,মনের চাতকের তুলনা নেহাতই অকিঞ্চিতকর,ছন্দ এবং মিলেও বেশ দোষ আছে।যারা কবি,তারা জানে 'কুয়াশার' এর সঙ্গে 'অবেলায়' সঠিক মিল হয় না।অন্তমিল মানে দুই পঙক্তির শুধু শেষ অক্ষরের মিল নয়,পুরো শব্দটির ধ্বনি গত মিল থাকা আবশ্যিক তো বটেই,অন্য অক্ষরগুলির বর্গ গত মিল থাকলেও ভালো হয়।মাঝখানে একটি অকারণ মিলের লোভে ভুল শব্দও প্রয়োগ করা হয়েছে।'বোঁটের' মানে কী?'ঠোটের' সঙ্গে মেলাবার জন্য 'বোঁটার' থেকে 'বোটের করা হয়েছে, এটা অসঙ্গত।যতি ব্যবহারও ত্রুটিপূর্ণ,ষষ্ঠ লাইনে ক্ষোভের পর কমা এবং ড্যাশ দুটোই দেবার কোন প্রয়োজন ছিল না।'ফুলের ঠোটের মিঠা মদের লোভে', এতে কোন কবিত্ব নেই,অনায়াসে বলা যেতে পারে ক্লিশে।দ্বিতীয় অন্য কবির স্তবকটি নিখুঁত। মাত্রা ও মিল সম্পর্কে কোন প্রশ্নই নেই,অনুপ্রাসে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।কারণ অনুপ্রাস উচ্চাঙ্গের কবিতার রস নষ্ট করে,কিন্তু অনেকগুলি 'র' ও 'ল' - এর ব্যবহারে ধ্বনি মাধুর্য পাওয়া যায়।সমস্ত শব্দই অতিসাবলীল।বোঝা যায় বহুদিনের অভিজ্ঞতার ফসল।""
এখন বলি প্রথম স্তবকটির কবি হলেন-একটু এটে বসুন- রূপসী বাংলার জীবনান্দ দাস।এবং দ্বিতীয় স্তবকটির কবি হলেন গীতাঞ্জলীর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।(দুই একজনের অন্তত ইনাকে চেনার কথা)
যাইহোক সুনীলের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেকালের নবীন কবি জীবনান্দের দাসের তুলনা দেওয়ার কারণ সেকালে অন্য সাধরণ কবিদের মত জীবনানন্দ দাসও ছিলেন প্রাণ পণে রবীন্দ্র অনুসারী।এবং কবিতায় ছিলেন প্রবল কাচা।
জীবনানন্দের এই স্তবকটি ছিল ১৩৩৪ সালে(বয়স সম্ভবত তিরিশের কোটায়) তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' এর 'বনের চাতক মনের চাতক' কবিতার শুরু।(এবংএকই সালেই রবীন্দ্রনাথের উক্ত স্তবকটি মহুয়া কাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশ পায়।)
এখানে বিস্ময়ের ব্যপার হল খুব অল্প সাময়ের ব্যবধানেই প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাসের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পান্ডুলিপি'।'ঝলা পালক' এর লেখক এবং 'ধূসর পান্ডুলিপির লেখক যে একি ব্যক্তি তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।হঠাৎ যেন কোন মায়া সরোবরে ডুব দিয়ে আবির্ভূত হলেন নতুন জীবনানন্দ দাস।তার হাতে সৃষ্টি হতে লাগল সম্পূর্ণ নতুন কাব্যভাষা যা পূর্ববর্তী কবিদের থেকে একদম আলাদা।শব্দ ব্যবহারে তিনি বেপরোয়া।অক্লেশে আনছেন জাদুকরী রহস্যময় শব্দ।চাক্ষুষ দৃশ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন রহস্য।
কবির 'ঝরাপালক' থেকে 'ধূসর পান্ডুলিপি'তে এমন চমকপ্রদ উত্তরণ বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনাতো বটেই, আজও রহস্যময় মনে হয়।
"পাড়াগাঁর গায়ে আজ লেগে আছে
রূপশালি ধানভানা
রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই,-নুয়ে
আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি নাই,- রূপ ঝরে পড়ে" ----------------(ধূসর পান্ডুলিপির অন্তর্গত কবিতাংশ)