পুরো সিঁড়িঘরটা জুড়েই কেমন যেন একটা কুৎসিত এবং অলুক্ষণে ব্যাপার আছে।কোনটা দিয়ে শুরু করা যায়!পৃথিবীর সব দেশের স্থাপত্য শিল্পে নিশ্চয়ই সিঁড়ির একটা আদর্শ মাপজোখ আছে।সেটা যেমনই হোক,এই বাড়ির সিঁড়ি যে তার ধারে কাছে কোথাও নাই সেটা কোন অকাট মূর্খও বুঝবে।প্রথমত ইয়া উঁচা উঁচা এক একটা ধাপ।কয়েক ধাপ পেরোলে যেকোন সাধারণ ভুড়ে বাঙ্গালি ফোস ফোস করে হাঁপাতে বাধ্য।তার উপর আবার এইসা খাঁড়া,যেন ভূগর্ভ থেকে সাই করে স্বর্গে গিয়ে শেষ হয়েছে।নীচের ধাপে দাঁড়ালে সর্বোপরের ধাপের মানুষটাকে অনেকসময় ঠিকমত দেখাও যায় না।দ্বিতীয়ত ঢাকা শহরের কিছু তস্যগলির সাথে মিল রেখে একে তৈরি করা হয়েছে।যেকোন পূর্ণবয়স্ক দুজন মানুষ পাশাপাশি যেতে গেলে নিশ্চিতভাবে আটকে যাবে।এই বাড়ির বয়স কত কে জানে!প্যালিওজোয়িক যুগের হয়তো।সিঁড়ির ধাপে ধাপে কালো শ্যাওলার আবরণ আর দেওয়ালের এবড়োখেবড়ো পলেস্তারা দেখে অন্তত সেরকমটাই মনে হয়।
হলফ করে বলা যায় পৃথিবীতে জন্মলগ্ন থেকে বিষণ্ণতা সৃষ্টিকারী কয়েকটা জিনিসের একটা হলো কার্বন ফিলামেন্টের ৪০ ওয়াটের বাতি।যার একটা আছে এই বাড়ির সিঁড়িঘরে।নীচ থেকে দোতলায় ওঠার দুইপ্যাঁচের মধ্যবর্তী স্থলে;ঠিক মাথার উপর জং ধরা টিনের আসমানে একটামাত্র ক্যাটকেটে হলুদ বাতি।আরো বিরক্তিকর হলো একটু বাতাসে এই বাতি পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে।তখন পুরো সিঁড়ি জুড়ে আহ্নিক গতির মত শুরু হয় দিনরাত্রির খেলা।একপাশে আলো বেশি,তো অন্যদিকে পিচকালো অন্ধকার।
ধাপে ধাপে উঠে একেবারে উপরে আছে একটা বারান্দা।বারান্দায় একইদিকে পরপর তিনটা দরজা।মাঝের দরজা স্টোররুমের।সে স্টোররুমও নিকট অতীতে কখনো খোলা হয়েছে বলে কারো জানা নেই।অন্তত কড়ায় মোটা লোহার মরিচা পড়া তালা সেটারই স্বাক্ষ্য দেয়।ডানদিকের দরজা অপেক্ষাকৃত নতুন।
দরজার উপর চিকন টিনের একটা নেমপ্লেট লাগানো।উপরে লেখা 'আলাওল হুদা'।নেমপ্লেটের ঠিক এক বিঘাত নীচে একটি মিডিয়াম সাইজের গরুর ছবি আঁকা।ছবিতে গরুর লেজে আবার একটা ফুলও বাঁধা।গরুর পাশে বেণীদুলানো ছোট মেয়ের ছবি।মেয়েটার নীচে আট ঘরের নামতা লেখা।সুন্দর হাতের লেখা।যদিও নামতাতে ভুল আছে।আট গুণ নয় একাত্তর লেখা।দরজার তালা বেশ নতুন।কিন্তু ভাঙ্গা।
ভাঙ্গা তালার নতুন দরজা ঠেলে ঢুকলে প্রথমেই সামনে থাকে বসার ঘর।ছিমছাম ঘর বলতে যেমন বোঝায় এ ঘরটা তেমনই।একপাশের দেওয়াল ঘেঁষে মধ্যবিত্তের সমাজ রক্ষাকারী সস্তাদামের সোফাসেট।অন্যদিকে কোণায় একটা মিডিয়াম উচ্চতার কাঠের শোকেজ।বেশ কারুকাজ।ঘরের বেমানান আভিজাত্যের স্মারক।কে জানে!হয়তো হুদা অথবা হুদাপত্নীর বংশীয় ঐতিহ্যের ডাকটিকিট ছিলো এটি।ছিমছাম ঘরটাতে কিছু উল্লেখযোগ্য গড়বড় আছে।যেমন ধরা যাক স্বাভাবিকভাবে ১০ বাই ১১ ইঞ্চির একটা ফ্যামিলি ফটো সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় শোভা পাওয়া উচিত বসার ঘরের চার দেওয়ালের কোন একটাতে।তার বদলে সেটা পড়ে আছে ধুলো বালি জড়ানো মেঝেতে।ভাঙ্গা কাঁচের উপর স্পষ্ট বুটের ছাপ।সোফাসেটের কুশন কভারগুলো কিছু ধারালো জিনিসের পোঁচের দাগ।আর শোকেজের ভিতর এককালে যত্নে গচ্ছিত পোর্চেলিনের থালা বাসন বহুটুকরা হয়ে ঘরে ছড়িয়ে আছে।
বসার রুমের সাথে লাগোয়া শোওয়ার ঘর।মধ্যবিত্তের শোওয়ার ঘরের বর্ণনার কোন বিশেষত্ব নাই।তবে এইটার আছে।ঘিয়ে রঙের আলুথালু চাদরে খয়েরি রঙের কিছু ছিটে দাগ আছে।বিছানার উল্টোদিকের দেওয়ালে সময় আটকে থাকা ঘড়ি,আর দিন আটকে থাকা ক্যালেন্ডার আছে।তার নীচে-পাশে-চারিদিকে কিছু গোল গোল গর্ত আছে।এই ঘরটা কেমন গুমট।একটা জানালা অবশ্য আছে।কিন্তু তাতে গুমোট ভাব কাটে না।উত্তরের শিরশিরে বাতাস ঢুকে পুরো ঘর ঘুরে বসার ঘর,বাথরুম,রান্নাঘর ঘুরে দরজা পার হয়ে ছুটে বারান্দায় আসে।তারপর ঘুরপাক খেয়ে এই বেঢপ সিঁড়ি বেয়ে পালায়।
স্টোররুমের বাঁ পাশের দরজার পিছনের বর্ণনা সংক্ষিপ্ত।এই দরজার পিছনে শুধু নিশির অন্ধকার।এখানে কোন আলো নেই,শব্দ নেই।কোন গল্পও নেই।
যখন প্রচন্ড জ্যোৎস্না প্লাবনে অথবা রুদ্রশ্রাবণে এই বারান্দা ভেসে যায়।তখনো এই নিশির অন্ধকার গোঁয়াড়ের মত এই ঘর দখল করে থাকে।চাঁদসূর্যের জোয়ার বরং শিরশিরে বাতাসে মিলেমিশে গড়িয়ে গড়িয়ে বারান্দা,তারপর বেঢপ সিঁড়ির ধাপে ছড়িয়ে আসন পাতে।
এই প্যালিওজোয়িক যুগের বাড়ির প্রাগুক্ত সিঁড়ি ঘরের পরিবর্তন যেন হুট করে আটকে গেছে কোন এক রাত্রিতে।সেই যে আলাওল হুদার শোয়ার ঘরে গোল গোল ফুটাওয়ালা দেওয়ালে দিন আটকে রাখা ক্যালেন্ডারটা!ওটার একটি ছবি ছিলো।ক্যানন ক্যামেরায় তোলা।বহুদিন পর কোন এক পরদেশী পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিলো।আটকে যাওয়া রাত্রির হদিস সেখান থেকে পাওয়া যায়।২৫ শে মার্চ ১৯৭১।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:২৭