বিকৃত আত্মার পৃষ্ট-পেষক
জাকির হাসান
(পরিচিতি)
মোবারক মিয়া পাড়া গাঁয়ের এক পরিচিত নাম। গ্রামের যেসকল গন্যমাণ্য ব্যাক্তিবর্গ রয়েছে, তাদের কাতারে তাকে রাখতেই হবে।কিন্তু তার এই পদন্নতি তাকে ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়েছে। মোবারোক মিয়া যখন খুউব ছোট সবেমাত্র সে পৃথিবীর আমন্ত্রিত অতিথি, ঠিক সেই সময় তার পিতৃ-বিয়োগ ঘটে।সদ্য ভুমিষ্ট মোবারক ও ৭ বছরের শিশু জাফর কে নিয়ে মা আমেনার অভাব অনটনের র্জীর্ণ শীর্ণ দেহ।প্রাচীন ধ্বংস স্তুপের মাঝে সংসার নামক মহা-রথীর ঘাড়ে চেপে ঢাল তলোয়ার বিহীন রাজ্যের রাণী। অতি কষ্টে আদর মমতায় দু সন্তান কে তিনি খেয়ে না খেয়ে কোন মতে একটু বড় করে তুলেছিলেন।বাল্যকালে পিতাকে হারানোর পর বাঁচার তাগিদে পরের বাড়ির রাখাল হিসেবে আত্ম-প্রকাশ ঘটে মোবারক ও জাফর মিয়ার।এর পর জীবনের অনেক বাধা বিপত্তিকে দু হাতে দুমড়ে মুচড়ে সে আজকের পরিনত মোবারক মিয়া। গ্রাম্য শালিশ,সামাজিক পর্যায়ের বৈঠক, দরীদ্র মানুষের আহাজারীতে তার ছিল নিস্বার্থ অবদান।আদর্শ সমাজ ব্যাবস্থাপনায় তার ছিল যত্রতত্র নিবেদিত প্রাণ।যদিও তার পুথি বিদ্যা নিতান্তই সামান্য।অন্যন্য ছেলেদের মত দুরের পথ পাড়ি দিয়ে অধ্যায়ন করার সুযোগ সে পাইনি।শিক্ষার প্রতি অসাধারণ টান থাকায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিল।বাংলায় লেখা ও সাবলীল উচ্চারণে পড়তে তার কোন বাধা ছিলনা।নিরক্ষরভুক্ত সমাজে তাকে টিপ দিতে হয়না।”যাকে বলে স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত” পৈত্রিক সুত্রে বসত বাড়ির চার বিঘা জমি ছাড়া আর তেমন কিছু ছিলনা।তাই অল্প বয়সেই বাস্তব সমাজের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।তখন কার সহজ পন্থা কৃষিকেই অনুসরন করল তারা।অল্প মূল্যে উর্বর কৃষি জমি বর্গা নিয়ে ধান পাট চাষ করে তারা জিবীকা নির্বাহ করত। আস্তে আস্তে তাদের পরিবার স্বচ্ছল হতে থাকল।এক সময় কৃষি পণ্যের ব্যাতিক্রম উদ্ভিদ পান চাষ ( তামাক জাতীয়) পণ্য উৎপাদন করে বিস্তর পয়সার মুখ দেখল। এ চাষের উদ্ভাবক কে? চাষ পদ্ধতি কোথা থেকে এল? তা আমার জানা নেই।তবে এ চাষ করে তারা দশ গ্রামে আইডল হয়ে থাকল।পরবর্তীতে তাদের পরামর্শ ক্রমেই এলাকাতে এ চাষের বিস্তর প্রসার হয়েছিল। মোবারক মিয়া তার ক্ষুদ্র শিক্ষা দিয়ে এভাবেই নিরবে সমাজ গড়ার কাজ করত।এর পর তরুণ বয়সে বিয়ে-শাদী করে সংসারের ভীত গড়ার পর নিজের ছেলেদের ও বড় ভায়ের ছেলেদের শিক্ষিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল তার।মোবারকের এক মাত্র বড় ভাই জাফর মিয়া তখনকার হাল ফ্যাশনে ডুবে গিয়েছিল। পরিস্কার পোশাক পরা, দেহকে পরি পাটি করা এবং সেই সময়ে বিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের অ-নৈতিক কার্যক্রমে নিজেকে সংযুক্ত রাখা ছিল তার কাছে গর্বের।সে ছিল নিরক্ষর,উড়নচন্ডী ও অর্থনাশী।তবুও বড় ভাইয়ের প্রতি মোবারকের পরম শ্রদ্ধা ছিল।” শুধু ঐ স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত মূল্যবোধের কারণে।” মোবারক মিয়ার সংসারে ৫ ছেলে ও দুই মেয়ে, জাফর মিয়ার সংসার একটু বড় ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে। খড়ের চালের বাঁসের চাটাই দিয়ে গেরস্থ আদলে চতুর্মুখী ঘর দিয়ে ঘেরা এক ওঠানওয়ালা বাড়িতে দুই ভায়ের ছেলে মেয়েগুলো একে অপরের সাথে মিলেমিশে একটি পরিবারের হয়ে বড় হচ্ছিল। যেখানে হিংসা বিদ্দেষ ছিলনা, প্রাপ্তি অ-প্রাপ্তির বালাই ছিলনা, ছিলনা সামাজিকতার বাধা-নিষেধ।বড় ভাই স্বভাব বৈরাগী হওয়াতে মোবারক মিয়াই এতবড় পরিবারের প্রায় সমস্থ দায়ীত্ব নিজের মত করে বয়ে চলত। বড় ভাই যাই হোক সংসারের প্রয়োজনে মোবারক মিয়া মাঝে মাঝে তার পরামর্শ নেয়। জাফর মিয়াকে যোগ্য সন্মাননা দিয়েই সে সংসারের মঙ্গল দ্বীপ জ্বালে।
”অনৈক্যে বিশ্বাসী নয় ঐক্যেই শক্তি,
প্রভুত্ব আছে যেথা ভক্তিতেই নিস্পত্তি “
সংসারের প্রভূত ক্ষতি সাধন করলেও বড়ভাই তার পিতৃছায়া।ঠিক এই রুপ সমস্থ সংসারের মঙ্গল প্রদীপের মত।কখনো কোন কারণে সে বড়ভায়ের সাথে উদ্যত আচরণ করেনি।”এই হচ্ছে স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত মোবারক মিয়া” মোবারক মিয়াকে কেউ তার ভায়ের অপকর্ম সমন্ধে জানালে সে এক প্রকার অহঙ্কার করেই বলত
( “ স্রোতের জ্বল পর্যাপ্ত প্রবাহেই বেগবান হয়
আর সেই বেগ খাল বিল নদীনালা চষে বেড়ায়ে আবার সাগরেই ফিরবে, মাঝখানটাই কেবল উন্মাদনা” )
চলছে চলুক তুমি বলার কেহে? অমনি মুখ থুবড়ে স্তব্ধহয়ে বোবা হয়ে সমাজ পড়ে রয়।
( মোবারক স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত কথাটা তিনবার উচ্চারিত হয়েছে। তার জ্ঞ্যন, জীবণ দর্শণ ও মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক “ স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত বাক্যটি তার প্রতি উৎসর্গ করলাম”
পর্ব..........১
মোবারক মিয়া খুউব সুন্দর করে পুথি পাঠ করত।পুথির প্রতিটা শব্দের সাথে নিজের সুন্দর বচন প্রতিভা জুড়ে দিয়ে তার সামনে উপস্থিত শ্রোতাদের বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিত।চার গ্রামে তার পুথি পাঠের কদর ছিল।কাউকে ঘটা করে জানানোর প্রয়োজন হতনা।বাড়ির সামনে খানকা ঘরটা গ্রামের সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।সন্ধার পর যার যার কাজ শেষে, গ্রামের মাতবর, কৃষক,রাখাল বাড়ির কামলা, ছেলে-বুড়ো পাড়া প্রতিবেশী দিনের ক্লান্তি ভুলে এক খন্ড বিনোদনের জন্য খানকা ঘরটি (বাড়ির বৈঠক খানা) সবার কাছে আপন হয়ে উঠেছিল। মোবারক মিয়া দিনের সমস্থ কাজ সেরে স্ত্রীর হাতের যত্নে পরিস্কার করে ধোয়া, অথচ খুবই সাদামাটা কাপড়ে পুথি নিয়ে খানকা দরবারে যখন হাজির হত, তখন দরবারের সমস্থ মানুষের মধ্যে একটা আনন্দের ফোয়ারা বইত।মোবারকের বসার স্থানটির সামনে কেরোসিনের কুপির আলোতে তাদের সে উৎসুক আনন্দমাখা মুখগুলো কুপির আলোর চেয়েও লক্ষগুন উজ্জল মনে হত। কুপির ক্ষীণ আলোর শিখাও সে আলোয় নিজেকে বিসর্জন দিয়ে ভক্ত স্রোতা হয়ে যেত।গৃহস্থলি কাজ শেষে পল্লীর বধুরা লোকচক্ষুর একটু আড়ালে ঘোমটা দিয়ে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে পুথিপাঠ শুনত। মোবারকের বৈঠক খানা (খানকা ঘরটি) এলাকার বিশেষ শ্রী।শুধু পুথিপাঠ নয়,এলাকার বিচারিক কার্যক্রম ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হত এখান থেকেই। তাই দিন রাত সব সময় ঘরটি গ্রামের লোকের পদভারে মুখরিত হয়ে থাকত। বাইরে থেকে কোন মেহমান এলে এই ঘরটি অতিথি পানশালা হিসেবে ব্যাবহার হত। আজ মোবারক যে অবস্থায় আছে,সমস্থই তার স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার মন্ত্রের জোরে। এখানে একটা কথা বলা দরকার পুথিপাঠ কেবল আপামর সাধারণের বিনোদনের জন্য তা নয়।পুথিপাঠের মাধ্যমে সমাজের চৈতণ্য পিরিয়ে দেওয়া এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই বিভিন্ন পাঠ্যবই থেকে গুরুত্তপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করে পুথি আকারে পাঠ করে সমাজকে উদ্ধার করার চেষ্টা, তার নিত্যব্রত ছিল। যে সব গেরস্থের চোখের সামনেই সে আজকের পরিণত মোবারক, তারা মোবারকের কতৃত্ব পরায়নে ঈর্ষান্বিতায় খানকা ঘরের কুপির মত ধুকে ধুকে জ্বলছিল।কিন্তু সে জ্বলা, কেবলি জ্বলা। এ তো গেল সন্ধা লগনে আলো আঁধারের মিলন মেলায় মোবারক জীবনের একখন্ড চিত্ররুপ।এরপর! এরপর আরো আছে! রাতের নীরবতায় সে তার প্রেমময়ী স্ত্রী কে নিয়ে জোছনা পোহায়। ২৫বৎসর আগে মোবারকের ১৮ বৎসরের কৈশর জীবনে ১১ বৎসরের আনোয়ারা মোবারকের হৃদয়ে ধুমকেতুর মতই আবিভূত হয়েছিল। তখন সংসার, সমাজ, স্বামী কোন কিছুরই মর্মতন্তু উপলব্ধি করার সাধ্য আনোয়ারার ছিলনা।খেলার ছলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে সে শুধু কবুল বলেছে। তখন মোবারকের ছোট্র সংসারে আনোয়ারার স্বাধীণ চলাচলে বাধা ছিলনা।বিয়ের আগে পুতুলের বিয়ে নিয়ে ঠিক যে ভাবে ব্যাস্ত থেকেছে, বিয়ের পর বাস্তব জীবনেও ঠিক সে রুপ মোবারকের ঘরটাও তার কাছে পুতুলের ঘর বলে মনে হয়েছে।মোবারক এই বালিকা বধুর হৃদয়ের বরবেশি পুতুল। অ পরিপক্ক স্ত্রীর মূল্যবোধের অভাব মোবারক তার তরুণ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করত।ভোগের মাতমে নয়, সুন্দরের পুঁজা অর্চণা করাতেই তার সমস্থ হৃদয় অনায়াসে উপবাস থাকতে পারে।পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় সে স্ত্রীর প্রতি জোর খাটায়নি। শুধু হৃদয়ের আকর্ষণে কাছাকাছি থাকবার ব্যাকুল বাসনা, স্ত্রীর দুরন্ত পনা, এ ঘর ও ঘর ছুটাছুটি, রুপের ঝলকানী, চলাফেরা, কথাবার্তা সমস্থ সৌন্দর্যের মিশ্রনে মোবারকের কেবলি মনে হয়েছে এ এক দুর্লভ ফুল,যার দর্শণে শত জনম ধণ্য ।
পেজ- ২
শ্বাশুড়ি আমেনা বেগমের ও ছোট পুত্রবধুকে যথার্ত মনে ধরেছিল। হালকা শরীর, মাঝারী গড়ন, সংসারের কাজের প্রতি দুরন্তপনা,ঘন ঘন কথা বলা এই সব বৈশিষ্টকে কেন্দ্র করে সে শ্বাশুড়ির খুউব কাছের হয়ে গেল। সংসারের শিকে আমেনার হাতে বোনা, অসহায়ত্বের পথ পাড়ি দিয়ে অল্প সময়েই এ সংসার আজ পরিপূর্ণ।নিজের হাতে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন সংসারের সমস্থ দায়ভার।দ্বীর্ঘদিন সংসার জীবনের অন্ধকার অলি গলি পেরিয়ে উন্মুক্ত খোলা ময়দানের যে আলোক সজ্জার দেখা পেলেন সেখানে তার ছোট পুত্রবধুর সোভা যথার্তই মানানসই। মণ্চের কারুকার্য ক্ষচিত আসনটিতে পক্ক নেতৃত্ব তার স্ব মহিমায় রয়েছে।সংসার কে আপন করার ভাষা এই ছোট্র দেহের সমস্থ অঙ্গ পতঙ্গে যেভাবে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে, তা আমেনা বেগম সাড়ম্ভরে উপভোগ করতে লাগলেন।অপর দিকে তার বড় পুত্রবধু শাস্তন বানুর প্রতি যারপরনায় অখুশি আমেনা। শাস্তনবানু এ সংসারে প্রায় ৫ বৎসর, সংসারের কাজ কর্ম ঠিকঠাক গুছিয়ে করতে পারেনা। সে অলস প্রকৃতির ও নয়, দিন রাত ঘরের গৃহস্থলী কাজ করে থাকে।বিরাগী স্বমীর আনুকুল্য তার ভাগ্যে জুটেনি। উ-সৃঙ্খল স্বামীকে বস করে নিজের করার ক্ষমতাও তার ছিলনা। অতি সরল পল্লিবালা, যে তার সরলতাকে পুঁজি করে জাফর মিয়ার সংসারে নির্বাসিত হয়েছে। স্বামীকে আপন করার স্ব-মহিমা নেই বলে সংসারের সমস্থ ক্ষেত্রেই তার নারী ভূষণ পদদলিত হয়েছে। অথচ সেই পুুরুষ নামের হিংস্র শকুন,নোংরা আবর্জনায় যার পরিতৃপ্তি, সমাজ সংসার তার কাছে একবার ও এ প্রশ্নের উত্তর চাইনি”যে স্বাধীকার তোমার আছে তাই বলে আগুনের লেলিহান জ্বালী তাতে অন্যের স্বকীয়তা ভষ্ম করার যে অপমান, সে যে তোমাকেও কম অপমানিত করল না”এর উত্তর যে সমাজ জানে না তা নয়, কেবল দূর্বল পুরুষের চিত্তে আগুন জ্বালিয়েই যে সমাজ আনন্দ পায়,আর সে আগুনে পু্ড়ে মরতে হয়,এ দেশের শাস্তন বানুর মত অসংখ্য নারীর। অতপর সময়ের আবর্তে আনোয়ারয়া আজ পরিপক্ক। বালিকা থেকে বধু, বধু থেকে গৃহিণী। স্বামীকে ভক্তির আদলে পূঁজা করে নয়, প্রকৃত প্রেমেেই সে মোবারকের সমস্থ হৃদয় কানাই কানাই পূর্ণ করে দিয়েছে। স্ত্রীর পরিপূর্ণ ভালবাসায় মোবারকের হৃদয় দিবালোকের মতই উজ্জ্বল ছিল। গৃহস্থলীর কাজ কর্ম তদারকি, সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজনে ছুটেচলা, বিচার, সালিশ , মিমাংসা চায়ের দোকানে গ্রামের মুরুব্বীদের মাঝে রাজনৈতিক আলোচনা পর্যালোচনা, সমাজের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার আধিপত্য বিচরণ।শিক্ষিত যুবক ছেলেরাও এমন তর্ক নবিশ বৈঠকে মোবারকের লাগাম টেনে ধরতে পারে না ।বাস্তব তথ্য উপাস্থাপন করে যোগ্য জবাব দিতেই তার শিক্ষা তত্বের ভিত ভেদ করে সে নিজের চেয়েও বড় হয়ে রয়।কোথা থেকে সে এমন শক্তি পেয়ে নিজেকে বড় করে তোলে এটা তার নিজের ও জানা নেই।হয়ত অতি মানবিক গুনাবলী তার ভেতর সক্রিয় রয়েছে।তবে সে গ্রামের হাট বাজারে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে ও রেডিওতে খবর শোনে আর তা পর্যালোচনার শক্তি তার নিজেরই। তার উত্থানের অনলে পুড়ে তখনকার সমাজ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগল।জমিদার পুত্র জমিদার পরবর্তী সমাজ প্রত্যাবর্তনের পর চেয়ারম্যান ছিল। প্রভাব প্রতিপত্তিতে দশগ্রামে তার সাথে কারো তুলনা নেই।সেই গফুর চেয়্যারম্যান ও তার আমলারা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল মোবারক মিয়ার বিরুদ্ধে।সমাজ থেকে মোবারকের উত্থান পর্বের উজ্জল মূর্তিকে তারা গলায় ফাঁস দিয়ে মারার পরিকলাপনা করল।তারা তখনকার একটি দৈনিকে খবর ছাপল, মোবারকের বাড়িতে ছাগলের পেটে মানুষের বাচ্চা জন্ম নিয়েছে।চেয়্যারম্যানের পেটে বিদ্যা বুদ্ধি ছিলনা তা নয়, তখনকার সমাজে বিদ্যার দিক ও বিত্তের দিকে তার অবস্থান সমাজের অন্যন্য সাধারণের থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ। তথাপি মনের দিক থেকে তার এই ঈর্ষান্বিত হীন মনস্কতার উর্দ্ধে উঠে সে নিজেকে বড় করে দেখতে পারে নি।মোবারক ও দমবার পাত্র নয়, সে উল্টো মামলা করে দিল।পুলিশি বিতর্কে না জড়িয়ে পরবর্তীতে তারা নিজেরাই এই ঈর্ষান্বিত অপতৎপরতার সমাধানে নির্ধিতায় সম্মতি জানিয়ে ছিল।এ ক্ষেত্রেও মোবারকের “স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত শব্দটি স্ব মহিমায় উজ্জল হয়ে থাকল”
পেজ-৩
আমেনা বেগম গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হল। পরিপূর্ন সংসারে ফরমায়েস খাটিয়ে, সংসারকে সাঁজিয়ে গুছিয়ে হটাৎ করেই তিনি বিদায় নিলেন। জন্মবধি বড় পুত্রবধুর অপারগতাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। পুরুষ মানুষ কুপথে পা বাড়াবেই, সে পায়ে বেড়ি পরানো ঘরের লক্ষিরাণীর কাজ। তাই বড় বউকে দুরে দুরে রেখে সংসারের সমস্থ কাজের নৈপুন্য, কলা কৌশল তিনি ছোট বউয়ের হাতেই জিম্মি রেখে বিদায় নিয়েছেন।সময়ের ব্যাবধানে জাফর মিয়া ও মোবারক মিয়ার সংসার পৃথক হয়েছে। তবে আত্মার ব্যাবচ্ছেদ হয়নি। শুধু সম্পত্তির বনিবনা হয়েছে মাত্র।তাছাড়া যেমন ছিল ঠিক তেমনি রয়েছে।অশুভ অসৌজন্যতার কোন বালাই ছিলনা।জাফর মিয়ার বড় ছেলে বাহার, নামের সাথে বাহ্যিক ও ভেতরকার পূর্ণ যোগসুত্র ছিল বটে। সঠিক মাপের উচ্চতা ও গোলগাল শ্যামলা গড়ন। চোখে মুখে উদার উদাসী ভাব।বংসের বড় ছেলে আদর যত্নের কমতি ছিলনা।বিশেষ করে সিংহ ভাগেরও বেশি আদর যত্ন পেয়েছে দাদী আমেনার কাছে।বংসের প্রথম মুখ তাই সমস্থ পরিধি ঘিরে আমেনার ছাঁয়া বাহারের ছাঁয়ার সাথে লেপটে থাকত।শুনেছি বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে বাইরের অনেকখানি রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে আমেনা পরিস্কার করে রাখত, অন্য কারো জন্যে নয় শুধু সে রাস্তায় তার নাতি চলাচল করবে বলে। এমনি আর্শিবাদ পুষ্ট হয়ে এন্ট্রাস পাশ করে কলেজে পা রাখতেই বাহারের জীবনের এই মহিয়সি নারী তাকে বিদায় জানালো।তার পর বাহার মিয়ার দিন যাপনের গল্পগুলো তার কাছে হটাৎ করেই খাপছাড়া হয়ে গেল।সাধু, চলিত, সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি বিভিন্ন শব্দের শব্দ দুষনে সমস্থ প্রেক্ষাপটটাই দুর্বোধ্য হয়ে গেল।মায়ের যত্ন আত্তির বালাই নাই, শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকতেই সে সংসারের প্রতি খাপছাড়া ছিল। শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর সে ভাব আরো শক্ত পরিপক্ক হয়েছে।শ্বশুড়ির ভয়ে এতদিন স্বামীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারেনি, এখন জাফর মিয়া যখন কোন ছুঁতো ধরে তাকে মারতে যায় তখন শাস্তনবাণুর ভেতরের প্রতিবাদী রুপটা জেগে উঠতে দেখা যায়।স্বমীর মুখের উপর জবাব দেয় “ মিন্সি ছাই-পাস গিলি মরতে পারিস না পাড়ার মাগীর কাছে যা তারা তোক খাতি দেয়না, আমাক খালি খালি মারতে আসিস তোর হাত পঙ্গু হয়ে যাবি তুই চলতে পারবুল্যা তখন তোক কিডা দেখবি” এই কথাগুলো তার এত দিনকার নির্যাতনের স্পষ্ট সাহসী উচ্চারণ।জাফর মিয়াও তার ভেতরকার এই তেজস্বনী রুপ এতদিন দেখেনি। প্রচন্ড সত্যের স্পষ্ট উচ্চারণে জাফর মিয়া বিহবল।কোথা থেকে সে পেল এমন শক্তি? এ যেন ঝড়, ঝড়ের বাতাসে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্র থেকে উল্কার মত ছুটে আসা বাণ তার বুকে বিধছে।তার রক্তাক্ত চক্ষু নিরুপায় হয়ে চেয়ে দেখছে!নির্বিকার! জাফর যখনই তার প্রতি এমন চড়া্ও হয়েছে,তখনই এ রকম ঝড়ো বিচরণে তার শক্তি খর্ব হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? মনে মনে অনুসন্ধান করতে লাগল জাফর। উত্তর ও পেল। পাপ যে কেবলি পোড়ায়? এত দিনের উত্তপ্ত লাভা আগ্নেগিরি অগ্নিৎপাতের মাধ্যেমে জ্বালা মুখ করে বের হয়ে আসছে। কিন্তু এর আগেও তো ছিটেফোটা লাভা তিনি বের হতে দেখেছেন, তা তার শক্তিতে আঘাত হানেনি।কিন্তু সেই একই শক্তি আজকে নিরুপায়…কেন? কারণ সেই শক্তিকে যে উস্কে দিত সে আজ বেঁচে নেই। তাই পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় আজ তার এই বেহাল দশা। নিরুপায় আত্মসমার্পন। নাহ! ভুল, বয়স ছিল, রক্ত গরম ছিল তাই তার এমন উত্তাপ।নিজ স্ত্রীর চুল দু ভাগ করে তা বাঁসের খুঁটিতে পেঁচিয়ে বেঁধে যতক্ষণ সাধ না মেটে ততক্ষণ নির্যাতণ চলতে থাকে। আমেনা এমন পরিস্থিতিতে পুত্রকে সমর্থণ দিয়ে বলেছে, বাপ ও মানুষ না, মাগী কু-লক্ষনে ওর উপর বদ জীন আছে। ওর কিচ্ছু হবিনানে, তুই হাপিয়ে গেলি।যেখানে জাফরের নিষ্ঠুর অ-মানুষিক বেত্রাঘাতে শাস্তনবাণুর জীবন যায় যায়, যেখানে মানবতার এমন চরম অবমূল্যায়ন, যেখানে শাস্থনবাণুর শরীর রক্তাক্ত , ক্ষত বিক্ষত সেখানে নারী হয়েও আরেকজন নারীর প্রতি এমন বর্বরতায় অমেনার মনে এতটুকু করুণার উদ্রেগ হয় নাই।সে পুত্রকে দিয়ে শাস্তনবাণুকে শায়েস্তা করতে পেরে খুশি।পুত্রকে পাশে বসিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করে, আদর করে খাওয়ায়, আর বিলাপ করে বলে, আমার এমনি সোনার মত রাজপুত্র, এই অলক্ষি মাগী তছনছ করে দিল।কি তছনছ করল? কি কারণে অলক্ষির প্রতি তার এমন আচরণ? কেন এই হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ, এর স্পষ্ট কারণ জানা নাই। তার মনের আশার যথার্ত প্রতিফলন ঘটেছে এটাই আমেনার স্বস্তি।মানবতা লুন্ঠনের বিকৃত খেলার জন্ম এখানেই। জাফর এই সত্যকে অ-স্পষ্ট করে উপলব্ধি করতে পারে।কিন্তু যে তেজে সে এতদিন স্পর্ধা দেখিয়েছে সে কি এত সহজে বিলুপ্ত হওয়ার। হার মানতে নারাজ। তাই বিষয়টা তার কাছে এভাবে দাঁড়ায়, আজ বুঝবার সময় হয়েছে তাই এমন উচ্চ মূল্য দিয়েই তাকে বুঝতে হচ্ছে। সময়ের কাছে সত্যকে গলা টিপে ধরে মারবে , তবুও সত্যের কাছে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে পাপ সুধরাতে আপত্তি আছে। তাতে নিজের ভাবমুর্তি নষ্ট হয়।আত্মার মাঝেই আত্মার ব্যাবচ্ছেদ করে জীবন চলার পথকে কন্টকময় করার কু শিক্ষা কবে কোথা থেকে ভিত করে গন্তব্য শুরু করেছিল তা জাফর মিয়ার জানা নেই।তবে এই শিক্ষাকে ভেদ করে নিজেকে জানার ইচ্ছাও তার নেই। আবার প্রকৃতির খেয়ালে মাঝে মাঝে বিবেক জাগ্রত হলেও তার আঁতুড় ঘরেই মৃত্যু হয়েছে। এ সংসারের পাপ তাকে ছোঁয় না, কারণ সে যমের বাড়ির নেমন্ত্রণ খায়।তার আবির্ভাব হয়না, বেসুরা ছন্দে আগমন হয়। জাফরের চরিত্রের যে বিকাশ তার জন্য কি শুধু জাফরই দায়ী? আমার তেমনটা মনে হয়না, আমার মনে হয় জাফর মিয়ার উপর পেতাত্মা ভর করেছিল, সেই খারাপ আত্মা কেউ না, তার মা আমেনা।ছেলেকে দায় মুক্তি দিয়ে সমস্থ দায়-দায়ীত্ব ছেলের বউয়ের উপর চাপিয়ে যে বিকৃত আত্মার খেলার জন্ম দিল , কাল-ক্রমে সেই একই আত্মা শুধু রুপ পাল্টাইলো । বিজ্ঞানে পড়েছি শক্তির ক্ষয় নাই । শুধু এক রুপ থেকে আরেক রুপে আবিভূত হয়। আজ এই অপশক্তিই কেবল ভেল পাল্টাইয়া শুধু স্থানতরিত হয়েছে। আমেনা থেকে জাফর, জাফর থেকে শাস্তনবাণু ।
পেজ-৪
বাহার মিয়া দাদীর মৃত্যুর পর ছন্দ পতনের মধ্য দিয়েই ইন্টার মিডিয়েট পাশ দিল।পরিবারের এহেন পরিস্থিতিতে তার লেখাপড়ায় মন নেই।৮০-র দশকে ইন্টার-মিডিয়েট পাশের নজির ও সাফল্য সম-সাময়ীক লোক ছাড়া তেমন স্পষ্ট করে আর কেউ বুঝবেনা। তা যতই ব্যাখ্যা করে বোঝানো হোক না কেন?পাশের পর চাকুরী পেতেও অসুবিধা হলনা। পাশের গ্রামে হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেল।এমন সংসারে এ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট।গৃহস্থলী ঘরে মানুষ পরিশোধনের কারিগর।পূর্ব সম্মানের সাথে নতুন সম্মানের যোগ হল।এবার এমনি সু -যোগ্য সন্তানের বিবাহের কথা পরিবার চিন্তা করতে লাগল।মফস্বল পাড়াগাঁয়ে বসবাস করলেও, পান ব্যাবসায়ের সুবাদে তাদের জেলা শহর পাবনা ও থানা শহর ঈশ্বরদীতে ঘন যাতায়াত ছিল।ব্যাবসায়ের সুবাদে তাদের সুনাম জেলা ও থানা পর্যায়ে বিস্তৃত ছিল।পাবনায় মোবারকের এক পরিচিত আঁতেলের মাধ্যমে পাত্রী ঠিক হল।সদরের প্রান কেন্দ্রে ১তলা ছাদ দেওয়া পাকা বাড়ি।মেয়ের বাপ পাকিস্থানী আমলে সরকারী পদে চাকুরী করত। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশে সে চাকুরী বহাল ছিল।মেয়েরা তিন ভাই দুই বোন।সবাই লেখাপড়া করে।আঁতেলের মাধ্যমে পাত্রী পক্ষের আমন্ত্রনে মোবারক ও জাফর মিয়া পাত্রী দেখা-দেখির কাজ চুড়ান্ত করে সরাসরি বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলল।পাত্রী পক্ষ বেশি ভাবাভাবি করলনা। এক দিকে পাত্র পক্ষের ব্যাবসায়ীক সুনাম, অন্য দিকে শিক্ষিত সুদর্শন চাকুরীজিবী ছেলে।বাহার মিয়ার মতামতের বালাই ছিলনা।পারিবারিক সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।তখনকার দিনে পাত্রী যাচাই বাছাইয়ে পাত্র পক্ষ ছাড়া পাত্রের কোন সুযোগ ছিলনা।বাহারের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম নয়।বিয়ের নির্ধারিত দিনে বাহার বর সেঁজে কনের বাড়িতে উপস্থিত হল।এর পর অনেক আয়োজনের মধ্যে দিয়ে যখন বাহারের হাতে কনে কল্পনার হাত সঁপে দেওয়া হল, তখন সে হাতের কোমল স্পর্শে বাহারের হৃদয় পাওয়ার আনন্দে উপচে উপচে পড়তে লাগল।কয়েকবার সে আড় চোখে স্ত্রীর ঘোমটা দেওয়া মুখখানা দেখবার চেষ্টা করেছে।ঘোমটার পরিমান এত বড়ই ছিল যে, বারবার চেষ্টায় সেই কাঙ্খিত মুখখানা বাহার দেখতে পেলনা।অধীর আগ্রহে যখন বাসর ঘরে সেই মুখখানা দেখার সৌভাগ্য হল, তখন সে বিস্মিত!এ রুপ তার কল্পোলোক কেও হার মানায়।সে যা চেয়েছে তার থেকেও বেশি পেয়েছে।হিমেলে ভেজা আধো জ্বলে পদ্মের গোলাপী রংয়ের মত তার গায়ের রং, চোখ মুখ নাকের বর্ণনার কাছে পৃথিবীর সব উপমাই বেকার।আর সেই রাত…………….
পেজ-৫
সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলনা।রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে পড়েছি, বউ হয়ে যে মার খায়, শ্বাশুড়ি হয়ে সেই বড় মারটা মারে। একথা পদে পদে সত্য।শাস্তনবাণুর এত দিন কার উপার্জিত বিদ্যা বুদ্ধি এখন পরিপক্ক। শাস্তনবাণু তার শ্বাশুড়ির কাছে যা রপ্ত করেছিল, আজ তা প্রোয়োগের মাধ্যমে তার জ্ঞ্যানের পরিধীর পরিচর্যার কাজে পরিপুর্ণ নিয়োজিত থাকল। নতুন বউকে দিয়ে সংসারের সমস্থ কাজ করানো, কাজের ত্রুটি ধরে খোঁটা দেওয়া, খাওয়া দাওয়ায় শিথিল্য কড়াকড়ি পরিবারের সবাইকে খাইয়ে তারপর তার খাওয়া। স্বামীর উপার্জন নিয়ে খোঁটা শুনতে হয়।কয়টাকা কামাই করে মাষ্টার স্বামী,খালি খালি বসে গিলতে লজ্জা করেনা, সকাল অব্দি সন্ধা পর্যন্ত এই ধরনের অমানবিক আচরণ কতটুকু যুক্তি যুক্ত ছিল তা ভেবে দেখার বালাই ছিল না।কেবলি সমস্থ সংসার জুড়ে শাস্তনবাণুর কু-শিক্ষার তপ্ত তেজে এমনি করে এই নতুন সংসার ধুষর হতে থাকলো। নব পুত্র বধু কল্পনার চোখের পানিতে মেঘ জমে।মেঘের কালো আভরণটা তার দেহের সর্বাঙ্গে লেপ্টে গিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে সে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরত। স্বামীর মধ্যে কোন শুন্যতা সে দেখতে পায়নি, তবু শুণ্য থেকে ধরণীতে তার অবহেলায় প্রতিনিয়ত খসে খসে পরা।বাহার দিনে চাকরী করে রাতে স্ত্রীর সানিধ্যে যখন তাকে ছুঁতে যায়, তখন দেখে এ এক আধমরা ফুল।যার সমস্থই কেবল শুণ্যতা, শোভা নোই বললেই চলে।নীরব চোখ,ক্লান্ত শরীর, বন্দী পাখির মত তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। কারনটা বাহারের স্পষ্ট করেই জানা।সাগরের জ্বল দুষিত হলে সেখানে বসবাসরত প্রাণীর প্রাণ রক্ষা হয়না।তেমনি সংসারের আবর্তে যদি পেতাত্মার বসবাস থাকে তাতে করে সুস্থ হৃদয়গুলোর এমনি করুন দশা হয়।কিন্তু এ মায়াজাল ভেদ করার সাধ্যও বাহারের নেই।স্ত্রীর পক্ষে সংসারের বৈরিতা চ্যালেন্জ করে সেখানে নতুন সূর্যের বাসনা অলৌকিক।সামান্য মাইনে বেতন, এ দিয়ে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায়না।আবার সংসারে যে পেতাত্মা তার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার পুঁজি বাহারের নেই।স্ত্রীর চাঁদ মুখ আজ মলিন। কোন কিছুতেই মন স্থীর করতে পারেনা বাহার।ব্যাপক ভাবনা চিন্তা রাহুর মত গ্রাস করতে লাগল তাকে।দিনের পর দিন এমনি অস্থির তাড়নার সংবাদ কল্পনার বাপের বাড়ি পোঁছতে সময় লাগল না। মাঝে মাঝে কল্পনার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসে এ সংসারের হীনতা স-চক্ষে দেখে গেছে।বাহার মিয়া শ্বশুর বাড়ি স্ত্রী নিয়ে বেড়াতে গেলে সেখানেও বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। এবং বিস্তর আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে বাহারের নিরবতাকে দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করে বাহারের উপর অভিযোগের বৃদ্ধাঙ্গুলী তুলেছে। বাহার যে বরাবর নিশ্চুপ তা নয়, স্ত্রীর অধিকার কারো পদতলে পিষ্ট হচ্ছে তার বাহার স্পষ্ট বোঝে। স্ত্রীর পক্ষে মাঝে মাঝে সোচ্চার হতে দেখা গেছে তাকে।কিন্তু যে দৈন্যতা আর হীন মনস্কতার জলে পরগাছার মত তাদের বসবাস, সে জল দুষিত হলেও সে তার-ই খোরাক। এই চরম সত্য বাহার বুঝতে পারে।এই সত্য উন্মোচন করে সেখান থেকে বের হয়ে আসতেও বাধা আছে। কারণ সত্যের পেছনের সত্য উপেক্ষিত হয়।পরিবার কে ছোট করা হয়। আবার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ জলাশয় ডিঙ্গিয়ে সাগরের জ্বলে মিলিত হওয়ার যে স্রোত , তার বিরাট অভাব।সংকট পূর্ণ পরিস্থিতি আলোচিত করার লোক আছে কিন্তু উপাই বাতলে দেওয়ার পক্ষে কেই সহায়ক নয়।এমনি অস্বাভাবিক ছিল সেই ক্ষণ।এমনি অস্ভাবিক ছিল সেই দিন যাপনের গল্প।সমস্থ অসাহায়ত্বের মাঝে বাহারের কাঁটাময় পথ।বিষাক্ত কাঁটার আঘাতে বাহার ক্ষত বিক্ষত হতে থাকল।আর এভাবে দিন যতই গড়তে লাগল, দিনের সাথে ক্ষতও পাল্লা দিয়ে বিভৎস হতে লাগল। দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর গড়াল। সংসার জীবনে সদ্য কন্যা সন্তানের বাবা বাহার।এত দিন নিজেদের মানবধিকার ক্ষণে ক্ষণে ভুলুন্ঠিত হয়েছে, সংসারের বৈরিতায় কল্পনা ও বাহারের লুকানো দগ্ধ নিশ্বাসে তাদের সমস্থ শরীর ঝলসে গেছে। পবিত্র বন্ধনের অস্তিত্বটুকু টিকে রাখার প্রতয়েই তাদের এরুপ দূড় পথচলা।আজ নবাগত সন্তানের উপর এই ধরনের সংসারের বিকৃত আত্মার প্রেতাত্বা যখন ভর করতে চায়, সংসারের এই বিভৎস রুপের ছাঁয়া যখন তাদের নিষ্পাপ শিশুর অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তখন সে দুংখ তাদের কাছে নরকের কুন্ডলিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চেয়েও হাজারো গুন কষ্টদায়ক মনে হয়।বাচ্চার দুধ খাওয়া নিয়ে কুটুক্তি, গরুর দুধখাইয়ে কাজ কি,এ সংসারে এতটাকা নাই যে প্রতিদিন দুধ কিনে খাওয়াবে, বুকের দুধ খাইয়ে শাস্তনবাণু ও তখনকার মেয়েরা পোলাপান মানুষ করেছে।খাওয়াইলে বুকের দুধ খাওয়াক না খাওয়াইলে সস্তা মোটা চালের ভাত টিপে টিপে মুখে ভরে দিক।কিছুদিন এমন করলে খাওয়া শিখে যাবে।কাজের ফাঁকে যদি বাচ্চার কান্নার শব্দে কল্পনা মায়ের টানে ছুটে আসে সেখানেও বিপত্তি আছে।এ ক্ষেত্রে শাস্তনবাণুর ভাষ্য এমন বাচ্চা পেঁ করলে অমনি মা ছুটে যায়। আমরাও তো বউ ছিলাম, অনেক ছেলে মেয়ে মানুষ করেছি, ঐ রকম ছুটে যায়নি।সংসারের কাজকামে মন নাই, মেয়ে নিয়েই যদি পড়ে থাকতে হয়, তাহলে বাপের বাড়ি যেয়েই পড়ে থাকনা, সেখানে খাতির যত্নের অভাব হবে না । এ সংসারে পড়ে থাকার কি দরকার। তারা নাকি শিক্ষিত জাত, শিক্ষিত ঘরে বিয়ে দিলেই পারত, আমার ছাওয়ালের ঘাড়ে ফোঁড়া হতে এলি কে। এ রকম বিদঘুটে অ-শোভন বিচরণে আত্মা বিকৃতের খেলায় প্রেতাত্তার প্রহসন।এখানে পাঠক মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, এ বাড়ির আর যারা সদস্য তাদের কি অবস্থা, প্রতিক্রিয়া কি? বিষয় হল এই মূল্যবোধের জাগ্রত রুপ করো ভেতরই তেমন স্পষ্ট নয়।বয়স্কদের মধ্যে কিঞ্চিত যারা উপলব্ধি করতে পারে তাদের কাছে এ চিত্র অতি পরিচিত। একেবারে গা সওয়া। তাই বিস্লেষন নিয়ে অযাচিত বিস্তর ভাবাভাবির আগ্রহ তাদের নেই।ঝড় যেদিক দিয়ে যাচ্ছে সেদিক দিয়েই যাক, দায়ীত্ব বোধ? উহু সেটা হবে নাক গলানো, বাড়াবাড়ী করলে পেতাত্মা তাকেও ধরবে।
পেজ-৬
জাফর মিয়া এখন অনেকটাই ভাববিহীন। স্ত্রীর কর্মকান্ডে তার নজরদারী নেই। সংসারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। স্ত্রীকে তার মধ্যে খুঁজে দেখে কিনা সেই বলতে পারবে।তবে আগের মত শাস্তণবাণুকে আর পেটায় না।মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক পর্যন্তই শেষ।অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।নটি পাড়া, মদ খাওয়া, এইসব আর করেনা।তবে মাঝে মাঝে জুয়ার আড্ডায় তাকে পাওয়া যায়।আর অবিভক্ত সংসারের মোবারক মিয়া,এই বিভক্ত সংসারে কি করবে ভেবে পায়না।ভাই ভাবীর চৈতন্য থাক বা না থাক তাদের অসম্মান করা তার চলেনা।কিন্তু যে গাধাটার উপর এমন তান্ডব নিত্য বয়ে চলেছে, সে কি চাইলে পারতনা মোবারক মিয়ার কাছ থেকে একটা গতি করে নিতে কিংবা মোবারক পারতনা ভাতিজার এমন করুন দিনে ভাতিজাকে উদ্ধার করে দিতে।পারতঃ তবে কেন সে নিশ্চুপ?কোথায় তার স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার মন্ত্র।এখানেও পেতাত্মা মোবারকের মধ্যে বাঁসা বেধে মোবারকের জাগ্রত রুপকে অদৃশ্য করে দিচ্ছে।বিষম ঈর্ষার মতানক্য সৃষ্টি করে মোবারককে পথ ভ্রষ্ট করে দিচ্ছে।সেই বিকৃত আত্মা মোবারকের ও পিছু নিয়েছে।আনোয়ারা যেদিন থেকে সংসারের সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারল,সেদিন থেকে সে শ্বাশুড়ির কৃতজ্ঞভাজন ভাব ধরে ছলচাতুরী করে শ্বাশুড়ির খুউব কাছের হতে লাগল।তার বড় ”জা” শাস্তন বাণু কে শ্বশুড়ি আমেনা অ পছন্দ করে তা আনোয়ারার ভাল ভাবেই জানা।জায়ের প্রতি তার সহমর্মিতা ছিলনা।বরং শাস্তণবাণুর প্রতি আমেনার যে ক্ষুদ্ধ ভাব, তার সাথে উস্কানী যোগ করে শ্বাশুড়ি পক্ষে তার অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে অনোয়ারা।ফলশ্রুতিতে কতৃত্ব দখল নিয়ে হাত পাকিয়েছে।আর এই কর্মের ফাঁকে ফাঁকে শাস্তণবাণুর সাথে যেটুকু সখ্যতা দেখিয়েছে তা লোক চক্ষুকে ধুলি দেওয়ার নিমিত্তেই তার এমন চালাকি।আমেনা বেগম মরার পর দু ভাইয়ের সংসার আলাদা হতে সময় লাগেনি, তা কেবল আনোয়ারার এ কতৃত্বকেই প্রাধান্য করে।শাস্তণবাণুর কোন সময়ই সংসারে কতৃত্বের লোভ ছিলনা।কিন্তু দ্বীর্ঘদিন বড়”জাকে বিরোধ করে শ্বাশুড়ির ছত্রছাঁয়ায় থেকে স্বার্থ হাসিলের যে স্বভাব, সেই স্বভাবকেই জিইয়ে রাখতে দু সংসার আলাদা হতে বেশি সময় লাগেনি।আজ যখন তাদের সংসারের এই করুন পরিনতি, তখন আনোয়ারাই সেখানে বাধ সেঁধেছে।মোবারককে অভিমান দেখিয়ে বলেছে, ওরা আলাদা হওয়ার সময় আমাদের ঠকিয়েছে। পূর্ব পাশে পানের জমির সাথে যে জমিটা, সেখানে বড় ভাই বেশি করে নিয়েছে।বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়ে গুলো আমাদের এখানেই প্রাই খায়, থাকে, ছেলে মেয়ের কোন খোঁজ খবর আছে? এখন আমরা আলাদা হয়ে গেছি, ওদের নিয়ে না ভাবলেও চলবে।সংশয়ের সংসপ্তকে মোবারকের ভাবাবেগ থেমে যায়।অনোয়ারার জোড়ালো উপস্থাপনায় স্বমহিমা আছে।মোবারক ভাবতে লাগল, ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে, সংসারের চাহিদা বাড়ছে, এ কথা যেমন সত্য, ভাইয়ের ছেলে মেয়ে অন্য কেউ নয় এটাও সত্য।পিতেৃত্বের প্রতি মোবারকের দায়বদ্ধতা চুপি চুপি কথা কয়।ভাগ বাটোয়ারায় অ-নিয়ম? সে তো জোর দখল কিংবা তর্কের বসে নয়, সে মোবারকের আপন হৃদয়ের আত্মত্যাগ। বড় ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।যা আনোয়ারার সমস্থ দৃষ্টির বাইরে।মোবারক ভাবতে লাগল সংসারে যে নৈরাজ্য এর সমাধানই বা কি?ঘরের আগুনে ঘর পোড়ে, আত্মা বিকৃতির খেলায় বাতাসে মরা লাশের গন্ধ ওড়ে।মোবারকের কথা নাই কথা বলার ভাষা নাই।মনের মধ্যে কেবল অসস্তি, আজ এত দিন পর সংসার টা যেন তার কাছে শ্বশানের মরা ঘাটের মত মনে হচ্ছে।
পেজ-৭
সংসারের বিপর্যয় কিংবা অবক্ষয় যাই বলি, সেই নোংরা স্রোতে বাহার আজ উদভ্রান্ত।স্কুলের মাইনের সমস্থ টাকা সংসারে ভুর্তুকি দিয়েও তার কন্যা সন্তানের মুখে এক ফোটা দুধ জোটেনা।আর সংসারের বহুরুপি হিংস্র অনিষ্টকারী, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার প্রলয়ঙ্করী অগ্নি দহনে বাহারের সংসার ক্রমেই পুড়ে ছাই হচ্ছে।সে ছাই ঘূর্ণি বাতাসে সমস্থ ঝাপসা করে দেয়।সেখানে বাহারের সংসার হাতড়ে হাতড়ে একটু নিশ্বাস ফেলার যায়গা টুকু পায়না।ধুকে ধুকে বাঁচবার তাড়নায় তার বদ্ধ জীবন ঘুরপাক খায়।জীবন বৃত্ত পথে তার এমনি করুণ বিচরণ।হটাৎ একদিন মেয়ের দুধ খাওয়া প্রসঙ্গে শাস্তণবাণুর কুটুক্তি বাহারের কানে গেলে, নিজের প্রতি ঘৃনা তিক্ততায় তার শরীরের সমস্থ রক্ত যেন বের হয়ে আসতে চাইছে।সে এক পাগলা উন্মাদনা, নিজের অসহায়ত্তের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনায় শিশু সন্তান কে কল্পনার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বাড়ির সামনে কুয়ায় নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল।মানুষের আকষ্মিক বাধা টানা হেচড়ায় কোন মতে শিশুর প্রাণ রক্ষা হল।অথচ এত বড় উদ্রেককারী ঘটনাবহুল পরিস্থিতিতেও শাস্তণবাণু অবিচল।তার শয়তানী আত্মায় অনুকম্পা হয়না।তপ্ত তেজে সে সমাগত মানুষ কে বলতে থাকে বৌ পোলাপান চালানোর মুরোদ নেই,কি করবে কোলের শিশু কে ডুবাতে গিয়েছিল, কি বলব দু;খের কথা এমনি মরার সংসার আমার ।স্বামীর সংসারে সুখ পাইনি, তাই ভেবেছিলাম ছেলে বিয়ে দিয়ে সুখ করব, তাকি কপালে সইবার,বড় লোকের বেটি সংসারে কাজ কামে মন নাই, কিছু বললেই মুখে মুখে কথা বলে।আমরাও বৌ ছিলাম, শ্বাশুড়িকে দেখলে ভয়ে কথা বন্ধ হয়ে যেত, একেই বলে বউ কাল,এখন বউরাই সব, সব হবেনা কি জন্য? স্বামীরা যে বউ ভাঁড়ু যদি আমার স্বামীর মত হত, কথায় কথায় মার খেত, তাহলেই ঠিক ছিল। এই রুপ অযাচিত প্যাচালে জনমানুষের কাছে শিশু নিক্ষেপের ঘটনার যেটুকু গুরুত্ব ছিল, তার অনেকটাই হালকা হয়ে গেল।পাড়ার কিছু মহিলারা যারা শাস্তণবাণু শ্রেণীর তারা শাস্তণ শাস্ত্রে সুর মেলাল। শাস্তণের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞ্যাপন করে বলতে লাগল, আর বলিস না বোন এখনকার যুগে বউরাই সব স্বামীরাই বউ।বয়স হয়েছে-সংসারের খাটাখাটুনি করে স্বামীর মন পাইনি, এখন একটু আরাম করব-তা কি আর কপালে আছে এ যে বৌ রাজার কাল। কালে কালে অারও কত কি………………..?কল্পনার মুখ বরাবর-ই বন্ধ। অভিযোগ অনুযোগের জিজ্ঞাসা তার নিজের কাছে।আজ তার মনে হতে লাগল এভাবে আর কত কাল।নিজের সাধ্য ছাড়িয়ে গিয়েও কুলের দেখা মিলেনা।আজ তার জীবনের গল্প নিবু নিবু। বুকের ধন কন্যাকে কোন মতে ফিরে পেয়েছে।জীবন সাঁজানোর উপলক্ষ অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, এ সংসারে কিছুই জোটেনি স্বামীর ভালবাসা ছাড়া।ভালোবাসা উপেক্ষিত করার সাহস তার নেই, তাই এমন অনলে বিচরণ করতে তার বাধা ছিলনা, কিন্তু আজ নিজের সন্তানের দিকে তাকালে এসব দায়বদ্ধতার ভাষা তার কাছে ঝাপসা হয়ে যায়।ঘটনা লোক মুখে প্রসারিত হয়ে কল্পনার বাপের বাড়ি পোঁছে গেল।সেখান থেকে লোক এল কল্পনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।কল্পনার চোখ মুখের ভাষা স্তব্ধ। বাহারের সমস্থ ভাবনা কল্পনার স্তব্ধতার মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কি যেন খুঁজছিল।শ্বশুর বাড়ির লোকের কাছে নিজের স্বকীয়তা অনেক আগেই লুপ্ত হয়েছে। তাই শ্যালক থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে কল্পনাকে পলকে পলকে বাহার লক্ষ্য করতে ছিল।এক ধরনের শুণ্যতা, এক ধরণের অশনি সংকেত বাহারের মনে কেমন করে যেন ঝড় তোলে।স্ত্রীকে যথার্তই তার জানা, কিন্তু সেই চীর চেনা স্ত্রীকে আজ অচেনা লাগছে।বাহারের লোকানো দৃষ্টি দেখল, কল্পনার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কোন অনুকম্পা নেই, এ সংসারের প্রতি যেন তার কোন পিছুটান নেই।বাহার কেউ সে তার মধ্যে খুঁজে না, খুঁজলে সে হৃদয় এতক্ষনে জানান দিত।বাহারের বুঝতে বাঁকি রইলোনা স্ত্রীর বিদগ্ধ আত্মা যে টানে আজ ছুটে চলেছে সে পথ তার একান্ত। সত্যের মাঝে কঠিন সত্যকে উন্মুক্ত করার দিন আজ। আমি অক্ষম, আমি অপারক এ আমার আজন্ম কলঙ্ক,কিন্তু ভালবাসা দিয়ে সত্যকে বাঁধার প্রচেষ্টা কম ছিলনা আমার।আজ যদি এ সত্য উপেক্ষিত হয়, তাহলে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হয়ত থাকবেনা, তবুও মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে জীবন কে ধুকে ধুকে মরতে না দিয়ে সত্যের সন্ধানে যাযাবর হওয়াতে স্বার্থকতা আছে।কল্পনা চলে গেল, যাওয়ার সময় বাড়ির সামনের পথে বাহারের খুবই কাছাকাছি চুপিসারে বলে গেল, আমি চললাম তুমি বাবুকে দেখতে যেও।এর পর ঘোড়ার গাড়িতে চলন্ত পথে যতদুর চোখ যায়, কল্পনার আড় চোখের স্থীর দৃষ্টি বাহারের দিকে চেয়ে রয়।দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে কল্পনা চলে গেলেও বাহারের বুকে সে স্থীর দৃষ্টির রেখাপাত জীবন্ত হয়ে হৃদয় পটে আঁকা হয়ে রইল।বাহারের লক্ষ স্মৃতির ভিড়ে এই জীবন্ত স্মৃতির আধিপত্য তার সমস্থ চেতনায় অস্থির জোয়ারের মত বেগবান হতে লাগল।
পেজ-৮
আজ কি যেন বাহারকে শুন্য করল। তার সমস্থ অস্তিত্বকে জ্বালীয়ে শুন্য করে গেল।তার সমস্থ আকাশে আজ মেঘ।মেঘে মেঘে পরিপুর্ণ।মেঘে মেঘে ঘর্ষণে গর্জন হয়।বৃষ্টি নেই, তার পর ও মনের অজান্তে চোখের কোনে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।বাহার ডান হাতে সে জল পরখ করে দেখে।এর কি বর্ণ, এ কি নিছকই জল, নাকি হৃদয় নামক যন্ত্রের ঘুন পোকা, যা হৃদয়কে কুড়ে কুড়ে খেয়ে চক্ষু গহব্বর দিয়ে বের হয়ে এসে তার আধিপত্যকে জানান দিচ্ছে।কল্পনা বাপের বাড়ি যাওয়ার পর বাহারের নিস্তব্ধ দিন কাটে।এলো মেলো ভাবনা বিলাসে সে ছন্নছাড়া।শরীর,পরনের জামা কাপড় কোথাও এক ফোটা যত্নের ছোঁয়া নেই।চাকরী তে মন নেই।ধারাবাহিক ভাবে স্কুলে যায়না হটাৎ একদিন দু দিন আবার দ্বীর্ঘ বিরতী।প্রায় মাস হতে চলল, দ্বীর্ঘ সময় স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে তার মন অস্থিরতায় কাতর। স্ত্রীর ভালবাসার টানে সমস্থ উপেক্ষা করে আজ বাহার স্ত্রীর পৈত্রিক নিবাসে উপস্থিত হল।শ্বশুর বাড়ির লোকের ক্ষুদ্ধ জনরোস বাহারের সমস্থ অস্তিত্বকে পদতলে পিসে কল্পনা ও বাহারের ভালবাসাকে কলঙ্কিত করল। সেখানে কল্পনার দেখা বাহারের মেলেনি।শুধু লাঞ্চনা, গঞ্জনা অপমানের বিম্তর বোঝা মাথায় নিয়ে তাকে বিদায় হতে হয়েছে।কল্পনার সেই সময়ের অবস্থান, বাহারের আগমনী বার্তায় কল্পনার আত্ম জিঞ্জাসা কি ছিল?কোন কিছুই বাহারের চোখে ধরা দিলনা।বাহার ফিরে এল পৃথিবী সমান ধ্বংসস্তুপের মাঝে অসহায় পঙ্গু যোদ্ধার সীমাহীন যন্ত্রনা নিয়ে।সমস্থ ঘটনায় কিভাবে বাতাসে রটে যায়।মোবারকের স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত মন্ত্রটি এত দিন স্ত্রী আনোয়ারার বিদ্দেষপূর্ণ প্যানপ্যানানীর মাঝে আবদ্ধ ছিল।আজ চোখের সামনে ভাতিজার এমন করুন দশায় সে আর স্থীর থাকতে পারলনা।ব্যাপক খোঁজ খবর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে, তার নিজের অনুতাপ হতে লাগল।কেন সে এতদিন স্তব্ধ ছিল। তাই আর কালক্ষেপন না করে, সমস্যা সমাধানে স্ব উদ্যোগে সে বাহারের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল।মোবারকের কাছে তাদের অভিযোগের অন্ত ছিলনা। আনেক বড় মুখ করে আপনার সংসারে মেয়ে দিয়েছিলাম। আমার মেয়ের নিত্য করুন অবস্থা আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন, তখন তো আপনার মুখে আহা শুনতে পাইনি, আপনার ভাতিজা বদ্ধ উন্মাদ,সংসার কি সে বোধ শক্তি তার নেই।ছোট খাট সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু দিনের পর দিন যে অত্যাচার মেয়ের উপর হয়েছে,সেখানে আপনার কি কিছুই করার ছিলনা।আজ এসেছেন মেয়ের চাচা শ্বশুর হয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আবার নরকে ফেলতে, আমি তা কিছুতেই হতে দেবনা।মোবারক বেয়াইয়ের রোসানলে পড়ে কি বলবে উত্তর জানা নেই।শুধু অসহায় আত্মসমার্পন করে বিনয়ের সাথে বলল,অতীতে যা হয়েছে, ওদের সংসারে যদি সেই পরিস্থিতি বিরাজ থাকে, তো এখন থেকে সমস্থ দায়ভার আমার। আমি চাইনা আমাদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হোক।কল্পনার বাপের ক্রোধ কমল, কিছুটা নমনীয় ভাব দেখাল, তবুও নিজের কতৃত্বকেই প্রাধান্য দিয়ে বলল, আজকের মত যান বেয়াই, সময় করে আবার আসেন চা নাস্তা খাওয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আলোচনা করে দেখবো কি করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে আর কিছুই বলার ছিলনা মোবারকের।সম্ভাবনার দুয়ার খোলা রেখে মন কে আস্বস্থ করে সামান্য বিষন্নতা নিয়ে বাড়ী ফিরল।এদিকে ভেতর ভেতর মোবারক বংসে ধ্বংসযঞ্জের ঝড়ো বাতাসে বাহারের মতিভ্রমের বিষয়টি স্পষ্ট হতে লাগল। বাহার নিস্ব হয়েছে,সম্ভাবনা, ব্যার্থতা, জীবনের নেগেটিভ পজেটিভ এক যায়গায় লেপ্টে গিয়ে বিদ্যুতের শট সার্কিট থেকে আগুন লাগার মত, তার সমস্থ শরীর ঝলসে গেছে, ধোঁয়া আর লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার ব্যাপক নিস্তব্ধতার কারনে।শাস্তনবানুর সংসারে এখন তার পুরাপুরি কতৃত্ব, পুত্রবধুকে বিদায় করে সমস্থ কাজ এখন সে নিজেই করে।তবে শ্রী বিহীন, রান্না বান্না পাতিল পরিস্কার মন চাই করল, কিংবা খাওয়া পর্ব কোন মত সেরে অপরিস্কার নোংরা পাতিল উপর করে রাখল। সকালের খাবার যদি দেরি হয়, তবে ঘরে রাখা যবের ছাতু দিয়েই জাফর মিয়া খাওয়া পর্ব সারে।তার পর সমস্থ দিনই অবোধ বালকের মত নিশ্চুপ হয়ে থাকে।ছেলে মেয়ে কখন কি খেল- কি খেলনা সে খেয়াল তাদের মধ্যে নেই।এই হল ছন্ন ছাড়া সংসারের বর্ণহীন ব্যাকরন। তবে এই ব্যাকরন শাস্ত্রের আরেকটা অধ্যায় হল।বংসের বড় ছেলে স্ত্রী বিহনে পুরোপুরি দিশেহারা,তাকে এখন খাওয়ার খোঁটা শুনতে হয়। চাকরী বাকরি করেনা, বউ বিহনে তার পুত্র পাগল হয়ে যাচ্ছে,এমন অলক্ষি পুত্রকে খাওয়ন দেওয়া ঠিক না।বউ গেছে তো কি হয়েছে? অমন বউ এ সংসারের যোগ্য না।তার মতে বউয়ের দরকার হলে বিয়ে করতে হবে, তাই বলে কেঁদে কেঁদে বুক ভাষিয়ে সমস্থ কিছু জলাঞ্জলী দিয়ে সন্যাসী হওয়ার কি দরকার? সংসারে ভাল হয়ে থাকলে থাকুক , না পারলে ঐ রকম পাগল পোষা তার পক্ষে সম্ভব না।শাস্তণবাণুর মাতৃত্ব বোধ কোথায় গেল?পূর্ব সংসারে যখন শাস্তনের শ্বশুড়ি আমেনা বেঁচে ছিল,তখন দেখেছি শ্বাস্তনবাণুকে নিগৃহীত হতে,কিন্তু তার পুত্র জাফরের প্রতি তার সহমর্মিতার অভাব ছিলনা।মাতৃটানে ঘাটতি ছিলনা।আর আজ নির্যাতিত শাস্তনবানুর আত্মায় পেতাত্মা এমন ভাবে বাঁসা বেঁধেছে, যে জগতের সমস্থ মাতৃজাতকে কলঙ্কিত করার পয়গাম তার বিকৃত আত্মায় পেতাত্মার আশির্বাদ হয়ে সমস্থ মাতৃকুলকে রাক্ষসের মত ভক্ষন করে ফেলল।এমনও কি হয়?দশ মাস গর্ভে ধরে কি করে তা হয়।যাগগে এসব কথা, ঘটনা হল বাহার পাগল হয়ে গেছে, গ্রামের অনাচে কানাচে এ কথা ছড়াছড়ি হয়ে গেছে,বাহারের স্বাভাবিক চলাচলে কিছুটা পরিবর্তন দেখে গ্রামের মূর্খ সমাজ তাকে পাগল বানিয়ে ফেলল।এ কথা বাহারের শ্বশুর বাড়ি ও পোঁছে গেছে। বাহার মনে মনে হাঁসে , বিড় বিড় করে কি যেন বলে, আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, পাড়ার বৌ-রা নালিশ দেয় গোসল করার সময় বাহার ভাই সেখানে উকি দিচ্ছিল, রাতে গলাছেড়ে গান গায়, রাস্তায় মানুষ ধরে জিঞ্জাস করে, কল্পনা কবে ফিরে আসবে, না আসলে কি? সে আবার বিয়ে করবে।
পেজ- ৯
বাহারের আপন ছোট ভাই সেলিম মিয়া পাবনা শহরে বি, এ ক্লাসে অধ্যায়নরত।নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া সে বাড়িতে তেমন একটা আসেনা।যাবতীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে মোবারককেই তার আদর্শ বলে মানে।বাড়ির পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার স্বচ্ছ ধারনা আছে।আজ সংসারের এমন বিপর্যযে তার মধ্যে গভীর উদ্বেগ ঝড় তোলে।মাতৃস্নেহের মায়াবী সান্নিধ্য তার মনে নেই।সদর থেকে মাঝে মাঝে বাড়িতে গেলে এই ভাবিই তাকে মাতৃস্নেহের বিছানো আসনে আদর যত্নে ত্রুটি রাখেনি।আজ সংসারে নৈরাজ্যের কথা যখন তার কানে পোঁছে, নিজের সমস্থ পরিজনের মধ্যে এই পরিচিত মুখটি তাকে প্রচন্ড নাড়া দেয়।সেলিম বাড়ি এসে মোবারকের সাথে দফায় দফায় অলোচনা করতে লাগল।অনেক চেষ্টা তদবীরে কোন কাজ হলনা।মেয়ের বাপ এ বংসে মেয়ে দিবে না।মোবারকের হৃদয় ভারাক্রান্ত। বাহারের শ্বশুর বাড়ি অসহায়ত্বের মত ধরনা দিয়ে কোন কাজ হলনা।সমস্থ দেহে পরাজয়ের গ্লানী আজ তাকে মলিন করে দিল।সব কিছু মোবারকের কাছে কেমন ঝাপসা,সমস্থ যুক্তি তর্ক উপেক্ষা করে তাদের একটাই দাবী পাগলের সংসারে আমার মেয়েকে মরতে দেবনা।আর যাকে কেন্দ্র করে এই জটিলতা সেই কল্পনাকে একটিবারও বাহার পক্ষের কেউই আর দেখতে পেলনা।বাহার এলোমেলো মস্তিস্কে জীবনের পথ হাতড়ে হাতড়ে ফিরে। চাকরী অনেক আগেই গেছে। পুরোপুরি শুন্য হাতে আধা বিকৃত মস্তিস্কে এদিক ওদিক তার ছুটাছুটি। তার উপর শাস্তনবানুর কুট কৌশলী বাজে মন্তব্য বাহারকে স্থীর থাকতে দেয়না।প্রেমের পুঁজা অর্চনা করার শিক্ষা মুর্খ হৃদয়ে আলো দেয়না। কেবল কিটপতঙ্গের মত পরিতৃপ্ত ভোগে তারা খুশি।আদিম যুগের নেংটা খেয়ালে বাহার আজ বন্দী। চা বিড়ি খাওয়া বাহারের দ্বীর্ঘ দিনের অভ্যাস।কিন্তু যে বাড়িতে ভাতের নিরাপত্তা নেই, সেখানে চা বিড়ি…………….?অভ্যাসের পরিবর্তন তো আর চাইলেই করা যায়না।তাই সামান্য চা আর বিড়ির জন্য মানুষের কাছে হাত পেতে নিজের অর্জিত সম্মান গলাটিপে ধরে মারতে আজ তার দ্বীধা থাকলো না। সমাজ সংসার আজ তাকে পুরোপুরিই পাগল বলে আক্ষ্যায়িত করে পাগল উপাক্ষ্যান রচনা করতে লাগল। যা ঘটে তাও বলে, যা ঘটেনি তাও বলে।এ পরিবারের সাথে যাদের ঈর্ষন্বিত সম্পর্ক ছিল, তারা আজ মক্ষম সুযোগ পেয়ে এই দুর্বল মুহুর্তকে উস্কে দিতে লাগল। উপযুক্ত ছেলের ভার বহনের দায়ীত্ব পরিবার রাখেনা। সামান্য পকেট খরচার যোগান কেউ দিতে আসেনি। জাফর মিয়ার ভাবাবেগের বালাই নেই, অপর দিকে মোবারক যে কিনা স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত তার তো বোঝা উচিত ছিল….গতানুগতিক ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে জীবনের সমস্থ পরিমন্ডলে ইচ্ছা পরিব্যাপ্তি, আর্থিক সঙ্গতি এসবের যে যোগসুত্র তার পরিমাফিক যে চাহিদা, তা ক্ষুদ্র হোক আর বৃহৎ হোক তাকে অবঞ্জা করা মানে মানবতাকে অবঞ্জা করা।হোক তা বিড়ি সিকারেট সেটাও কারো হতে পারে অন্যতম চাহিদা। তাই বলে অধিকার হরনের জ্বালা এভাবে পথে পথে লুটাবে?আর কুলাঙ্গার শ্রেনীর লোকেরা তা সস্তা দরে কিনে পকেটে ভরবে, এতে করে যে অধিকার লুটায়ে দিল, তার যেমন অস্তিত্ব শুণ্য তার সাথে সম্পর্কিত পরিবারেরও সম্মানের ঘাটতি থেকে গেল।(এই যায়গায় মোবারকের স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত বাক্যটি বিস্তর শিক্ষার মাঝে কুল হারিয়ে দিশা পেলনা)কেউ যখন তার নিজের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে,তখন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন সস্তা উপকরনকেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়।সব বাদ দিয়ে কিভাবে পাগল ঠিক করা যায় এই পর্ব শুরু হল।পাগলামীর পরিমান কতটুকু উদ্রেককারী ছিল তা যাচাইয়ের আবশ্যক ছিলনা। চলাফেরা আচার অচরনে স্বভাবিক স্বকীয়তা নেই, তাই পাগলা গারদই হওয়া উচিত তার উপযুক্ত ঠাঁই।পাগলের বৃহৎ চিকিৎসা পাবনাতেই হয়।এক দিন ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করে সবাই মিলে জোর পুর্বক ধরাধরি করে টেনে হিঁচড়ে রশি দিয়ে বেঁধে বাহার কে পাগলা গারদে নিক্ষেপ করে দিল।কর্তব্যরত ডাক্তাররা বাহারের মধ্যে পাগলামির আলামত পেলনা। তবুও এক দেড় মাস তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দিল।বাড়িতে ফেরার পর সেই একই বাহার যে লক্ষনগুলো তার মধ্যে পুর্বে বিদ্যামান ছিল এখনও তাই রয়েছে। বিষয়টা এবার জাফর কে শঙ্কিত করল। পুর্বে পুত্র নিয়ে মাথা না ঘামালেও এই কিছুদিনের মধ্যে এলাকার লোকমুখে বিভিন্ন এলাকার পাগল ও পাগলের কর্মকান্ড সমন্ধে ভুতুড়ে মন্তব্য শুনে জাফর মিয়া শঙ্কিত। তাই উদ্ভুত ঘটনা যাতে না ঘটে, এখান, ওখান থেকে কিছু চেয়ে না খায়, এসব বিষয়কে আমলে নিয়ে বাজার থেকে শিকল কিনে বাহারের পায়ে তালাবদ্ধ করে দিল।বাহারের জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট রইলনা। সমগ্র সমাজ, আকাশ বাতাস আজ পাগল পাগল ধ্বণীতে বাহারের মস্তিস্ককে উন্মাদ করে দিল।শিকলে বাধা সুঠাম দেহ শিকল ভাঙ্গার কাজে তার সমস্থ শক্তি ব্যায় করল। কাজ হলনা। এরপর নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আস্তে আস্তে যখন দুর্বল হতে লাগল,তখন করুনা চিত্তে জাফর মিয়া একদিন সে তালা খুলে দিল। এরপর আর বাহারকে পায় কে? সমস্থ গ্লানী পেছনে ফেলে তিক্ততা পুঁজি করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল বাহার।কোন দায়বদ্ধতা নেই, কেবলি নিজের মনে খেয়ালী স্মৃতি আওড়ায় আর অবারিত প্রশস্থ পথে উন্মুক্ত পথ চলায় সে স্মৃতি তার পুঁজি হয়ে রয়।স্মৃতি হাতরেই তার সুখ কখনও হাঁসে আবার কখনও নিস্তব্ধ নিরবতায় সে স্মৃতি ধুষর ধুলিঝড়ে তার সমস্থ পৃথিবী উলট পালট করে দেয়। এর পর হৃদয়ের টানে আপন ভিটামাটির টানে তার হৃদয় যখন থমকে দাঁড়ায়, তার জীবন তৃষ্ণার দেবী স্ত্রীর স্মৃতি যখন মনে পড়ে, জীবনের অর্ধেক বসন্তের উপাক্ষ্যান যেখানে রচনা হয়েছে, সেই যায়গার সেই সব মুখ যখন তার মনে পড়ে, কিংবা সব হারিয়ে রাস্তার ভিখারী হওয়ার যে তিক্ত অভিঞ্জতা তা হজম করতে না পেরে যখন বাড়িতে তার পুন আগমন, তখন দেখে সে আগমনের বার্তা হাস্যরসে ভরা, গ্লানী মাখা যেখানে তার নিজের বলে কিছু নেই।তারপরও সে এ বাড়ির সদস্য ছিল এ তার মনের জোর। শাস্তনবানু অনেক আগেই পুত্র দায় ছেড়ে দিয়েছে।বাড়ির প্রভুভক্ত কুকুরকে দু মুঠো ভাত দেওয়া যেমন মালিকের কর্তব্য, ঠিক খানকা ঘরে আশ্রয় নেওয়া বাহারের অধিকারও কুকুরের মত উপেক্ষিত হতে থাকল।এরপর একদিন সিকারেটের টাকা জোগাড় করার জন্য ঘরের চেয়ার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বাহার মার খেল, মোবারকের মেজ ছেলে কেরামতের হাতে। কেরামতের সে কি গর্ব পাগল মেরে তার ব্যাপক সুখ্যাতি। সবাই বলাবলি করতে লাগল, অত্যাচার শুরু হয়েছে কেরামত যদি আজ তাকে না পেটাত এমন উৎপাত চলতেই থাকত। শাস্তন বানু বলতে লাগল ও জাতি পাগল যথেষ্ট শিক্ষা না হলে শেষ পর্যন্ত সংসার নিলামে তুলত।মান সম্মান যা গেছে এখন সংসারে হাত দিছে,(এই পর্বে মোবারকের স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত মন্ত্রের আলামত পেলাম না)এরপর আবার উধাও, আবারের আগমন। এবারের আগমন স্থায়ী হলনা। বাহারের তৃতীয় ভাই রোকন তাকে ধরে পেটাল, রোকনের হাত থেকে ছুটে বাহার দৌড় দিল। আর রোকন বাহারের পিছু পিছু দাও নিয়ে ধাওয়া করে এলাকা ছাড়া করল।আতঙ্ক আর ঘৃনায় এ বাড়িতে বাহারের পা আর কোন দিন পড়েনি। এরপর বিশাল ভ্রমান্ডকেই সে তার বাড়ি বানিয়ে ছিল।আর প্রশস্থ জনপথ ছিল সে বাড়ির উন্মুক্ত দরজা।