পর্ব-১
বাংলাদেশের দক্ষিন দিকের একটি জেলার নাম ফেনী। সেই ফেনী জেলার একটি উপজেলা ফুলগাজীর একটি গ্রাম শ্রীবোররা। সেখানে একটি পরিবার বংশ মজুমদার বাড়ি নামে পরিচিত। সেই পরিবারে জন্মম অামার। অামার পরিবারের চোট্ট একটা ইতিহাস অাছে যা নিয়ে অামি গর্ব করি। সেই ইতিহাসের একটা অংশ অামি বলবো বলে অাজ লিখতে বসেছি।
অামার বাবারা ৩ ভাই ছিলেন, সালাউদ্দিন মজুমদার, মোসলেহউদ্দিন মজুমদার ও অালাউদ্দিন মজুমদার।
সময়টা ১৯৭১ সাল, ভালই কাটছিল সবকিচু। বড়ভাই সালাউদ্দিন অার ছোটভাই অালাউদ্দিন পারিবারিক বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করতো অার মেঝো ভাই মোসলেহউদ্দিন পড়াশোনার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের হলে থাকতো। পড়াশুনা করতো রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স।
এরই মধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার ডাক এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্সের ঘোষনা থেকে, সবাই বুঝে নিয়েছে এখন সময় এসেগেছে লড়াই এর। সারাদেশ যখন উত্তাল তখন ই বাড়ি থেকে ছিঠি গিয়েছিল মোসলেহউদ্দিন মজুমদারের কাছে। বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
বাড়ি ফিরে গিয়ে গ্রামে ভাইদের সাথে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে অালোচনা হতো এরই মধ্যে ২৬ ই মার্সে কলুরঘাট বেতার থেকে অানুষ্ঠানিক ঘোষনা এলো। সারাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হলো অার মুক্তিযোদ্বা সংগ্রহ করা হচ্ছিলো।
এরইমাঝে মোসলেউদ্দিন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোলাম মোস্তফা সহ যোগদেন ২ নং সেক্টরের রাজনগর সাবসেক্টরের প্রশিক্ষক শিবিরে। যা ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধীনে ছিল। দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন বিরউত্তম জাফর ইমাম। যার বাড়ি ছিল অামাদের পাশের গ্রাম নোয়াপুরে।
সাথে সাথে অমার বাবা অালাউদ্দিন ও গ্রামের অারেক চাচা চলেযান ইন্ডিয়ার চোত্তাখোলা ট্রেনিং ক্যম্পে। বড়চাচা সালাউদ্দিন থেকে যান বাড়িতে দেখাশুনার জন্য। অধম্য ইচ্ছা সত্বেও যেতে পারেন নি পরিবারের জন্য। কারন অামার দাদা বেঁচে ছিলেন না তখন। সমস্ত বাড়ির দেখাশুনা বড়চাচ করতেন। অবশ্য তিনিও পরে যুদ্বেই শহীদ হয়েছিলেন। তা একটু পরই লিখছি।
তো অামাদের ওই এলাকায় জুনের পর পাকিস্তানিরা বিলোনিয়া দখল করে নেয় ও বিলোনিয়া সহ ফেনী উদ্বারে এই এলাকার যুদ্বগুলো হয়। অামার অাব্বারা জেনারেল মুক্তিবাহিনিতে কাজ করলেও চাচা কে অারো দুজন নিয়ে পাইওনিয়ার প্লাটুন এর একটা টিমের প্রধান করে পাঠিয়ে দেয়া হয় রণাঙ্গনে। উনাদের কাজ হলে পাকিস্তানিদের পথে বাধা তৈরি করা।ডিনামাইট ব্যবহার করে ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙ্গে দেয়া ও বোমা ফাটিয়ে অাতঙ্ক তৈরি করা।
ভালই চলছিল সব, কিন্তু চাচা মোসলেউদ্দিন চাইছিলেন অস্ত্র হাতে যুদ্ব করবেন। যদিও তার অনুমতি ছিলনা তার।
যখন বিলোনিয়ায় যুদ্ব তুঙ্গে তার মধ্যে সব ভুলে মোসলেহউদ্দিন হাতে বন্ধুক তুলেনিলেন। তুমুল যুদ্ব চলছিল বিলোনিয়া রণাঙ্গনে। হঠাৎ একটা অনাকাঙ্খিত বুলেট এসে অাঘাত করলো চাচার পায়ে।
খুব সাহসী ছিলেন উনি বলেছিলেন অামার কিচুই হবে না। অাঘাতপ্রাপ্ত পা দড়ি দিয়ে ঘলায় বেধে ভর দিয়ে ফিরেছিলেন বাসায়। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না। যার পরিনতিতে ২৭শে অক্টোবর ১৯৭১ এ ঢলে পড়লেন মৃত্যুর দরজায়। ২৭ তারিখের পর কোনদিন তিনি অার অস্ত্র কিংবা গ্রেনেড হাতে অার বের হন নি।
বাড়িতে সংবাদ এলো, সবাই স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল। বাবারা ফিরে এসেছেন এর মধ্যে। অামার দাদু বাকরুদ্ব হয়ে গিয়েছিলেন। শোকের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল মজুমদার বাড়ি সহ পুরো এলাকা। এলাকার সবচেয়ে অধুনিক ও শিক্ষিত মানুষটা অার নেই এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলনা ।
তবে পুরো এলাকা একটা গৌরব নিয়ে সেই শোক কে চাপা দিয়েছিলেন।
সেই গৌরব টা ছিল স্বাধীণতার।
চাচা মোসলেহউদ্দিন ছিলে অামাদের ওই এলাকায় অনেক মুক্তিযোদ্বার মাঝে একমাত্র শহীদ। তার নামের অাগে এখন নতুন শব্দ যুক্ত হয়ে নাম হলো শহীদ মোসলেহউদ্দিন মজুমদার।
পর্ব- ২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্বের পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, সময়টা ১৯৮০ এর দিকে। বড় চাচা ছালাউদ্দিন মজুমদার চলেযান লেবানন চাকরির উদ্দেশ্যে। তখন সেখানে চলছিল খ্রিষ্টান ও মুসলিম অারবদের মাঝে যুদ্ব। যেটা লেবনিজ সিভিল ওয়ার নামে পরিচিত। এক পর্যায়ে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ Palestine Liberation Organization(PLO) এর সাথে খ্রিষ্টান চরমপন্থি সংগঠন Maronites ও ইজরায়েলি ইয়াহুদি দের সাথে চরম যুদ্ব বাধে। তখন PLO এর সাথে লেবানন এর মুসলিমরা যোগ দেয়।
অামার বড় চাচা তখন লেবাননে চিলেন এবং উনি এই সংগ্রাম থেকে বঞ্চিত হতে চান নি। অতএব, ১৯৮৭ সালে যোগ দিলেন লেবানন এর পক্ষ থেকে Palestine Liberation Organization এর সাথে। শুরু করলেন যুদ্ব মুসলিম ফিলিস্তিনের পক্ষে। ১৯৮৯ সালের কোন এক শুভক্ষনে ফিলিস্তিনি ইহুদি ও খ্রিষ্টান দের সমন্বিত বাহীনির এক অচেনা শেল এপার ওপার করে দেয় অামার বড় চাচার বুক। ঢলে পড়েছিলেন তিনি ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে। অার অামার দাদু ধনবিয়া মজুমদার (মৃত্যুসাল ২৮ ই জানুয়ারী ২০০৮) হারিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় রক্তাক্ত সন্তান কে।
বলুন তো অামার দাদুর কি কথা বলার কোন শক্তি ছিল তখন?
না, ছিল না। উনি কথা বলেননি বহুদিন
অার মৃত্যুর অাগ পর্যন্ত যেভাবে কথা বলতেন তা অামরা পরিবারের মানুষ ছাড়া বাইরের কেউ বুঝতো না।
অার অামার বাবা একা হয়ে পড়লেন।
অামার বাবা অালাউদ্দিন মজুমদার অাছেন অাজো অাপনাদের দোয়ায়। একা, বহু দু:খ বুকে অাজো বহন করছেন তিনি।
মেঝো চাচা মোসলেহউদ্দিন মজুমদার পেচনে কোন সন্তান রেখে যান নি। বড় চাচা অার অামার বাবার পরিবারের সদস্যদের তালিকা নিচে দেয়া হলো।
ছালাউদ্দিন মজুমদারের,
স্ত্রী- রোশনারা মজুমদার
সন্তান:
১. মিজানুর রহিম মজুমদার
২.মিজানুল ইকরাম মজুমদার
৩. মিজানুল করিম মজুমদার
৪. তাহমিনা অাক্তার মজুমদার
৫. মিজানুর রহমান মজুমদার
অালাউদ্দিন মজুমদার এর,
স্ত্রী- অায়েশা খাতুন মজুমদার
সন্তান:
১. ফেরদোস অারা মজুমদার
২. সালমা অাক্তার মজুমদার
৩. রোকেয়া অাক্তার মজুমদার
৪. সাইদুল ইসলাম মজুমদার
৫. ফারহানা অাক্তার মজুমদার
৬. সাইফুল ইসলাম মজুমদার (অামি)
অামি পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান।
অামি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকে স্বাধীনতা অার মুক্তিযুদ্বের গল্প বাবা, দাদু দের মুখে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।
যখন অামার বয়স ৪ শেষ হলো তখনই অামায় নিয়ে যাওয়া হলো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। অামার সাথে অামার গ্রামের অারেক চাচতো ভাই কে ও নেয়া হয়েছিল। স্কুল অথরিটি অামায় ক্লাস ১ এ ভর্তি করিয়ে নিল ৪ বছর বয়সেই, কারন অামি শহীদ ও মুক্তিযোদ্বা পরিবারের সন্তান, কিন্তু অামার কাজিন কে ভর্তি করলোনা কারন তার ৬ বছর এখনো হয়নি!!!!
অামি সেই বয়সেই অবাক হয়েছিলাম কেন অামায় পড়তে দিল কিন্তু তাকে দিলোনা। কিন্তু এখন বুজতে পারি যে অামার অালাদা কৌটা ছিল। যেটা তখন শুধু সামাজিক ছিল এখন রাষ্ট্রীয় কৌটায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু অামি সত্যি বলছি অামার পূর্ব পুরুষরা শুধু নিজেদের জন্য জীবন দেন নি কিংবা অস্ত্র হাতে নেন নি। পুরো দেশকে স্বাধীন করে সবার সমান অধীকার নিশ্চিৎ করতে যুদ্ব করেছিলেন।
যখন থেকে অামি বুজতে শুরু করেছিলাম, তখন সিদ্বান্ত নিয়েছিলাম কখনো সাধারণ একজন বাঙ্গালীর চেয়ে নিজেকে বেশী কিচু ভাববো না। ব্যাবহার করবো না কোন এক্সট্রা সুবিধা।
অামি অাজ "ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের" ছাত্র, গর্ব করে বলছি অামি সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে এতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি। মুক্তিযোদ্বা পরিবারের সন্তান হিসেবে না।
অামার শক্তি অার সাহসের স্থান তো অামার ইতিহাস। অামার পরিবার অামার দেশ অামার জাতী অামার ধর্ম। অামার সত্যিই অাজ গর্ব হচ্ছে অামি শহীদ মুক্তিযোদ্বা পরিবারের সন্তান। অামার পরিবারের ইতিহাস শুদু দেশে নয়, দেশের বাইরে ও তৈরি হয়েছে। অামার অার কিচুই চাওয়ার নেই, এই ইতিহাস বুকে নিয়ে অামি ও অামার বাকি পরিবার হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারবো ইনশাঅল্লাহ।
সাইফুল ইসলাম মজুমদার
২য় বর্ষ,যন্ত্রকৌশল বিভাগ
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(ডুয়েট)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৩