সজাগ ঘুমে আমরা মনগড়া স্বপ্ন দেখি। কাঁচাঘুমে দেখি দুঃস্বপ্ন, আধোঘুম আধোজাগরণে দেখি সাতরঙা স্বপ্ন। গভীর ঘুমের স্বপ্নরা সাদা কালো হয় এবং অজ্ঞাত কারণে আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। গূঢ়তত্ত্ব জেনে স্বপ্নাদেশ পাওয়ার জন্য পলাশমিঞা স্বপ্নলোক প্রবেশ করলে আনন্দকাননের মালিকের সাথে সাক্ষাৎ হয়। চাকলার লোকজন জানে উনি অনেক বড় দাতা। গরিব অসহায়কে দু হাতে সাহায্য করেন। সব উপাধি এবং পদবি উনি বগলদাবা করেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সকল শ্রেণীর লোকজন আনন্দকাননে আসে। বরাবর রাত বারোটায় পলাশমিঞাকে দেখে চিল্লাচিল্লি করে আনন্দমিঞার গলা শুকায়। সে চারপাশে তাকিয়ে বিদ্রূপ হেসে বললো, "খুব আরামে আছিস, কেমনে কী করলে? তুই কবে এতবড় দাতা হলে? তুই তো টানাটানি করে কাঁথা ছিঁড়তে, নুনের জন্য বাজারে গেলে তোর পান্তা ফুরাত।"
আনন্দমিঞা দুহাত দিয়ে ইশার করে শুষ্কগলায় বললো, "সব নিয়ে যাও।"
"তুই কবে আনন্দমিঞা হলে? তুই তো অন্যকে নিরানন্দ করিস। সামান্য সাহায্যের জন্য যারা তোর কাছে আসে তুই তাদের পুকুরচুরি করিস, তবুও তুই দাতা নাম পেলে কেমনে? চোর বদমাশ কালোবাজারি তোর বশ্য হলো কেমনে? আমাকে বুঝিয়ে বল, আমিও তোর মত দাতা হতে চাই।"
"আমি মরতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করো। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই। তুমি সব নিয়ে যাও।"
পলাশমিঞা মাথা নেড়ে পিছু হেঁটে বললো, “আমি তোর কিছু চাই না। আমি তোকে অভিশাপ দেব না। তোকে অভিশাপ দিলে বাংলার সন্তানরা শাপবুলি শিখে অভিশপ্ত হবে। আমি তোকে আঘাত করব না, আমার সন্তানরা হন্তা হবে। আমি তোকে তোর নরকে রেখে যাব। অনুতাপের আগুনে জ্বলে তুই গলাফাটিয়ে বলবে, আমি বিশ্বাসঘাতক। সবার সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। তোর জন্য করুণা হয়, তোর আত্মা তোর সাথে প্রতারণা করেছে। নামে আনন্দমিঞা হয়েও তুই নিরানন্দ।"
পরদিন পাঠাগারে বসে পলাশমিঞা গল্প পড়ছিল…
বিশেষ কিছু তারিখে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে মন যা বলে তা করি কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। ভাষার জন্য তাজা রক্ত দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রাণের বনিময়ে আমরা দেশ পেয়েছি। আমাদের বীরযোদ্ধারা ভিক্ষা করেন। দেশ এবং ভাষাকে ছালায় ভরে দালালরা দালালি করে। দেশে বাছবিচার থাকলেও বিচার বিবেচনা নেই। সত্যাসত্য জেনে খবু কষ্ট হয়। শুদ্ধাশুদ্ধের অর্থ জেনে শুদ্ধাচারে শুদ্ধত্বের পাশ ভিড়তে চাই না। বাংগালি বানান নিয়ে আমরা এখনো সন্দিহান। বায়ান্ন এবং একাত্তরে কয়েক লক্ষ মানুষ মরেছিল। তাদের কথা এখন আর কেউ বলাবলি করে না। কিছু লোকের জন্ম হয় ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য, আর কিছু লোকের জন্ম হয় সেই ইতিহাস নষ্ট করার জন্য। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, চাইলেও সত্যাসত্যা জানা হবে না। অনিয়মের নিয়ম ভাঙতে পারলে ঐক্যস্থাপন এবং শান্তিস্থাপন হবে। বয়স বাড়তে শুরু করলে জীবরা আজিব হয়। কামরিপু আস্তে আস্তে শক্তিশালী হলে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। সুন্দরীরা মির্মির করে তাকায়। বোকারা মারামারি করে মরে। বন্যদের সংগম মৌসুম আছে। ভদ্ররা বারোমাস সহবাসে অভ্যস্ত। আমরা কত আগে সভ্য হয়েছি তা জানতে হলে বানর অথবা কুমিরকে প্রশ্ন করতে হবে। আমি জানি আমরা সভ্য হয়েছি কয়কে হাজার বছর আগে। তারপরেও মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি আমরা সভ্য হয়েছি? আসলে কী হয়েছে সভ্যতার অর্থ আস্তেব্যস্তে বিলুপ্ত হচ্ছে। যুগ এখন অত্যাধুনিক হয়েছে। আধুনিকযুগ অনেকাগে আত্মহত্যা করেছে। মানুষ ধর্মবিমুখ হচ্ছে, এই বিষয়ে বিশদ বিশ্লেষণ আছে। আমি বিশারদ নই। আমি যা বলতে চাই তা হলো, আমরা দিনানুদিন নির্লজ্জ হচ্ছি। দেশে ধর্ম এবং সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আধুনিকতার নামে আদিমযুগে ফিরে যাচ্ছে মানবতা। কল্পান্তের অপেক্ষায় আমরা অপেক্ষমাণ। উদজান এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাস নিঃশেষ হলে সূর্য আর জ্বলজ্বল করবে না, হয়তো সেদিন আল্পনার আল্পনা এবং স্বপনের দিবাসপ্নের মৃত্যু হবে। চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া এবং চোখের কোণে জল জমে শুকিয়ে চড়চড় করা এক হতে পারে না। আমার মন খারাপ হলে আমি মারমোখু হই। ভাঙতে চাই, কাটতে চাইলেও না পারার কারণ আমি গড়তে পারি না। অতিষ্ঠ হয়ে কাঁদতে চাই, কখনো সফল হই কখনো হই ব্যর্থ। ছোটকালে দাঁ হাতে দৌড়াতাম। ছোটকালে শুনেছিলাম কাঁদলে মন হল্কা হয়। আমি শুধু পাপমোচনের জন্য কাঁদি। গল্প বলার সময় স্বপন এবং আল্পনার চোখে যেমন জল টলমল করেছিল। অন্নকষ্টে তাদের খুব কষ্ট হয় কিন্তু আমি খুনি হতে চাই না। আমি হন্তা হলে ওরা দাঁত কটমট করে বলবে, আমরা না খেয়ে সুখে ছিলাম, তুমি কেন তাকে হত্যা করলে? তুমি ভালোমানুষ নও, তুমি পাপ করেছ। আল্লাহ তোমাকে উচিৎ শাস্তি দেবেন। এইতো কদ্দিন আগে আল্পনার সাথে দেখা হলে ওর বাবার কথা বলেছিল। আমি আমার অক্ষমতার কথা বললে বলেছিল, তোমরা সবাই এক কথা বলো। তোমাদের কাছে টাকা নেই। জানো, আমার বড় বোন কাজের জন্য শহরে গিয়েছিল। এক কুটনি ওকে ফুসলিয়ে নিষিদ্ধ পল্লিতে বিক্রি করেছিল। চাইলেও এখন আর ওকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। ও এখন সূর্যের আলো ভয় পায়। ছোট ভাইকে কাঁখে নিয়ে মা ভিক্ষা করে। বাবা যে কবে মরবে তা কেউ জানি না। কাকডাকা ভোরে উঠে স্বপন একলা কাজে যায়। আমাকে সাথে নেওয়ার জন্য কতদিন মিনতি করেছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করে না। এক রাতে মাকে দেখার জন্য বোন এসেছিল। মা'র সাথে কত গল্প করেছিল। সে-কি হাসি! খিল খিল করে হেসেছিল আর বলেছিল, জানো মা? ভদ্রলোকরা আমাকে ঘৃণা করে। তাদের ছেলে মেয়েরা আমাকে দেখলে নাক সিঁটকায়। দিনে ঘৃণা করলেও রাতের একেক প্রহরে বাপ বেটা আমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে ভিখারির মত আকুতি মিনতি করে। আমার খুব হাসি পায়। তখন তাদেরকে চড়চাপড় মারলেও কিচ্ছু বলে না। দিনেরবেলা ওরাই আমাকে বাজারি মেয়ে ডাকে। দিন রাত বাসায় কাজ করিয়ে পেট ভরে খেতে দিতো না। মেমসাবরা তাড়ু দিয়ে আমাকে মেরেছে। গোসল করার জন্য সাবান দিতো না, কিন্তু চুলে ধরে পিঠে কিল বসিয়ে বলতো তোর গতরে গন্ধ করে। মেমসাব বাসায় না থাকলে গায়েরজোরে সাহেব আমাকে সম্ভোগ করতো। মাসের পর মাস কাজ করিয়ে বেতন দিতো না। ওরা নাকি সভ্য মানুষ? দরদে গদগদকণ্ঠে ভাষণ দেয়। ভালো কাপড় পরে গটগট করে হাঁটে। এখন আমিও তাদের মত হয়েছি। প্রতি ভোরে সূর্য উঠে, আমিও উঠি। সাবান শ্যাম্পু লাগিয়ে নিশিজলে গোসল করে নিষ্পাপ হই, গতকালের আগামী কাল যেমন আজ হয় তদ্রূপ আমিও বদলাই।
গল্পের বই বন্ধ করে পলাশমিঞা বেরিয়ে যায় এবং পরদিন ভোরে স্বপ্নবৎ মোট কাঁধে ফেরিওয়ালা বেশে রঙবেরঙের স্বপ্নের ফেরি নিয়ে বেরিয়ে সবাইকে রঙিন স্বপ্ন উপহার দিলেও কেউ তাকে দোরঙা স্বপ্ন দিতে চায় না। লাউতলে বসে এক ফকির জপজিগির করছিল। বাম পাশে লাউর ডুগডুগি। গোসল করে ফকির যে গতরে তেল মেখেছে তার প্রমাণ লাউয়ের চাকচিক্য। ফকির শমদমে আল্লাহু জপছিল। লাউ ঝাঁড়ের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় পলাশমিঞা হেঁকে বললো, "স্বপ্ন নেবে স্বপ্ন, রঙচঙে রঙিন স্বপ্ন। আমার দোরঙা স্বপ্নে কেউ কি স্বপ্নচারিণী হবে?"
ফকির হাসতে হাসতে হেঁকে বললো, "সুখস্বপ্ন কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত অবান্তর এবং অস্তিত্বহীন বস্তু। স্বপ্নোত্থিত হলে ভাঁড়ের ভিতর ঢুঢু শব্দ হয়।"
ফকিরের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে পলাশমিঞা বললো, "স্বপ্নরা এত ফাঁকিবাজ কেন? আমি তো বিনিময় চাই না। স্বপ্নদর্শীর জীবন স্বপ্নিল হলে আমি খুশি হব। আচ্ছা ওস্তাদ, স্বপ্নপুরের পরিবেশ স্বপ্নের মতো আজগুবি হয় কেন?"
"হাঁকতে থাকলে জবাব পাবে।" বলে ফকির চোখ বুজে। তখন তমসা ঘাটে মানসী বসে ভাসা ভাসা ঘটি জলে হাবুডুবু খায়। ড্যাবড্যাবে চোখের আয়ত ভাষাহীন অনুজ্জল ভাব জলে পড়ে সমুজ্জ্বল হয়। তা দেখে পলাশমিঞা স্বপ্নঘোরে আচ্ছন্ন হয়। ফকিরের কণ্ঠ এবং ডুগডুগির ধুন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়…
“নিঠুর ময়না রে, রূপার বাটি দিলাম তোরে, দিলাম সোনার ঘটি। দুধ কলা দিতাম তোরে আমি খাইতাম পাউরুটি। নিদান কেটে সুদিনে তুই উড়লে, আমি মরলে সার হবে কান্দাকাটি। নিঠুর ময়না রে, পোঁটলা পিঠে পেটরা কাঁধে স্বপ্ন রাখার নেই পেটি। জামায় তালি, জুতায় তালি, শত তালি অঙ্গে আমার সঙ্গী হয়েছে ফেট্টি। লোকে বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক স্বপ্ন নাকি পাশা খেলার ঘুঁটি।”
গান শেষ হলে ফকিররে দিকে তাকিয় পলাশমিঞা বললো…
“ওস্তাদ! সুসিদ্ধির জন্য সিদ্ধি ঘোঁটে জল গিলতে হয় নাকি?"
“মানসীর সাথে তনুমিলন হলে দোরঙা স্বপ্ন হয় রঞ্জা। সিদ্ধি গাছের জটা থেকে প্রস্তুত মাদকের নাম হল গাঞ্জা। মনে রাখিস, সাধনালয়ের কাঁসার বাসনে পবিত্র জল থাকে, সে জলে পুণ্যস্নান করে সাধক পবিত্রতা লাভ করে পরিতৃপ্ত হয়।"
"আপনার কথার অর্থোদ্ভেদ শুধু তখন হয় যখন আমি বিমনা হয়ে লাউতলা বসে লাউ বাজাই।"
"কামনার ঘাটে আমি আধমরা হয়ে পড়ে আছি। আয় দোকলা হবে।"
"মানসীর বিধুবদন মনের আয়নায় ভাসলে, বুকে ঢেঁকির পাড় পড়ে। বাড়াবাড়ি করে চিঁড়েচ্যাপটা হতে চাই না।"
"অলস দুপুরে পাখির চিঁচিঁ ভালো লাগে কণ্ঠলগ্নে ক্ষীণ আর্তনাদ। মানসীর কামার্ত চোখে ঝিলিক দেয় প্রাণবন্ততা।"
"আহা বরষা, তোমাকে খুব মনে পড়ে। বরষা তুমি ফিরে আসো, আমি প্রাণবন্ত হতে চাই।"
"জংলায় চলে যা, সব পাবে।"
"মনের বনে বনচারী হয়ে আপনি হয়েছে বনপাগলা। নিষাদের মত আমি হতে চাই একলা।"
“তুই নিশ্চয় জানিস, সাধ্যসাধনায় সফল হলে সফলতা দোকলা হয়।"
"এতসব চিন্তা করেন কেমনে?"
"লাউতলে বসে দিনমান ধেয়ানচিন্তা করি তো তাই হয়তো অজানাকে জানতে শুরু করেছি।"
“কল্পনাপ্রবণ হওয়ার জন্য কল্পবৃক্ষের ছায়ে বসতে চাই। উপদেশ করলে উপদিষ্ট হব।”
"সাধকের কাজ সাধনা, উপদেশ দেওয়া নয়।"
"আপনি নিশ্চয় জানেন, আল্লাহর ইশারা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। ধেয়ানে বসার জন্য মন আনচান আনচান করে। আপনি বলেছিলেন কে কী বলে তাতে কী আসে যায়?”
"যারা শিখতে চায় ওরা শিখবে, যারা শিখতে চায় না তাদেরকে মারধর করলেও শিখবে না। আমি শিখতে চাই। মনের জানালা খুলা আছে। যখন মন চাইবে লাউতলে চলে আসবে। গপসপ করব।"
"সাধক হতে হলে ভণ্ডের গালমন্দ গায়ে মাখতে হয়। সেই কবে আমি বেহায়া হয়েছি। আপনার খুঁজে লাউতলে এসেছি।"
"আমি কাউকে উপদেশ দেই না। আমি শিখতেই আছি। আমাদের চারপাশে যা আছে তা হলো জাঁকজমক আর লোভ। সাধনার সময় নেই। শুধু অর্থচিন্তা। পানির বিল, তেলের বিল দিয়ে ঘামের জলে নাক ডুবে। অনেকে জানে না এবং অনেকে জানতেও চায় না, শিক্ষায় শাক্ষির্থী মোক্ষপ্রপ্ত হয়।"
"আপনার ভাব এবং ভাষা সাক্ষ্য, আপনি একজন সত্য চিন্তক।"
"চিন্তকের কাজ সৃষ্টিকর্তার ইবাদতি করা। অহংকার শয়তানে গর্ব। অস্মিতাকে আমি ঘৃণা করি। বাবংবার আমার সামনে প্রেম নিবেদন করে। অন্তরের কুমন্ত্রনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আমি আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।"
"ওস্তাদ, আমি সামান্য সুখ চাই।"
"মনে কোনোরকম অনুভব না থাকা এবং অক্লেশে হাসার নাম সুখ। হাসি খুশি জীবনের অংশ। এতদিনে নিশ্চয় জেনেছিস, যারা জানার ওরা জানে এবং লাথের কাঁঠাল জাঁকে পাকে না।"
"বুঝেছি, সাধুচিন্তায় চিন্তক হওয়ার সময় হয়েছে।”
-সমাপ্ত -
© Mohammed Abdulhaque
বইর নাম আঠোরাটা অসমাপ্ত প্রেমোপন্যাস
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ২:৪৫