পৃষ্টা ১৮-১৯
‘নানাজান।’ বলে রাহীম অপলকদৃষ্টে তাকালে তার চোখ ছলছল করে। গায়ের জোরে তাকে জরিয়ে ধরে বুক ভরে শ্বাস টেনে নানা বললেন, ‘পাঞ্জা অথবা কুস্তিতে দাদাকে হারাতে পারিনি। দাদাকে হারাতে পারলে তুই কুস্তিগির হবে। তোর সাথে পাঞ্জা ধরলে কবজি ভাঙবে।’
দাদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘বেয়াই, কী হয়েছে?’
‘গূঢ়তত্ত্ব শুধু আপনি আমি জানি।’
‘রাহীম, আমাদের সাথে আয় তোর সাথে কুস্তি করব।’ বলে দাদা হাঁটতে শুরু করলে নানা উনাকে অনুসরণ করেন। নদীর ঘাটে যেয়ে নানার দিকে তাকিয়ে দাদা বললেন, ‘আমার তিন নাতি।’
‘তা আমি জানি।’ বলে নানা হাসার চেষ্টা করেন। দাদা এবং নানার দিকে রাহীম স্বগতোক্তি করে, ‘আজ আমার টেংরি ভাঙবে। দিনমান ও মাই গো জপতে হবে।’
অকস্মাৎ দাদা আক্রমণ করলে সাধনচাতুর্যে রাহীম আত্মরক্ষা করে। নানা হাসতে শুরু করলে অপলকদৃষ্টে রাহীমের দিকে তাকিয়ে দাদা বললেন, ‘অবিশ্বাস্য, আমি বিশ্বাস করতে চাই না।’
‘আমরা বিশ্বাসী।’ বলে নানা রাহীমের পাশে যেয়ে তাকে বুকে টেনে চোখ বুজে কিছু পড়ে দু হাতে তার বাজু ধরে মৃদু হেসে বললেন, ‘আত্মার সর্ম্পক আত্মীয়ের সাথে। আত্মীয়তায় অনাত্মীয়রা পরমাত্মিয় হয়। আত্মার মালিক হলেন আল্লাহ। কে কখন মৃত্যুবরণ করব আমরা জানি না।’
‘আজ আপনাদের কী হয়েছে?’ বলে রাহীম কাঁধ ঝুলালে বুক ভরে শ্বাস টেনে হাঁফ ছেড়ে দাদা বললেন, ‘আজ আমরা আশ্বস্ত হয়েছি এবং তুই বিশ্বস্ত হয়েছিস।’
‘জয়োস্তু।’ বলে রাহীম পিছু হেঁটে শিউরে ওঠে। আর কথা না বলে দাদা এবং নানা বাড়ির ভিতর চলে যান এবং খাবার খেয়ে বিদায় হলে সে তার কাজে ব্যস্ত হয়। রাত বারোটায় কাকের নীড় থেকে ছানা মাটিতে পড়ে কাতরাতে শুরু করে। আলগোছে দোয়ার খুলে টর্চ হাতে নিয়ে বেরিয়ে বাবার গলা খাঁকারি শুনে চমকে ওঠে। ডরের চোটে কী করবে ভেবে না পেয়ে গুঁড়িশুঁড়ি মেরে লাউতলে বসে দোয়া ইউনুস জপতে শুরু করে। হঠাৎ শিয়ালের আর্তনাদ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলে আক্ষেপ করে বলল, ‘রে শিয়ালের পাল, তোদের যন্ত্রণায় না পারি মুরগি পোষতে, না পারি কোকিল পোষতে। বাগুরায় ঘুরে মর, সক্কালে উঠে বিস্কুটের শিরনি করব।’
বাবা ভিতরে চলে গেলে মাথা নেড়ে হেঁটে ছাঁইচের পাশে গেলে তার চেয়ে আধহাত লম্বা একজনের সাথে মুখোমুখি হয়। সভয়ে দুজন দুদিকে দৌড়ে পালায়। সে তার কামরায় প্রবেশ করে দরজায় ছিটকানি লাগিয়ে কাঁথামুড়ি দেয়। ভোরে কোকিলের ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে হাতশ হয়ে মাথা নেড়ে রাহীম বলল, ‘ইস, মাস্টর ভাই কেন যে যাত্রায় গিয়েছিলেন?’
দরজায় কেউ কড়া নাড়লে আবার কাঁথামুড়ি দেয়।
‘রাহীম, দরজা খুল।’
‘দরজা খুলতে পারব না।’
‘দরজা খুল নইলে চাচাজানকে ডাকব।’
‘যাত্রার খবর ভাইজান এবং দাদাজান জানেন। আব্বাজান এবং চাচাজান জানেন না। জানাতে চাও নাকি?’
‘আমার লক্ষ্মীভাই দরজা খুল।’
রাহীম অপারগ হয়ে দরজা খুললে পেটে ধরে সকাতরে মাস্টার বলল, ‘আর কোনোদিন যাত্রায় যাব না। বেশি ভুখ লেগেছে। কিছু এনে দে। ভুখে পেট আমলিয়ে মাথা ঘুরাচ্ছে।’
‘শাষালে চিৎকার করে বলব, যাত্রায় গিয়েছিলে কেন? আজ যাত্রা অশুভ হবে। এখন বলো কী চাও?’ বলে রাহীম মাথা দিয়ে ইশারা করলে মাস্টার হতাশ হয়ে হাবার মত হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘পেটের ভিতর জ্বালাপোড়া হচ্ছে। চা বিস্কুট খেলে গ্যাস্টিক হবে। পাঁঠার মাংস দিয়ে পিঠা খেলে গ্যাস্টিক হয় না। এক আধখান বর্তন ভাঙ যেয়ে, ঝাড়ু মলম আনার জন্য বাজারে যাব।’
‘না গো মাস্টর ভাই, থাল বর্তন ভাঙতে পারব না। গতকালকের দুইখান এ মাসের জন্য যথেষ্ট। আজ বর্তন ভাঙলে আম্মাজান আমার কল্লা ভাঙবেন। তুমি পারলে না চিনে চিনের একখান ভাঙো যেয়ে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি।’ বলে রাহীম দৌড়ে পাকঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে ছোট চাচিকে দেখে পাশে যেয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে পেটুকের মত সবিনয়ে বলল, ‘ছোট-চাচি আম্মা গো, পিঠা বানাতে পারবে? পাঁঠার মাংস দিয়ে পিঠা খেতে চাই।’
‘হাত মুখ ধুয়ে আসো, পিঠা বানিয়ে দেব।’ চাচি সভয়ে বলে তাড়াহুড়ো করে পাকঘরে যেয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মনের চোখে তার কাণ্ড কারখানা দেখতে শুরু করেন। উনাদের পোষ্য কুকুর। যে কুকুরের ভয়ে চোর ডাকু বাড়িতে হানা দিত না। এত ভয়ংকর ছিল। সেই কুকুরকে শিয়ালের মত মেরেছিল। তারোপর কিছু না পেলে বর্তনবাটি ভাঙতে শুরু করে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সে যা চায় তা দিয়ে পাকঘর থেকে আলাই বার করেন। এসব চিন্তা করে উনি পিঠা বনাতে শুরু করেন। তার মা পাকঘরে প্রবেশ করে দু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘এই ছোটবউ, পিঠা বানাচ্ছিস কেন?’
‘আমাদের সাতরাজার ধন পাঁঠার মাংস দিয়ে পিঠা খেতে চেয়েছেন। আপনি তরকারি গরম করুন, আমি পিঠা সেকব। তওবা আসতাগফার শোনা যাচ্ছে। এ কেমন পিরাকি আমার ছোট শ্বশুর পেয়েছেন, বর্ষায় গেলে মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।’
‘ওর ভয়ে ভয়ার্ত হলে বিপাকে পড়ব। তার হাতের পিছে মাস্টরপুতের হাত থাকে।’ বলে মা যখন তরকারি গরম করেন তখন রাহীম কষ্টে কাষ্টহাসি হেসে বলল, ‘চাচি আম্মা, পিঠা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’ চাচি চমকে বলে থালে দুইটা পিঠা দিয়ে বললেন, ‘তোমার মাকে বলো তরকারি দেবেন।’
পিঠার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে রাহীম বলল, ‘চাচি আম্মা, মাত্র দুইটা পিঠায় মাস্টর ভাইর গ্যাস্টিক কমবে না। উনি একলা চারটা খাবেন, ছয়টা দাও।’
মা ধমকে বললেন, ‘চোপচাপ বসে অপেক্ষা কর নইলে তোর বাপকে ডাকব।’
রাহীম থাল উঁচিয়ে নিচের দিকে তাকায়।
‘মাত্র দুইখান বাকি। এই নাও, সব নিয়ে যাও। সবগুলো তোমার জন্য বানিয়েছি। ভাবী, তরকারি দিচ্ছ না কেন?’ বলে চাচি তাড়া দিলে মা চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তোর বাপকে ডাকব?’
‘মায়, আমি এখন কী করলাম? থালের তলায় ময়লা আছে কি না আমি দেখছিলাম।’ বলে রাহীম থাল ছেড়ে দেয়।
‘দাঁড়া, আজ তোর বাপকে সব বলব। কই শোনছ, এসে দেখ আদুরে পুত কী শুরু করেছে?’ মা রেগে অনুচ্চসুরে বললে চাচি থাল হাতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পিঠা তরকারি দিয়ে বললেন, ‘ভাবী ভাঙেনি। ভাইজানকে ডেকে লাভ হবে না। ভাবীরপুত এই নাও, তোমার বাবা আসার আগে ভাগো।’
থাল হাতে নিয়ে রাহীম উঠে পড়ে দৌড়ে পড়াঘরে যেয়ে ভুখে মাস্টারকে ছটফট করতে দেখে মাথা নেড়ে বলল, ‘এই নাও।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে মাস্টার দু হাতে নাকে মুখে গুঁজতে শুরু করে। চেয়ারে বসে ভ্রূ দিয়ে ইশারা করে রাহীম বলল, ‘আমার মনের-কানে ঠুংরির ঠুংঠু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।’
মাস্টার চিবাতে চিবাতে মথা দিয়ে ইশারা করে বলল, ‘আগামী বছর চিন্তাভাবনা করব এখন মুখ বুজে পেট ভরে খা নইলে আমার মত গ্যাস্টিক হবে।’
‘এর মানে আমার পিঁজরায় বসে কোকিলা সুখের গান গাইবে না?’ রাহীম হতাশ হয়ে বললে মাস্টার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই আর তোর কোকিলা। চাচাজান টের পেলে তোর পিঁজরায় আমাকে বসিয়ে আলাহিয়া বিলাওল গাওয়াবেন।’
‘মনে রেখো, আগামী বছর কোকিলাকে শিয়ালে খেলে হাউ মাউ করেও গেস্টিক বেমারের দাওয়াই পাবে না।’ গম্ভীরকণ্ঠে বলে রাহীম নাস্তা খেয়ে বাউণ্ডুলের মত হেঁটে খালিবাড়ি গেলে পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘অমরাত্মা হতে চাই, কী করতে হবে?’
রাহীম চমকে ডানে বাঁয়ে তাকালে পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘আমি জানি তুই অবিশঙ্ক।’
‘অশঙ্ক হতে চাই না আমি শঙ্কিত হয়েছি।’
‘আমি প্রশ্ন করেছিলাম।’
‘আত্মসাধনায় আত্মশুদ্ধি হয়। পরিশুদ্ধ শব্দের বিশদ বিশ্লেষণ করলে সঠিক উত্তর দিতে পারব।’
‘পরিশ্রম করলে পরিশীলনে পরিশিষ্ট বিশ্লেষিত হয়।’
‘আমি পরিশ্রান্ত হতে চাই না।’
‘পরিষদে দাঁড়িয়েছি। পরিষেবা প্রয়োজ্য।’
‘আপনি নিশ্চয় জানেন পরিলক্ষিত বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হলে পরিরক্ষণ করতে হয়।’
‘ভাই রে, আমাকে সাহায্য কর। মারাত্মক দূরবস্থায় আছি।’
‘আপনি কে বা কী? আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
‘জাদুকর হতে চেয়ে আমি অদৃশ্য হয়েছি। দিনমান ধেয়ানচিন্তা করে একমাত্র তোকে বিশ্বাস করতে পেরেছি।’
‘সবাই জানে আমি অশিষ্ট।’
‘আমি জানি তুই বিশিষ্ট।’
‘আমি আদিষ্ট হতে চাই না।’
‘উপদিষ্ট আমি তোকে আদেশ অথবা উপদেশ করতে পারব না।’
রাহীম চিন্তিত হয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে নিম্নকণ্ঠে বলল, ‘মাই গো মাই, একলা পেয়ে আজ আমাকে ভূতে বেড়েছে।’
‘বেড়াজালে ঢুকলে মাছের কী আহাল হয় নিশ্চয় জানিস?’
‘ওহে ভূতভ্রতা, আমাকে নিস্তার দাও। আমার পেটের ভিতর বুদবুদ শব্দ হচ্ছে, আচকা দাস্ত হবে। এই বাড়িতে বদনা নেই।’
পুরুষকণ্ঠে হাসতে শুরু করলে ইনিয়ে বিনিয়ে রাহীম বলল, ‘এত মারাত্মক ভুল আর কখনো করব না। দুপুরবেলা আমি আর এই বাড়িতে আসব না।’
‘আমি ভূত নয়।’
‘সর্বনাশ।’
‘কী হয়েছে?’
এই বই দুই খন্ডে আমাজনে প্রকাশ করেছি
Poromatthio: Volume 1 (Bengali) Paperback – 21 Jun 2016
by Mohammed Abdulhaque (Author)
Product details
Paperback: 596 pages
First edition (21 Jun. 2016)
Language: Bengali
ISBN-10: 1534824596
ISBN-13: 978-1534824591
Product Dimensions: 12.7 x 3.4 x 20.3 cm
এক সাথে পড়তে চাইলে আমাজন থেকে কিনতে পারবেন
অথবা অনলাইন পড়তে চাইলে আমার সাইটে আছে
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৪:১১