কদিন আগে ক্যাম্পাসে মামার টঙ দোকানে বসে লেবু চা পান করছিলাম। এর মধ্যে কোত্থেকে যেন হঠাৎ গুরুদেবের আগমন। গুরুদেব মানে আমাদের বিশ্বকবি “রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর”। লম্বা আলখাল্লা, চুল দাড়ি সব আগের মতই ঠিকঠাক, কিন্তু হাতে একটা লম্বা মাঠা বাঁশ। আমি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কি বলব না বলব ভেবে শেষে বসতে বললাম। আরো এক কাপ চা অর্ডার করে আমি গুরুদেব কে জিজ্ঞেস করলাম,
-তা গুরুদেব আপনি হঠাৎ এখানে, এই অবস্থায় ? আপনাকে তো বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা ?
আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে তিনি মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-হ্যারে হারাধন, চায়ে একটু চিনি কম দিস। সকাল থেকে টেনশনে সুগারটা একটু বেড়েছে।
এরপর আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
-গুরুদেব বললেন না যে, আপনার হঠাৎ আগমনের হেতু। তাছারা টেনশনই বা কিসের আপনার? ওখানে তো বেশ ভালোই থাকার কথা।
তিনি বললেন,
-ওখানে আর ভালো থাকি ক্যামনে রে। তোরা ভালো থাকতে দিলি কই !
-কেন গুরুদেব, কী হয়েছে?
-(আওয়াজ উচু করে) কী হয়েছে; কী হয়নি সেটা বল ! রোজকার মত আজ সকালেও প্রাকৃতিক কাজ কম্ম সেরে ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলুম। ভাবলুম একটু ইউটিউবে ঢুকে দু’চারটে গান-টান শুনি। কিন্তু না, তা আর হল কই। এক ভিডিওতে দেখলুম, কোথাকার কোন এক ছোকরা চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে ঘোরাঘুরি করছে। তার সাথে একজ ক্যামেরা ম্যানও আছে।
- হ্যা, তো কী হয়েছে? শুটিং টুটিং করবে হয়তো।
-আরে না, শুটিং টুটিং কিচ্ছু না। ও গিয়েছে সাক্ষাতকার নিতে। আর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে কী বলছে জানিস ?
-কী বলছে?
-বলছে, “আমি একজন রবীন্দ্র গবেষক। তাঁর লেখা গানগুলোর উপর আমি একটা গবেষণা চালাচ্ছি।”
-হ্যা, ঠিকি তো আছে গুরুদেব। আপনার লেখা নিয়ে তো দেশে বিদেশে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। এ তো আপনার ভালো লাগার কথা।
-হ্যা, তা বটে। কিন্তু ঐ হতচ্ছারা কী করছে জানিস, ও বিভিন্ন লোকজনের কাছে যাচ্ছে আর জিজ্ঞেস করছে, “আপনি কি রবীন্দ্রনাথের ‘রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া’ গানটি শুনেছেন ?” আর লোকজনও তাতে বেশ সায় দিচ্ছে। অনেকে বলছে, ‘রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া’ গুরুদেবের তো বেশ বিখ্যাত গান। কেউ আবার বলছে, ‘রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া’ তো আমার খুঊব খুঊব খুঊব প্রিয় গান, ওটা না শুনলে তো রাতে আমার ঘুমই আসেনা। আর একজন তো গানটা গেয়েই শোনাল,
“রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া
তুমি মেলিয়া রাখ গো হিয়া”।
-হ্যা তো গুরুদেব, ঠিকিই তো আছে। ঐ গানটা তো বেশ ভালো, আর কথাগুলোও কি চমতৎকার লিখেছেন। সত্যিই আপনি বসস ।
-তুইও বলছিস সে কথা ? শেষ পর্যন্ত তুইও ওদের কাতারে চলে গেলি !
-কেন গুরুদেব, আমি আবার কী দোষ করলাম ? আমি তো আপনার অনেক বড় ফ্যান।
-তুইও ওদের মত বলছিস আর বলছিস কী দোষ করলাম !
ওরে হতচ্ছারা, ‘রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া’ শিরোনামের কি কোনো গান আমি লিখেছি ? বাপের জম্মেও তো আমি ঐরকম কোনো গান লিখিনি।
-অ্যা ! সেকি গুরুদেব, লিখেন নি ? তাহলে সবাই যে বলছে...?
-ওরা সবাই গুল মারছে। মিথ্যে বলে নিজেকে বাঙালি সংস্কৃতি মনা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছে। আসলে ঐ শিরনামের কোনো গানই আমার নেই।
-তাইলে ঐটা কার গান ?
-হ্যা, আমিও খুজছিলুম ঐটা কার গান। শেষমেশ গুগলে সার্চ দিয়ে জানতে পারলুম, ঐটা একটা ইংরেজি গানের বাংলা অনুবাদ।
-কোন গানটা গুরুদেব ?
-ঐ যে, ‘জরিনার সোকেছ’ না ‘জেনিফার লোপেজ’ নামক মেয়েটার গানটা, “Waiting for tonight” এর বাংলা ভার্সন “রয়েছি নিশির পানে চাহিয়া”।
আমি সাথে সাথে জিহব্বায় কামর দিলাম। আমি কখনই ভাবিনি অন্যদের সুরে সুর মিলিয়ে এভাবে গুরুদেবের হাতে ধরা খাব। সাথে সাথে গুরুদেবের কাছে ক্ষমা চাইলাম। আর বললাম,
-গুরুদেব আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি সত্যিই আপনার অনেক বড় একজন ফ্যান। আমি আপনার সবগুলো রচনাই পড়ার চেষ্টা করছি।
এবার গুরুদেব আমার দিকে আর চোখে তাকালেন আর বললেন,
-সত্যিই তুই যদি আমার অনেক বড় ফ্যান হোস, তাহলে লেখাটার শুরুতেই আমার নাম লিখতে ভুল করেছিস কেন ? রবীন্দ্রনাথের জায়গায় “রবিন্দ্রনাথ” লিখেছিস কেন ? তোর এই লেখাটা যারা পড়ল, শুরুতেই তো তোকে কয়েক ডজন ......দিয়েছে রে হতচ্ছারা। নে, এবার হজম কর। অবশ্য, সবার মাথায় সেটা খেলবেও না।
গুরুদেব এবার ঝারলেন (বিরক্ত হয়ে), তোরা কবে ভালো হবি বল তো ? সবসময় চাপার উপর থাকিস, নিজেকে জ্ঞানী বলে জাহির করার চেষ্টা করিস। আমি কী করিনি তোদের জন্য বল ! বাংলাটাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেলুম। ভাবলুম আমার দায়ীত্ব এবার শেষ। প্রথম নোবেলটা পর্যন্ত এনে দিলুম। সেটাও তোরা চুরি করে খেলি !
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কারণ মাথা উচু করে রাখার মত অবস্থা তখন ছিল না আমার। অনেকক্ষন নীরব রইলাম আমি। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না। অবশেষে গুরুদেবই নিরবতা ভেঙ্গে দিলেন আর বললেন,
“এবার তবে আসলুম রে, দেখি ঐ হতচ্ছারাটাকে খুজে পাই কি না।”
এই বলে গুরুদেব হাতের বাঁশটাকে শক্ত করে ধরলেন আর যেতে যেতে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিরবির করে বললেন,
“ষোলো কোটি জনগনের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো ডিজিটাল করে, মানুষ কর নি”।
.........................................................
এরপর সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই নাস্তা সেরে আমি সোজা চলে গেলাম বইয়ের দোকানগুলোর দিকে। গিয়ে প্রমিত বাংলা বানানের একটা বই কিনে নিয়ে আসলাম। আজ হতে শুদ্ধ বাংলা চর্চার অভিজান শুরু হল আমার।
এ যাত্রায় তো গুরুদেবের হাত থেকে বেচে গেলাম। ভবিষ্যতে যেন গুরুদেবের বাঁশের কবলে পরতে না হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ১২:১৯