অনেক আশা নিয়েই হ্যারি পটার এন্ড দি হাফ ব্লাড প্রিন্স দেখতে বসেছিলাম। কারণ আমার মতে এই সিরিজের ৭টি বইয়ের মাঝে এটি সবচেয়ে সুন্দর। কারণ এই বইটিতে হ্যারির বয়স ১৬ যে সময়টাকে বলে adolescence age মানে বয়ঃসন্ধিকাল। এই বয়সে ছেলেদের মন মানসিকতায় বেশ পরিবর্তন আসে এবং এই বইয়ে হ্যারির মাঝেও সেই পরিবর্তনগুলো দেখা যায়। কিন্তু পরিচালক ডেভিড ইয়েটস ও চিত্রনাট্যকার স্টিভ ক্লোভস মিলে বইটিকে পুরো ডুবিয়েছেন। এত সুন্দর একটা কাহিনী মুভিতে কিছুই ফুটে উঠেইনি বরং তারা বই থেকে উলটা পালটা পরিবর্তন করেছেন যেগুলো কাহিনীর সাথে একদম খাপ খায়নি। । ওয়ার্নার ব্রস এত নামীদামী একটা সিনেমা প্রতিষ্ঠান তারা কেন ডেভিড ইয়েটস এর মত আনকোরা পরিচালককে হ্যারী পটার এর মত একটি মুভির ৪টি পর্ব পরিচালনা করতে দেয় তা আমার বোধগম্য নয়। এই মুভি যে এত ব্যবসাসফল তার কারন এই মুভির কাহিনী নয় বরং হ্যারী পটার নামের জনপ্রিয়তার কারণে। আমিও প্রথম প্রথম হ্যারী পটার নাম শুনলে নাক সিঁটকাতাম কিন্তু ইংরেজী বই পড়ার অভ্যাস না থাকা সও্বেও আমি প্রতিটি বই পড়েছি কারণ এই সিরিজের আগের মুভিগুলো। যদিও ডেভিড ইয়েটস আগের মুভিটাও ডুবিয়েছেন, কিন্তু ক্ষমা করা যায় কাহিনী মুভিতে ফুটিয়ে তোলার জন্য কঠিন ছিল তাই । কিন্তু এত দারুন একটা কাহিনী একজন হলিউডি পরিচালক এভাবে ডোবাবেন ধারণাতেই ছিলনা।
এই মুভিতে প্রায় সবার অভিনয়ই দৃষ্টিকটু লেগেছে। কেউই সেভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সবাই চরিত্রগুলোই কেবল রূপায়ন করেছেন কেউই চরিত্রের মাঝে ঢুকে যেতে পারেননি দূর্বল চিত্রনাট্যের কারনে। ড্রাকো ম্যালফয়কে দেখে কখনোই মনে হয়নি যে সে ডাম্বলডোরকে হত্যার এইরকম মারাত্মক ষড়যন্ত্র আটছে, যেটাকে দেখে হ্যারি বুঝুতে পারবে। আবার হ্যারীর এক্সপ্রেসন দেখেও মনে হয়নি যে তার জিনির প্রতি ভাললাগা আছে। আর হেলেনা বনহ্যাম কর্টার এর অভিনয় পুরোই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে বেল্লাট্রিক্স চরিত্রে। যা বেল্লা চরিত্রের সাথে একদমই খাপ খায়না। অথচ বইয়ে অন্যরকম ভাবেই বলা আছে এই দৃশ্যগুলোর কথা।আর হারমিয়নি চরিত্রে পরিচালক শুধু তার চেহারার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে যদি তার চরিত্রের উপর বেশী গুরুত্ব দিতেন তাহলে বেশী ভাল হত। তাকে মুভিতে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি পরিচালকের এ বানিজ্যিক মনোভাবের কারণে। পুরো সিনেমাতে পরিচালক একটা তাড়াহুড়ো করেছেন। ফলে কোন কাহিনীই বোধগম্য হয়নি। আর সিনেমার মিউজিক অনেক কম ছিল, আরো বেশী মিউজিক দেয়া যেত।
ছবির প্রথম দিকে পরিচালক ঠিক মিলিয়ে চলছিলেন। কিছু কিছু ব্যপার পরিবর্তন করলেও চোখে লাগে নি। যখন ম্যালফয় হ্যারিকে নাকে লাথি দিয়ে তার উপর ইনভিসিবিলিটি ক্লোক দিয়ে চলে যায় তখন লুনা এসে হ্যারিকে উদ্ধার করে। কিন্তু যেভাবে দেখিয়েছে সেটা খুবই বাজে হয়েছে। এই ক্লোক পরবর্তী বইয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এবং এই ক্লোকের নিচে থাকলে কাউকেই দেখা যায় না অথবা তার অস্তিত্বও অনুধাবন করা যায়না। ম্যালফয় হ্যারির অস্তিত্ব বুঝতে পারে তার সুটকেসের নড়া দেখে। কিন্তু লুনার হ্যারিকে ওইভাবে আবিস্কারের ব্যাপারটা খুবই বাজে ঠেকেছে। বইয়ে ছিল লুনা নয় অরর টঙ্কস হ্যারিকে উদ্ধার করে। সে হ্যারির অস্তিত্ব টের পায় ম্যালফয়ের আঘাতে তার নাক থেকে যে রক্ত পড়ছিল তার গড়িয়ে যাওয়া দেখে।
ডেভিড ইয়েটস রুম অফ রিকোয়ারমেন্ট রুমটাকে একটা রসিকতার ঘরে পরিণত করেছেন। মুভিতে দেখিয়েছেন যে যখন ইচ্ছা চাচ্ছে ওই রুমে ঢুকে পড়ছে কিন্তু আসলে রুমটিকে সবাই দেখতে পায়না। কেউ তার অতিপ্রয়োজনেই রুমটিকে দেখতে পায়। যে কারণে হ্যারী সারা বছর ম্যালফয় ওই ঘরে আছে জেনেও ঢুকতে পারেনি কারন তার প্রয়োজন ছিলনা। আর হ্যারি মুভির মত এভাবে ঠান্ডা মাথায় জ়িনির সাথে হাফ ব্লাড প্রিন্সের বইটিকে লুকাতে রুম অফ রিকোয়ারমেন্টে ঢুকে নি। বরং ম্যালফয়কে আক্রমনের পর প্রফেসর স্নেপ যখন তার ব্যাগ চেক করতে চায় তখন সে হন্যে হয়ে হাফ ব্লাড প্রিন্সের বইটিকে লুকানোর উপায় খুজছিল। তখন আকস্মিকভাবেই রুমটি খুলে যায় কারণ হ্যারীর বইটিকে লুকানোর প্রয়োজন পড়েছিল। আর বইয়ে এত সস্তাভাবে হ্যারি আর জিনির প্রেম শুরু হয়নি। হ্যারি ম্যালফয়কে আহত করার পর ডিটেনশন পেয়েছিল। এবং ওইদিনই ছিল কুইডিচ শেষ ম্যাচ এবং চ্যাম্পিয়ন হতে হলে গ্রিফিনডরকে অনেক বড় ব্যবধানে জিততে হত। কিন্তু হ্যারির ডিটেনশন থাকায় হ্যারি ম্যাচটি খেলতে পারবে না তাই ওই ম্যাচ এ অধিনায়ক হয় জিনি । পরে ম্যাচটি গ্রিফিন্ড্রর জিতে যায় এবং হ্যারি জানতে পেরে সবার সামনে জিনিকে কিস করে। এবং ব্যাপারটিকে রনও খুব ভালভাবে মেনে নেয়। তখনই হ্যারি আর জিনির প্রেম শুরু হয়।
শেষে ডাম্বলডোর আর ম্যালফয় যখন মুখোমুখি হয় তখন হ্যারি এভাবে মুভির মত লুকিয়ে ছিলনা বরং ডাম্বলডোর হ্যারিকে স্পেল করে নড়াচড়া্য অক্ষম করে দেন। কিন্তু ডাম্বলডোর এর মৃত্যুর কারনে সেই স্পেল নিজ থেকেই অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু তা না করে এই দৃশ্যটি পুরোপুরি হাস্যকর করে তুলেছেন পরিচালক। অনেককিছুই মুভিতে বাদ গেছে কিন্তু বইয়ে ক্রিসমাসের সময় রনদের বাড়িতে ডেথইটারদের আক্রমন এই অংশটুকু ছিলনা। এই অংশটুকু দেয়ার প্রয়োজন ছিলনা। আর একদম শেষদৃশ্যে রন, হারমিয়নি আর হ্যারির কথোপকন আরো সুন্দরভাবে করা যেত যেমনটি বইয়ে ছিল। অথচ বইয়ের শেষে ছিল ডাম্বলডোরের শেষকৃত্যানুষ্ঠান এবং সেখানে হ্যারি, হারমিয়নি ও রনের কথোপকপন। মুভিতে সেই অংশগুলোকে একদমই গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
এমা ওয়াটসন ও রুপার্ট গ্রিন্ট সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু জায়গায় ভাল অভিনয় করেছেন। হ্যারির এক্সপ্রেসন সমস্যা ছাড়া ভালো অভিনয় করেছে। রনের লাভ পোশন এর অংশটা ভালো হয়েছে। ছবির সেট ভালো ছিল । হরক্রক্সের বিষয়টি এবং ভল্ডেমোর্টের অতীতগুলোর চিত্রায়নও ভালো ছিল। গুহার ভিতরের অংশে হরক্রুক্স উদ্ধারের বিষয়টি বই থেকে পরিবর্তন করা হলেও অতটা খারাপ লাগেনি।
বইয়ের সব কিছু মুভিতে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় জানি, কিন্তু এই মুভিতে পরিচালক পুরো কাহিনীকে বিকৃত করেছেন। মুভিটা দেখার পর থেকে মেজাজ চরম খারাপ। এত সুন্দর একটা বইয়ের এত বাজে চিত্রায়ণ মেনে নিতে পারছিনা। হয়তোবা আমি বই পড়েছি দেখেই ব্যাপারগুলো আমার কাছে নেতিবাচক মনে হয়েছে এই জন্য যারা মুভিটা বই না পড়েই দেখেছেন তাদের মতামত জানতে চাই। আর যারা বই পড়েছেন তারাও তাদের মুভিটির সম্বন্ধে মনোভাব শেয়ার করুন ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২১