আজ কেউ কাঁদছেনা। কারও চোখে একফোঁটা জল নেই।এ বাড়ির সবার চোখের পানি অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। তিতলী এসে শুধু একবার আমার পাশে এসে বলছিলঃ “দাদা, তুইও এমন হয়ে যাবি নাতো”। ওর প্রশ্নের কোন উত্তর আমি দিতে পারিনি।দিতে পারবোও না। ওর প্রশ্ন শুনে চুপ করে গিয়েছিলাম। কি বলব? আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম ভাইয়ার এইরকম পরিণতি হবে। আজ ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমাদের কাছে ভাইয়া যে অনেক আগেই মরে গেছে। আজ কেবল তার আনুষ্ঠানিকতাই হল। অথচ এই ভাইয়াকে নিয়েই সবাই কত গর্ব করত। কিন্তু একটা দূর্ঘটনা কিভাবে সবকিছু বদলে দেয়।
ভাইয়া সবসময়ই খুব ভাল ছাত্র ছিল। কখনো ফার্স্ট সেকেন্ড না হলেও ও সবসমইয় প্রথম দিকেই থাকত। আর স্বভাবে শান্তশিষ্ট আর কিছুটা লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় ভাইয়াকে সবাই নির্ভেজাল ভাল ছেলে হিসেবেই জানত। ভাইয়া যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুব ভালো করল, তখন সবাই বলল ওকে ঢাকা পাঠিয়ে দিন। বাবার সেরকম সামর্থ্য ছিলনা ওকে ঢাকা রেখে পড়ানোর মত। কিন্তু কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত ওকে ঢাকায় রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন বাবা। এখনও মনে আছে বাবা যেদিন ভাইয়াকে নিয়ে ঢাকায় গেলেন সেদিন আমাদের দু ভাইবোনের সেকি কান্না। পরে মা আমাদের স্বান্তনা দিতে এসে আমাদের কান্না দেখে কেঁদে দিয়েছিল। ভাইয়া আমাদের সামনে কাঁদেনি কিন্তু বাবার মুখে শুনেছি ও নাকি পরে বাসে উঠে কেঁদেছিল। এমনই ছিল ভাইয়া। নিজের কথা কাউকে বলতে পারতনা। সবসময়ই একটু চাপা স্বভাবের।
ঢাকায় ভাইয়াকে নামকরা একটি কলেজে ভর্তি করানো হল। তার থাকার ব্যবস্থা একটি মেসে করে দিয়ে বাবা বাড়িতে ফিরে এলেন। ভাইয়া চাপা স্বভাবের হওয়ায় ভাইয়াকে নিয়ে মা-বাবা দুজনই খুব চিন্তায় থাকতেন। ভাইয়া যখন প্রথম ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এল তখন ভাইয়াকে চেনা যাচ্ছিলনা। চেহারা কেমন মলিন হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে কি যেন বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু বলতে পারেনি। এর চারমাস পরেই আসল দুঃসংবাদ। ভাইয়াকে নাকি পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছে। ভাইয়ার খাটের নিচে নাকি অস্ত্র পাওয়া গেছে। শুনে বাবা তাড়াতাড়ি করে ঢাকায় গেলেন। জানা গেল ভাইয়ার মেসে নাকি ভাইয়াদের মেসে নাকি একটা সন্ত্রাসী থাকত, ভাইয়ার পাশের রুমে। সে মাঝে মাঝেই নাকি ভাইয়ার কাছে কি প্যাকেট রাখতে দিত। ভাইয়া প্রথম প্রথম রাখতে না চাইলেও তাকে হুমকি ধামকি দিয়ে ভয় দেখাতো। আমার সরল-সোজা ভাইয়া ভয়ে তাই তার কথা মানতো। একদিন পুলিশ এসে পুরো মেস সার্চ করে তার খাটের তলায় রাখা প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা রিভলবার পায়।তাই তাকে সন্তাসী সন্দেহ করে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এই কথা শুনে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবা ওকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্যে অনেক ছুটোছুটি করলেন। কিন্তু এটা যে বাংলাদেশের আইন। যেখানে অপরাধী নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় আর আইন কিছু করতে পারে না। আর নিরপরাধীকে বিনা অপরাধে জেলে থাকতে হয়, তাকে মুক্তি পেতে ডিঙ্গাতে হয় আইনের সব বেড়াজাল। বাবা দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। আর মা চোখের পানি ফেলেন। যেদিন আমরা সবাই ভাইয়াকে দেখতে গেলাম সেদিন ভাইয়ার কান্না দেখে আমরা কেউই স্থির থাকতে পারিনি। সবাই বলত খুব তাড়াতাড়িই ভাইয়া মুক্তি পাবে। কিন্তু ভাইয়ার মুক্তির তারিখ কেবলই পিছিয়েই যেত। প্রথম প্রথম সবাই সহানুভূতি জানালেও সমাজের কাছে ভাইয়া ততদিনে অপরাধী। আড়ালে অনেকেই অনেক কিছু মাকে বলত। মা শুধু বলতেন আমার ছেলে নির্দোষ। কেউ আর বিস্বাস করতনা ভাইয়া কোন অপরাধ করেনি।
এক বছর তিন মাস পর যখন ভাইয়া মুক্তি পেল তখন আমার ভাইয়া আর সেই ভাইয়া নেই। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। চোখ ভিতরে ঢুকে গেছে, চোখের নিচে কালদাগ। ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে আসা হল। অনেকদিন পরে আমাদের বাড়িতে একটু শান্তি ফিরে আসল। বাবা ঠিক করলেন ভাইয়াকে আর ঢাকায় পাঠাবেন না। স্থানীয় একটি কলেজে ভাইয়াকে ভর্তি করে দেয়া হল। কিন্তু ভাইয়ার নামের পাশে জেল খাটা অপরাধী সেটে গিয়েছে। ভাইয়া আর কখনোই স্বাভাবিক হতে পারলনা। কলেজের ভাল ছাত্ররা কেউ ভাইয়ার সাথে মিশত না। স্যারেরাও তুচ্ছ কারণে ভাইয়াকে ক্লাস থেকে বের করে দিতেন। ভাইয়ার সঙ্গী হল কলেজের বখাটে ছাত্ররা। ওদের সাথে থেকে ভাইয়া পা দিল নেশার মরণফাঁদে । দিন দিন ভাইয়ার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে লাগল। সাথে সাথে আমার শান্তশিষ্ট ভাইয়ার মেজাজ হয়ে গেল খিটমিটে। আমাদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতে শুরু করল। যেদিন বাসার সবাই শুনল ভাইয়ার ড্রাগস নেয়ার কথা সেদিন আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ভাইয়ার টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেল। ভাইয়া এই নিয়ে তুলকালাম কান্ড করত। আমাদেরকে মারধোর করত। মার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। প্রথম প্রথম মা টাকা দিতেন। কিন্তু বাবা শুনে মাকে অনেক বকলেন। বললেন আর কখনো টাকা দিলে ঘরের বাজার বন্ধ করে দিবেন। মাও ভয়ে আর টাকা দিতনা। টাকার জন্য ভাইয়া ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে দিতে লাগল। তখন বাবা আর না পেরে ওকে মাদকাস্কতি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে দিল। কিন্তু কোন লাভ হলনা। ফিরে এসে কয়েকদিন ভালো থাকত তারপর আবার ড্রাগস নেয়া শুরু হয়ে যেত। শেষমেষ বাবা ভাইয়াকে ঘরে আটকে রাখলেন। কিন্তু ভাইয়ার চিৎকার চেচামেচি শুনে মা স্থির থাকতা পারতেন না। আমরা দেখতাম ড্রাগস না নেওয়ার কারনে ভাইয়া কি পাগলের মত করত। মা ভাইয়ার এই অবস্থা দেখে শুধু কাঁদত। বাবা বাইরে থেকে খুব শক্ত থাকত। কিন্তু বাবার ভেতরের কান্না আমরা সবাই দেখতে পেতাম।
আজ সকালে ভাইয়া মারা গেল। সকালে ভাইয়ার এক বন্ধু এসে খবরটা বলল। গতকাল ভোররাতের দিকে নাকি ভাইয়া অনেক বেশী মদ খেয়ে ফেলেছিল। পরে ওই বাসার ছাঁদ থেকে পড়ে গিয়ে ভাইয়া মারা গেছে। শুনে বাবা চুপ হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন লাশ নিয়ে এসে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে। পরে সারাদিনে ভাইয়ার জানাজা হল, ভাইয়াকে কবর দেয়া হল, কিন্তু বাবা একবারও এসে ভাইয়াকে দেখলনা। মসজিদের হুজুর এসে বাবাকে অনেক বললেন অন্তত জানাজাটা পড়তে। কিন্তু বাবা নিজের ঘর থেকে বের হলেন না। আজকে সারাটা দিন বাবা নিজের ঘরে বসে রইলেন। মা অনেকক্ষন তিতলী আর আমাকে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ করে পড়ে রইলেন,কাঁদলেন না। তিতলী বাবার কাছে গিয়েছিল কিন্তু বাবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে কিছু বলেনি।
অনেকক্ষন ধরেই আমি আর তিতলী বারান্দায় চুপচাপ বসে আছি কেউ কোন কথা বলছিনা।হয়ত দুজনই একই চিন্তা করছি। তিতলীকে হঠাৎ বললাম চল ভাইয়ার ঘরে যাই । তিতলী বলল চল। যাওয়ার পথে বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম বাবা ঘরে নেই। ভাইয়ার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি বাবা ভাইয়ার খাটে বসে হুহু করে কাঁদছে। আমাদের দেখে বাবা আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। এতক্ষন ধরে বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা কান্না আর আমাদের বাঁধ মানলোনা। অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে।