আমার কাছে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময়ের মাঝে অন্যতম হল আমার হোস্টেল(রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ) জীবনের স্মৃতি।কিন্তু তার মাঝেও কিছু তিক্ত স্মৃতি আছে। তার মাঝে হোস্টেল জীবনের প্রথম বছরের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিঃ
হোস্টেল আমাদের খুব নিয়ন্ত্রিত এবং খুব ডিসিপ্লিন্ড জীবনযাপন করতে হত। আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ার পরও আমার বাবা মা আমাকে ক্লাস ফোর এ থাকতে আমাকে হোস্টেলে দিয়ে দেন। অনেক আদরের ছেলে ছিলাম। হোস্টেলে এসে প্রচন্ড কষ্ট হত।প্রথম দিনের স্মৃতি এখনো মনে আছে। আমি কাঁদব না কাঁদব না ভেবেও কেঁদে দিয়েছিলাম


আমাদের ভোর পাঁচটায় উঠতে হত। পাঁচটায় উঠে ৬টায় পিটি করতে যেতে হত। এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হত। কিন্তু যারা দেরী করত তাদেরকে স্যাররা মাইর দিত। মাইরের ভয়ে উঠে যেতাম। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সকালে পিটিটা খুব কষ্টকর ছিল। অনেকটুকু রাস্তা দৌড়াতে হত। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই হাটতাম। আবার স্যাররা বাঁশি দিলে দৌড়াতে হত। পিটি শেষ করে যখন হোস্টেলে ফিরে আসতাম তখন যে কি শান্তি লাগত। পুরো হোস্টেল জীবনেই আমার কাছে পিটিটা অসহ্য লাগত। বিকালে ছিল আমাদের খেলার সময়। আমরা প্রায় ৪০ জন মিলে খেলতে হত। ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হত। এখন এতজন মানুষ মিলে খেললে আমি প্রায় খেলায় সুযোগ পেতাম না বললেই চলে। আমি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তাই পুরো ১ ঘন্টা সময়ের মাঝে ফুটবলে পা ছোয়াতাম গড়ে দুই থেকে তিনবার। তাও আন্দাজে। আর ক্রিকেট এ ব্যাটিং পাওয়ার জন্য দুই থেকে তিনদিন বসে থাকতে হত। তাও সুযোগ পেতাম না মাঝে মাঝে। আর ফিল্ডিং এ হাতে গোনা ২ থেকে তিনবার বল হাতের কাছে আসত। রাতে আমাদের পড়া তৈরী করার জন্য নাইটক্লাস হত। তাতে স্যাররা তদারকি করতেন নিয়মিত। সেই সময়ে প্রচন্ড ঘুম পেত। আমদের ঘুম কাটানোর জন্য স্যাররা দাড় করিয়ে রাখতেন। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমাতাম। তখন ২ ঘন্টা সময়কে মনে হত অনন্তকাল। আর পরীক্ষার আগে এই সময়টুকুকেই মনে হত কত অল্প।
এখন যেসব তিক্ত স্মৃতির কথা বলব তা সম্পুর্ণ নিজের কারনে। ছোট ছিলাম প্রথম প্রথম নতুন আসার পরে যখন কেউ পাত্তা দিতনা তখন অনেক চাপাবাজি করতাম। ফাঁক দিয়ে চাপা মেরে দিতাম সবার কাছে পাত্তা পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি চাপা মারতে গিয়ে এমন সব চাপা মারতাম যাতে সবাই বুঝে যেত আমি চাপা মারতেছি। এবং এই চাপাবাজির প্রভাব আমার হোস্টেল জীবনের অনেকটা সময় জুড়েই ছিল। অনেকদিন এই চাপাবাজির কারনে আমাকে পচানি খেতে হয়েছে। তার কয়েকটা নমুনা শুনুনঃ
প্রথমদিন সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি খেলাধুলা কেমন পারি। আমার জবাব ছিল আমি নরসিংদী স্টেডিয়ামে সিক্স মেরেছি(তখন আমার বয়স ১০। ফোর এ পড়তাম)। আমাদের ক্লাসে সবার মাঝে হইচই পড়ে গেল মারাত্মক খেলোয়াড় এসেছে। পরেরদিন ম্যাচ এ আমার প্রতিভার প্রমানস্বরূপ ২টা ক্যাচ মিস করলাম। এবং ব্যাটিং পাওয়ার আগেই ক্রিকেট সীজন শেষ হয়ে গেল। পরে প্রায় পাঁচ মাস পড়ে যখন ক্রিকেট সীজন আসল। আমি আবারো প্রতিভার প্রমান দিয়ে ২ রানে আউট। ততদিনে অবশ্য সবাই বুঝে গেছে যে আমি একটা চাপাবাজ। তবে অনেকদিন আমি ব্যাটিং নামলেই আমাকে সেই খোঁচাটা দেয়া হত। পাশ থেকে বলা হতঃ “নরসিংদীর ক্যাপ্টেন নামছে”।
মাঝে একবার ছুটিতে বাসার পাশের রেললাইনে একটা সুন্দর পাথর দেখতে পেয়েছিলাম। হল এ এসে সেটাকে চাপা মেরে বললাম আমাদের বাসার পাশের রেললাইনে একটা হীরা পেয়েছি। পরে হীরাটা আবার নদীতে ফেলে দিয়েছি। ভেবেছিলাম সবাই আমার নির্লোভ আচরণ দেখে মুগ্ধ হবে। কিন্তু যাকে প্রথমে বললাম সে বিশ্বাস করল। তাই সাহস বেড়ে গেল। পরে চালাক একজনকে বললাম। সে চোখ ছোট করে বলল হীরার সাইজ কতটুকু ছিল। আমি দুই হাত মুঠো করে দেখালাম এত বড়। আমি যেই সাইজ দেখিয়েছিলাম তাতে সেটা কোহিনূর হীরার চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছিল ।(তখনো আমি বুঝতাম না হীরার সাইজ আসলে কতটুকু)। ফলাফল সে আমার চাপা ধরে ফেলল। এবং সবার কাছে বলে দিল। এই নিয়ে কত যে পঁচানি খেয়েছি।
সবচেয়ে বেশী পঁচানি খেয়ছি যেটার কারনে তা হল আমাকে এক বন্ধুকে এম্নিতেই কথাচ্ছলে চাপা মেরেছিলাম আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। মেয়েটা তো আমার জন্য পাগল। তখনো এসব বিষয় বুঝতাম না। কিন্তু ভেবেছিলাম এইটা বললে আমাকে সবাই নায়ক মনে করবে। কিন্তু হল উল্টাটা সবাই আমার কানের কাছে এসে সেই মেয়েটার নাম বলে বলে খেপাত। আমার বই খাতায় ঐ মেয়েটার নাম লিখে রাখত। পরে এইটা স্যারের কান পর্যন্ত গেল এবং স্যার আমাকে রামধোলাই দিয়েছলেন। এইসব ঘটনাইয় আমার এমন শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল যে আমি আর কখনো অন্তত ওদের সামনে চাপা মারি নি।
হোস্টেল লাইফের প্রথম বছর একটু তিক্ত কাটলেও পরে এই হোস্টেলেই আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময় কাটিয়েছি। আমরা বন্ধুরা এখনো একত্রিত হলে এখনো সেই পুরোনো স্মৃতি মনে করি। এখনো আমাদের সেই দিনগুলো মিস করি। আর আমার নিজের বোকামিগুলোর কথা মনে করে এখনো নিজের মনেই হাসি।