১৯৯১সাল।তখন আমরা ধানমন্ডি স্কুলে পড়ি।জাভেদ নতূন ভর্তি হলো।সেই সময়কার বয়সের তূলনায় অনেক লম্বা,হিরো হিরো লুক,রাহুল কাট চুল,বেল বটম প্যান্ট পড়ে,সিগারেটে টান দিতে জানে আবার নাক দিয়েও ধোঁয়া বের করে,আবার গার্লফ্রেন্ডও আছে!!!সেই সময়ের বাস্তবতায় এগুলো সব এক্সট্রা সুপার কোয়ালিটি।অল্প ক'দিনের মাথায়ই স্কুলে স্বমহিমে বেশ ক্যারিশমেটিক ক্যারেক্টার হিসেবে আবির্ভুত হলো।আমরা পুরনো নেতৃস্থাণীয়রা কিছুতেই তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনি।তাঁকে সাইজ করার সব ফন্দি ফিকির আঁটতে থাকি।ক্লাশের রয়েল সিভিল সোসাইটিতে সে পুরোপুরি অচ্ছূৎ।কিন্তু কিছুতেই তাকে সাইজ করা যাচ্ছিলোনা।ভীষন মেধাবীও।টেন্স আর ন্যারেশন তার ঠোঁটস্থ।ফাতেমা ম্যাডামের ক্লাশে সে একাই হিরো।গড়গড় করে সব বলে দিতো আর আমরা সবাই চোরের মতন মাথা নিচু করে ম্যাডামের তামাম খিস্তি সহ্য করতাম।বিদ্বেষের চরমে গেলো পরিস্থিতি।তার উপড় ইদানিং আবার মর্নিং শিফটের মেয়েদের সাথেও তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে।এসেম্ব্লির আগে তাকে স্কুল গেটের বাইরে মেয়েদের সাথে দা্ঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়!!জাভেদের ঔদ্ধত্য এবার সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলো।পুরো ক্লাশ এখন বারুদ।যখন তখন ফেটে পড়তে পারে।মোটামুটি তাকে সাইজ করার নীলনক্সা ফাইনাল।ক্লাশের ডন জুন্নুন তার দলবল নিয়ে ছুটির পরপর ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে অবস্থান নিবে।ঐ পথ দিয়েই জাভেদ বাসায় যায়।বাসা নাকি এ্যালিফেন্ট রোড ভোজ্য তেলের গলিতে।তবে কিভাবে সাইজ করা হবে তা নিয়ে বিরাট মতভেদ তৈরি হলো।আমরা বুদ্ধিজীবি সমাজ জাস্ট হালকা উত্তম মধ্যমের পক্ষে কিন্তু ক্লাশের গুন্ডা সমাজ জুন্নুন-রাজেশ গং তারে ক্ষুর দিয়ে স্টেব করার পক্ষে।রাজেশ আরেক কাঠি বাড়া।সে কিরিচ দিয়ে কোপাতে চায়।তখনকার সময় ক্ষুর-কিরিচ দিয়ে কোপিয়ে তা বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলার মতন সৌভাগ্য আল্লাহপাক খুব অল্প কজনকেই দিতেন।তারাই আসরের মধ্যমনি।সিগারেটে দম দিয়ে ফুহহহ করে আকাশে ধোঁয়া ছেড়ে রসিয়ে রসিয়ে কাহিনী বলতো আর আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তন্ময় হয়ে শুনতাম আর নিজেদের কাপুরুষতায় অভিশাপ দিতাম যে কেনো গ্যাঞ্জামের সময় স্টেব করার সাহস হয়না।আমারতো নিজের প্রতি নিজের ঘেন্নাই ধরে গিয়েছিলো।তো জাভেদকে সাইজ করার কর্ম পদ্ধতি নির্ধারিত না হওয়ায় অপারেশনে দেরি হচ্ছে।এর মধ্যে ঘটে গেলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা।সামনে জাতীয় নির্বাচন।এরশাদের পতনের পর এই প্রথম দেশে সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।সারাদেশে সাজ সাজ রব অবস্থা।ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরে আওয়ামিলীগের নমিনেশন পেয়েছেন সাজেদা চৌধূরি।নির্বাচনী প্রচারনায় একদিন তিনি আমাদের স্কুলে আসলেন।নেত্রীকে সম্ভাষন জানিয়ে বরণ করে নিলো স্কুল কমিটির হোমড়া-চোমড়ারা।এমন সময় জাভেদ এক মহা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো।আমাদের ক্লাশ হতো তিনতলায়।তিনতলায় তখনো সম্পূর্ন কাজ সম্পন্ন হয়নি।দুটো মাত্র ক্লাশরুম।বাকী পুরোটাই ফাঁকা ছাদ।সাজেদা চৌধূরি আসা উপলক্ষে টিচাররা সবাই তখন নীচে।আমরা সবাই ফাঁকা ছাদে জমায়েত হয়ে প্রচারনার কান্ড-কারখানা দেখছি।ইউশেপড্ স্কুলের দু'তালার বারান্দায় পুলাপান সব গিজগিজ করছে।সাজেদা চৌধূরি টিচার এবং কমিটির সকলের সাথে গণসংযোগ শেষে উপড়ে তাকিয়ে আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন।অমনি জাভেদ চিৎকার করে বলা শুরু করলো ধানের শীষ,ধানের শীষ!!!সাথে সাথে পুরা স্কুল থরথর করে কেঁপে উঠলো ধানের শীষ স্লোগানে।বিব্রত সাজেদা চৌধূরী তখন তখুনি দলবল সহ তড়িঘড়ি স্থান ত্যাগ করলেন।আর হেডস্যার এবং কমিটির লোকজন কিরমির করে উপড়ে চাইলেন।তাদের রক্তচক্ষু থোরাই কেয়ার করে আমরা তখন শ্লোগানে মত্ত।জীবনের প্রথম রাজনৈতিক শ্লোগান...............চোখ হাসে মোর,মুখ হাসে মোর,টগবগিয়ে খুন হাসে।উৎসাহে শার্ট খুলে ফেল্লাম।লর্ডসের সৌরভের মতন আমিও শার্ট ঘুরাতে ঘুরাতে সেদিন পুলাপানের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু।এই প্রথম নিজের জন্মকে স্বার্থক মনে হচ্ছে।যদিও তার জন্যে আমাকে এবং জাভেদকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছিলো।পরদিন এসেম্ব্লীতে সবার সামনে কানে ধরে উঠবোস।ছিপছিপে হ্যাড স্যারের গায়ে যে মোষের জোর তা তার দশ আঙ্গুলের ছাপ দুই গালে ধারণ করে হাড়ে-চামড়ায় টের পেলুম।এই প্রচন্ড অবমাননাকর শাস্তিতেও শ্লাঘা বোধ করছিলাম দুজনই (মর্নিংশিফটের হারামী মেয়েগুলার ফিকফিক হাসিটা বাদে।সেদিনই নারী জাতির হৃদয়হীনতার একটা স্বচ্ছ ধারণা পাই)।কারণ এমন নায়কোচিত সাজা পেয়ে মরনেও যে সুখ।স্কুলে আমরা দুজনই হিরো।অনেকদিন ছাত্রসমাজে আমাদের এ মহান কীর্তি ছিলো মুখে মুখে।সেই ঘটনার পর থেকে পাশার দান পুরো উল্টে গেলো।জাভেদ এখন আমাদের মধ্যমনি।হওয়ার মতনই চরিত্র সে।ভালো বিতার্কিক।চমৎকার গানের গলা।এহসান,সামাদ আর সে মিলে ব্যান্ড গ্রুপ করার প্ল্যান করে।জাভেদ মেইন ভোকালিস্ট।দারুন ফুটবলারও ছিলো সে।অদ্ভুত সব ডজের কৌশল ছিলো তার।আমরা প্রতি বৃহঃস্পতিবারে হাফ স্কুলের পর চলে যেতাম ধানমন্ডি ৮নাম্বার মাঠে।আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলতাম।তৎকালীন জাভেদের আবাহনী প্রীতিই ছিলো চরিত্রের একমাত্র কলন্কময় দিক।অপূর্ব সব সময় কাটিয়েছি আমরা।প্রায় বিষ্যূৎবার কোথায় কোথায় চলে যেতাম আমরা।কখনো রমনা-সোহরাওয়ার্দি,কখনো ইউনিভার্সিটি,কখনো পাবলিক লাইব্রেরি/জাদুঘর,কখনো ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের বুড়ির মাঠ,কখনো বা মেহেরুন্নিসা গার্লস স্কুলের সামনে।রমনা -সোহরাওয়ার্দিতে আমরা বড় হওয়ার প্রেকটিস করতাম।যেমন সিগারেটে টান দেয়া(আমার সিগারেটের গুরু জাভেদ),লুকিয়ে লুকিয়ে জুটির রোমান্স দেখা।আস্তে আস্তে এমন অভিজ্ঞ হয়ে গেলাম যে জুটির বসা দেখেই বুঝতে পারতাম কোন জুটির এক্সন কতটা উপভোগ্য হবে।আমরা সেই অনুযায়ীই পজিশন নিতাম।উদ্যানের গার্ডমামুদের সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠলো।আমাদের উক্ত জ্ঞাণ সমৃদ্ধকরনে তাদের পাশাপাশি আমড়াওয়ালা ও ঝালমুড়িওয়ালাদের অবদানও কম নয়।অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্ধকার জীবনের আরো এক বিরাট জ্ঞাণ অর্জন করলুম।জানলাম নিষিদ্ধ পেশা বলে একটা পেশা আছে এবং কি তাদের কর্মপদ্ধতি।আমরা দুর থেকে তাদের কর্মবিধি দেখতাম এবং ক্লায়েন্ট ডিলিং ম্যানেজমেন্ট দেখে শিহরিত হতাম। ক্লাশে রাজেশ গং'রা পরিচয় করিয়ে দিলো স্যার আর.গুপ্তের(রসময়) অমর সাহিত্যের সঙ্গে।সে অন্য আরেক অভিজ্ঞতা।সংবাদপাঠের মতন পড়ার দক্ষতা ছিলো বলে পাঠের দায়িত্বটা ছিলো হামেশা জাভেদের উপড়েই।আর আমরা তার পঠনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতুম।আমার জীবনের ডার্ক নলেজের হাতেখড়ি জাভেদের হাতেই।শুরু হলো আমাদের মানিকজোড় ইতিহাস।পুরো ক্লাশ আমরা দুজনই মাতিয়ে রাখতাম।জাতীয় লীগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের পরদিন ক্লাশ থাকতো পুরো রণক্ষেত্র।আমার বিরোধীতাই যেনো তার জীবনের অনিবার্য লক্ষ্য!আমি সিংগাড়া সে সমুচা,আমি বাটারবান সে ক্রীমরোল,আমি ইমরান খান সে জাভেদ মিয়াঁদাদ,আমি পদার্থ সে অপদার্থ মানে রসায়ন,আমি ববিতা আর সে শাবানা................।এর মধ্যে সে তার পুরনো গার্লফ্রেন্ডকে ভুলে নতুন করে পাশের বিল্ডিংএর মেডিকেল পড়ুয়া আপুর প্রেমে পড়ে।আপুর প্রেমিকের হাতে মার খায়..............চিঠিপত্র দিয়ে বিরাআআট কেলেন্কারি।বছরের শেষদিকে আবার স্কুল ছাত্রসমাজ উত্তপ্ত।ডঃ বি চৌধূরি তখন শিক্ষা মন্ত্রী।নতূন নিয়ম চালু হলো এখন থেকে গণিতেও নৈর্ব্যক্তিক থাকবে এবং রচনামূলক ও নৈর্ব্যক্তিক উভয় বিষয়েই আলাদা আলাদা করে পাশ করতে হবে।যদিও বা এ নতূন আইন আমার বা জাভেদের কোনভাবেই মাথা ব্যথার বিষয় নয় কিন্তু রাজপথ উত্তপ্ত করা নিয়ে কথা।এই প্রথম কারো কারো রাজনৈতিক ইন্ধনে হাজার হাজার স্কুল ছাত্র রাজপথে নেমে এলো।মিছিল সারা ঢাকা শহর ঘুরে সায়েন্স ল্যাব মোড় ঘুরতেই শুরু হলো গণ লুটপাট।তারপর টিয়ারশেল!লাঠি চার্জ!এ্যালিফেন্ট রোড বাটার সিগন্যাল এর বাটার বড় শো রুমটিতে ব্যপক ভাঙচুর এবং লুটপাট হলো ঠিক চোখের সামনে।বড় ইচ্ছে হলো একজোড়া পাওয়ার কেডস দেই মেরে।৯৫০ টাকা দামের সেই কেডস তখনকার চ্যাংড়া সমাজের পরম আরাধ্য এবং এও জানি আমার আর জাভেদের বাবার বেতনের টাকায় সেই কেডস কেনা দাদার জন্মেও সম্ভব নয়।এই-ই মওকা!!!বিবেক নয়,কেবল মাত্র ভয়ের জন্যেই পারলাম না দুজনে সেই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে যা আমার আর জাভেদের আজন্ম লালিত আফসোস।অবশ্য পরে জাভেদের আফসোস হতো কিনা কে জানে?আমার আজো হয়।সুনীলের কেউ কথা রাখেনির মতন সেই কেডসও আমার আর পড়া হয়নি কখনো।আফসোস,,,,,,,,আফসোস।
বছরটা শেষ হলো ভয়ংকর মারামারি দিয়ে।যে কোন কারণেই আমি তার গালে ঘুষি মারলাম।আর ব্যাটা গায়ে গতরে বড় হওয়ার এডভান্টেজ নিয়ে এ্যালিফ্যান্ট রোড,ভোজ্যতেলের গলির মুখে আমাকে কুকুরের মতন মারলো।তারিখটাও মনে আছে।১লা জানুয়ারি ১৯৯২।বছর শুরু করলাম রাম ধোলাই খেয়ে।বাসায় ফিরেই নামাজে তার দুনিয়া এবং আখেরাতে সমূলে ধ্বংসের ফরিয়াদ করলাম আল্লাহর দরবারে। জিন্দেগিতে যেনো তার কুৎসিত মুখ কোনোদিন না দেখতে হয় তার জন্য সিজদায় চোখের জলে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেললুম।আফসোস,দোয়া কবুল হলোনা।ঠিক মাস দেড়েক পরেই সায়েন্স ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার দিনই তার অপয়া মুখের দর্শন।নির্লজ্জের মতন আবার গায়ে পড়ে কথা বলতে আসলো।ছিহহহ..............ঘেন্নায় গা রি রি করে উঠলো।স্বঠমকে তাকে এড়িয়ে গা বাচালুম সেদিন।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!আমি আর শালা একি সেকশান,একি ক্লাশ।কেমনে কেমনে আমাকে পটিয়ে আবার সেই পুরনো সখ্যতা!এবার শুরু আমাদের সারভাইবের সংগ্রাম।নয়া স্কুল।কমন কমপ্লেক্স।রানা,সুজন,প্রবালদের সেকি নাক উঁচা ভাব বাপ্রে বাপ।যদিও ওয়াসি,রিপন,রবিন,বাবু এবং আরো কয়েকজন হাসিমুখে বরণ করেছে কিন্তু বেশিরভাগেরই বৈরি ভাবাপন্ন আচরণে নয়া ক্লাশে জীবনধারণ রীতিমতন সংসদের মহিলা সংরক্ষিত আসনের মতই ম্রিয়মান।কয়েকদিন পর আমাকে দুঃখের সাগরে একা ফেলে জাভেদ চলে গেলো বুককিপিং সেকশানে!সেখানে গিয়ে ব্যাটা মাসুদ,মেহেদি,সাকিবদের সাথে জমিয়ে ফেললো ঠিকি কিন্তু আমার পা সুজা করে চলতে বহুদিন লেগেছিলো বিশেষ করে আমার হরিহর আত্মা অনিমেষ আইচের(দেশ সেরা ফিল্ম মেকার) সাথে সখ্যতার আগ পর্যন্ত।ভীন সেকশানের কারণে সখ্যতা আর আগের মতন নেই।যে যার নতুন পরিবেশ নিয়ে ব্যস্ত।হঠাৎ একদিন শুনি তার বাবা স্ট্রোক করেছেন।তখন তাদের বাসা ছিলো ঢাকা কলেজের বিপরীতে যাদব ঘোষের গলির শেষ মাথায়।একদিন মা-মামীসহ দেখতে গেলাম।সেদিন আবার অনেক কথা হলো।জানালো বাড়ীওয়ালার মেয়ে নিশুর প্রেমে পড়েছে।প্রতিদিন কিভাবে দেখা হয় সকাল-বিকেল,কি তার পটানোর পদ্ধতি এই নিয়া বিরাট গল্প।এমনিতেই সে খুব ভালো গল্প বলিয়ে।যে কথা আমি এক লাইনে বলতেও তাড়াহুড়ো করি সে কথায় সে রঙচঙ মাখিয়ে উপন্যাসের রূপ দিতে পারবে।সেই জাভেদ যখন প্রেম-কাসুন্দি শুরু করে তা শুনা যে কত্তটা যন্ত্রনা সে আমি ছাড়া কেবল মা্ত্র আমাদের ক্লাশের রাজুই বলতে পারবে প্রতিবেশি হওয়ার সুবাদে।জাভেদ যখন তার কাহিনী শেষ করতো ততক্ষনে দুইকান ঝাঁ ঝাঁ করতো।কাছে পেলেই তার কাহিনী শুরু,তাই তাকে দেখিবা মাত্র পিছলা মারার নানান ছল-ছুতোর প্রায়োগিক কলা শিখে গেলুম অতি অল্প দিনেই।পারতপক্ষে তার ছায়া এড়িয়েই চলি।তবে একি সেকশান হওয়ায় দুষ্ট প্রতিবেশি রাজুর কাছ থেকে আপডেট পেতাম নিয়মিতই।ফুলটুক্কা খেলার সময় কিভাবে চিঠি পাচার করতো,ব্যান্ডের কোন কোন গানের কলি জুড়ে চিঠি লিখতো,কিভাবে ঐ মেয়ে চিঠি নিয়ে মা'র হাতে ধরা খেলো,তার মা চিঠি সহ কবে জাভেদের মা'র কাছে বিচার দিলো,জাভেদের মা আবার নিশুর চিঠি নিয়ে কবে তার মায়ের কাছে জমা দিলো,জাভেদ কিভাবে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে হাতে নিশুর নাম লিখলো,ব্লা ব্লা ব্লা......................সে এক রাধা-শ্যামের অমর প্রেমগাঁথা মাইরি।
লাইলী-মজনুর বিচ্ছেদ ঘটাতে তড়িঘড়ি শহরের আরেক মাথায় প্রেমের দুশমন আংকেল-আন্টির বাসা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত।আবার ঐদিকে স্বল্প শিক্ষিত ধণী জমিদার বাবার নিশুকে বাল্য বিবাহ দেবার পায়তারা................সে এক চরম সাসপেন্স মুখর সময় পার করেছি আমরা বন্ধুমহল।
ক্লাশ টেনের শুরুর দিকে হঠাৎ করে আংকেল ইন্তেকাল করলেন।
''পাথুরে পাহাড় যেনো
বুকে হলো জড়ো;
এক নিমিষেই খোকা
হয়ে গেলো বড়।''
সেই থেকে আমার বন্ধু জাভেদের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু।ছোট দুটি ভাইবোন এবং আন্টির দায়িত্ব সে তখনি তার ছোট্ট কাঁধে তুলে নিলো।সেই ক্লাশ টেনে পড়ার সময়ই চাকরী নিলো কোন এক ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে।সংগ্রামী জীবনের শুরুটা তার তখনি।ক্লাশে আর রেগুলার না সে।পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিয়ে যায়।এরমধ্যে হঠাৎই বিনে মেঘে সুনামির মতন নিশুর বিয়ে হয়ে গেলো।ব্যস আমার বন্ধু হয়ে গেলো ইতিহাসের একমাত্র সচ্চরিত্রবান ও দায়িত্বশীল দেবদাস।চির উচ্ছল বকবকিয়ে জাভেদ আর নেই।ক্লাশ টেনেই মুরুব্বীদের মতন সিরিয়াস কাটখোট্টা নিরস এক ক্যারেক্টার হয়ে গেলো আমার প্রিয় বন্ধুটি।এসএসসি পরীক্ষা সামনে।যে যার মতন ব্যস্ত হয়ে পড়লুম।অনেক অনেক দিন আর যোগাযোগ নেই।
তিতুমীর কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হবো,কমার্স ফ্যাকাল্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছি,হঠাৎ দেখি জাভেদ!সাথে তার প্রাইমারি স্কুল জীবনের ও এলাকার এক বন্ধু।পরিচিত হলাম,নাম ঝন্টু।আমার দেখা আরেক অন্যতম সেরা হারামি।আমার হারামি বন্ধুদের লিস্টের শীর্ষ সারিতেই তার অবস্থান।রতনে রতন চিনে।আমি আর ঝন্টুও পরস্পরকে চিনে নিলুম।হয়ে গেলুম একজন আরেকজনের কলিজার টুকরা।জাভেদের বেইল নাই।কিছুদিন পর যুক্ত হলো আরেক হারামী পাপ্পু(অবশ্য ইদানিং সে বিরাআআট ভালা পুলা)।রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।পাশাপাশি রঙবাজি আর চান্দাবাজি।রন পোলকের মন্দিরের/ত্রিভুজের সাধও পেয়ে গেছি তদ্দিনে।কালেভদ্রে দেখা হতো জাভেদের সঙ্গে।একদিন দেখি দাঁড়িও রেখেছে।শালার এই অকাল অধপতনে আফসোস প্রকাশ ছাড়া তখন আর আমার হাতে অত বেশি সময়ও ছিলোনা।আবারো লম্বা এক বিরতি..................
ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে যখন পড়ি তখন আবার সেই ঝন্টু মারফতই জাভেদের সাথে আবার যোগাযোগ শুরু।তখন আড্ডা দেই খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে।নষ্ট পুলাপানের যত নষ্ট আড্ডা।জাভেদ তখন নিশু বিরহে কাতর এক বিরাট কবি।আমার দেখা প্রথম মোমিন কবি।'বিহায়ন মেঘডম্বর' ছদ্মনামে একদিন একটা বইও বের করে ফেললো,নাম অগস্ত্যোদয়।নিশ্চিত ছিলাম বইটা সে আমাকেই উৎসর্গ করবে।কিন্তু ব্যাটা উৎসর্গ করলো ঐ মিনসে নিশুরেই!!!কবিতার ছত্রে ছত্রে তার ব্যথার প্রকাশ।কবিতা বুঝি কম তা-ও পড়ে চোখে পানি চলে আসলো।সে আসলেই অনেক উঁচু মানের কবি।বই উৎসর্গ না করার অপরাধ তার ক্ষমা করা হলো।
হারামি ঝন্টু সারাক্ষন থাকে মানুষরে ফিটিং দেয়ার তালে।শয়তানি কিলবিলে মাথার ফিটিং দেয়া বুদ্ধিরে সে রীতিমতন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।একদিন তার মাথায় উদয় হলো জাভেদ হুজুররে ফিটিং দেয়া লাগবে।আমরা তখন তারে ঐ নামেই ডাকি।তার সীমিত মাইনের হিসেবি জীবনকে আমরা তখন স্রেফ কিপ্টেমীর চোখেই দেখতুম।ফিটিংএর গল্প তৈরী হলো।আমি ক্লাশমেট রিন্তু নামের এক মেয়েকে ভালোবেসে চুপিচুপি কাজী অফিসে বিয়ে করবো।ঝন্টু,পাপ্পু আর জাভেদ বিয়ের সাক্ষী।সময়টা মাপা হিসেব করে এমন ভাবে দেয়া হলো যাতে জাভেদ কিছুতেই অফিস ফেলে এটেন্ড করতে না পারে।যেই ভাবা সেই কাজ।জাভেদ প্রোগ্রাম মিস করলো।আমি তার উপড় রাগে অগ্নিশর্মা।বেচারায় অনুশোচনায় দগ্ধ।ইবলিশের সেকেন্ড ইন কমান্ড ঝন্টু তাকে পরামর্শ দিলো নয়া দম্পতিকে দাওয়াত করে কোন এক রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে।আর শেয়ারে আমাদের গোল্ডের চেইন গিফট করবে বলে সেই জামানায় শালা জাভেদের কাছ থেকে নগদ দুহাজার টাকা হাতিয়ে নিলো!!!আমাদের বলেছিলো এক হাজার।কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকেনা।পরে তা ঠিকি প্রকাশ পায়।প্ল্যানমাফিক দাওয়াত দেয়া হলো তখনকার শাহজাহানপুরের ক্রেজ আমতলার ঢাক্কা বিরিয়ানী হাউজে।সময় মতন কপট রাগ নিয়ে হাজির।রিন্তু আসতে পারেনি,বাসায় ঝামেলা হবে।এই ছিলো গল্প।আমার রাগ ভাংগানোর সেকি প্রানান্তকর চেষ্টা তার।কিছুতেই কিছু খাবো না।শেষতক তার অনুরোধে দু'প্লেট ফুল বিরিয়ানি,সাথে সুইট এন্ড সাওয়ার চিকেন বল,ঢাক্কা স্পেশাল প্রন ভেজিটেবল আর চার/পাঁচ গ্লাস বোরহানি খেয়ে কোনমতে আধাপেটা সে দাওয়াত রক্ষা করেছিলাম।পাপ্পু আর ঝন্টু হারামীর খাবার ফিরিস্তি আর নাইবা বল্লাম।কমসে কম আরো দেরহাজার টাকার ধাক্কা।
সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়ি কি করে যেনো আমার মতন বদবখতের জীবনেও ফাগুন আসলো।নিত্য নতুন ডেটিংপ্লেস আবিস্কার করে বেড়াই।ঝন্টু খবর দিলো জাভেদের পাশের বাসার লোকজন নাকি এক সপ্তাহর জন্য চাবি দিয়ে দেশের বাড়ীতে গেছে।ব্যস আর পায় কে?পাপ্পু তার ডার্লিং নিয়ে,আমি আমারটা আর ঝন্টু তার বেয়াইনরে পটিয়ে হাজির জাভেদের বাসাবোর কদমতলার বাসায়।ঝন্টু তাকে বুঝালো তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের এই সুবর্ণ সুযোগ।সে যেনো অতি অবশ্যি আমাদের বিশেষ করে আমাকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করে।সাথে আছে বউ রিন্তু।ডার্লিরে আগেই টিউশান দেয়া হয়ে গেছে তার নাম রিন্তু এবং আমরা কাজী অফিসে বিয়ে করেছি।এখানেও বিরাট ক্যাঁচালি ঝন্টু ম্যাজিক আছে।তবে সে আরেক ভিন্ন গল্প।জাভেদ শুধু বাসরের সুযোগই দিলোনা।দারুন মেহমানদারিও করলো।বিরাট আয়োজন।অবশেষে আমার মন গললো।আমি আর রিন্তু তাকে ক্ষমা করলুম।
কিছুদিন পর এমনিই ঘুরতে ঘুরতে আমরা থ্রি স্টুজেস জাভেদের বাসায় গিয়ে হাজির।অমা একি!!!বেটা রাগে অগ্নিশর্মা.............কুকুরের মতন দুর দুর করে আমাদের তাড়িয়ে দিলো!!!ঘটনা হলো সেই নারীর চিরায়ত পাতলা পেট উপাখ্যান।আমার পিসটা সেদিন মনের ভুলে কথায় কথায় জাভেদের বোনকে সত্যটা বলে দিয়েছে যে আমরা লাভার আর তার নাম..............।ব্যস বোনের কাছ থেকে শোনে সে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে।কদমতলায় আমাদের নামে ১৪৪ধারা জারি।
এরপর থেকে যখনি যেখানেই আমাদের দেখেছে চিটার বাটপার ডাকা ছাড়া কথা বলেনি।ঝন্টু হারামীর পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকেও।এরমাঝে জাভেদের মধ্যে আসলো আরো অনেক পরিবর্তন।সে এখন পুরোপুরি লেবাসধারি মোমিন।পাগড়ি পড়ে তার উপড় আবার উড়না বা রুমাল।লম্বা আলখাল্লা।রাজারবাগ পীর সাহেবের মুরিদ হয়েছে।এখন দেখা হলে আপনি ছাড়া কথা বলেনা!এর মধ্যে বিয়ে থা-ও করেছে।তাদেরি পীর বাবার কম্যুনিটির এক মুরিদের মেয়েকে।একটা মেয়েও হয়েছে।ভালো লাগলো জেনে যে অন্তত নিশুর বিরহ ভুলে সংসারি হয়েছে।আরো অবাক পরিবর্তন হলো সে আর বিএনপি করেনা।পুরাই পাল্টি!!!আম্লীগের সে এখন বিশাল ভক্ত।লেবাসধারী হয়েও ম্যাডামরে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করে।আরেকদিন শুনি সে ডঃ জাকের নায়েকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে কুৎসিত সব খিস্তি খেউরে!!কুৎসিত বলছি এ কারণে যে কোন লেবাসধারীর মুখে কখনো এত নোংরা গালি শুনিনি।তার অপরাধ টিভিতে অনুষ্ঠান প্রচার।ইসলামে ছবি তোলা হারাম,তাহলে কেনো সে ভিডিও প্রচার করবে?বল্লাম ছবি না তুললে হজ্ব করবি কেমনে?তার উত্তর বর্তমান প্রেক্ষাপটে হজ্বও নাকি মুসলিমদের জন্য ফরজ না!!!এই ছিলো তার পীর বাবার আক্বীদা।ম্যাডামরে গালি দেয়ার জন্যে কিনা জানিনা তবে আবার দীর্ঘ বিরতি।
অনেকদিন পর একদিন ফোন আসলো।আমি তখন কর্মসূত্রে চাঁটগা থাকি।বললো দোস্ত কৈ আছিস?ফ্রি কবে?কারণ সে খাগরাছড়ির হাতিমোড়ায় দুই একরের এক বিশাল পাহাড় কিনেছে।ওখানেই নাকি আশেপাশে তার পীর বাবারই বিশাল এক আখড়া আছে(চিটাগং ব্রাঞ্চ)।সে চায় তার পাশের পাহাড়টাই যেনো আমি কিনি।সস্তায় অফার আছে।কাগজ পত্রের ব্যবস্থা সব সেই করে দেবে।আমি যেনো পরেরদিন ১১টায় অবশ্যই যাই।কথামতন গেলাম।বহুদিন পর দুই বন্ধুর মিলন।বুকে জড়িয়ে ধরলো।জায়গাটা ঘুরে দেখালো।বিশাল পাহাড়।দামও সস্তা।কিন্তু প্রবলেম হলো সেখানে স্রেফ গাছের চাষ ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারবোনা।এটাই নাকি সরকারি নিয়ম।আমার কাছে জমি কেনাটা ওয়াইজ মনে হলোনা।তাছাড়া রিটার্নবিহীন এমন বিলাসি বিনিয়োগের অবস্থাও তখন আমার ছিলোনা।জানালুম কথাটা।এতে জাভেদ ভীষন মনঃক্ষূন্ন হলো।কিছু কথাও শুনিয়ে দিলো।আমিও ফিরে আসলাম।তারপর ফোনে মাঝেমাঝে কথা হয় কিন্তু কেমন যেনো অসংলগ্ন কথা।আজগুবে সব অভিযোগ ছাড়া তার কোন কথা নাই।তার সাথে কথা বলাটা ভীষন বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ালো।আস্তে আস্তে তার প্রতি একটা তিক্ততা চলে আসলো।তাকে আমার মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন মনে হলো।সে তার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়েও অনেক আজেবাজে কথা বলে।এমন কি নিজের মা-বোন নিয়েও।শুনেছি তার কনজ্যোগাল লাইফও খুব একটা সুখকর যাচ্ছে না।তার ফোন আর রিসিভ করিনা।এবছরের শুরুতে স্কুলের ক'জন পুরনো বন্ধুরা মিলে ঢাকার একটি নাম করা রেঁস্তোরায় একত্রিত হই।রবিন,মাসুদ,রিপন,মেহেদি আর আমি।নাসির ব্যাংকের ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেনি।তাদের সাথে ইদানিং জাভেদের আবার নতুন করে সখ্যতা গড়ে উঠেছে।একসাথে প্রায় প্রায়ই আড্ডা দেয়।এখন সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।বিভিন্ন সামজিকতায় অংশগ্রহন করছে নিয়মিত।যে ডঃ জাকির নায়েককে ছবি তোলার অপরাধে এককালে যা তা ভাষায় গালিগালাজ করতো সেই তাকেই আজকাল ফেবুতে প্রায় প্রায়ই ছবি আপলোড করে স্টেটাস দিতে দেখা যায়!!
তো বন্ধুদের কাছে আমার ঢাকায় ভিজিটের কথা শুনে ফোন দিলো।আমি তার ফোন রিসিভ করি না বুঝতে পেরে বিভিন্ন অপরিচিত নাম্বারে সে ট্রাই করতো।আমি টোন শুনেই বুঝতাম জাভেদ,তা-ই সাথে সাথে লাইন কেটে দিতাম।কি জানি আমারো ইদানিং অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আজকাল টেম্পার খুব শর্ট হয়ে গেছে।অল্পতেই খেপে যাই।রাগ পড়ে না সহজেই।সেই খড়গটাই হয়তো যাচ্ছে জাভেদের উপড় দিয়ে।ঈদের দু'দিন পর ফোন দিলো আমায়,কত্ত বড় পাষান আমি..................তখনো ধরলাম না।ঠিক তার ক'দিন পর আমাদের স্কুল গ্রুপের ফেবু পেজে দেখলাম জাভেদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি।আইসিইউতে আছে।বন্ধু মাসুদের কাছ থেকে নিয়মিতই আপডেট পাচ্ছিলাম।অবস্থা ভালোনা।ব্রেন টিউমার।সার্জারি আবশ্যক।ভাবীর সাথে কথা বল্লাম।আমার পরামর্শ ছিলো দেশে না করে ভারতে অপারেশন করাতে কিন্তু ভাবি বল্লেন তার নাকি মামা আছেন ঢামেক এর নিউরো ডিপার্টমেন্টের হেড।মামা বলেছেন প্রাথমিক স্টেজ,তাই দেশেই সম্ভব।রোগী টানাটানিই করলেই বরং ঝামেলা।তথৈবচ,গত ১৪ই জুলাই পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হসপিটালে জাভেদের মাথায় অপারেশন হলো।অপারেশনের পর জ্ঞাণ আর ফিরছেনা।আবার টেষ্ট করে ডঃ বল্লেন আগেই টিউমার ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে।আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে।রিকভারির সম্ভাবনা খুব কম মিরাকল ছাড়া।ফিরলেও বড় ধরনের কিছু হারিয়েই সে ফিরবে।আর স্থির থাকতে পারছিনা।অপরাধ বোধ নিজেকে কুরে কুরে খাচ্ছে।এ আমি কি করেছি?কি এমন অপরাধ করেছিলো জাভেদ?কেনো তার সাথে এমন করলাম?প্রতি সালাতে তার দ্রুত আরোগ্য কিংবা ঈমানি মৃত্যূর দোয়া করি পরম করুনাময়ের কাছে।আশার কথা কয়েকদিন ধরে নাকি সে রেসপন্স করছে।চোখে আলো ফেললে তাকায়।আবার আশায় বুক বাঁধলাম।তাকে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য কদিন আগে সোহরাওয়ার্দির আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।গতকাল ফজরের সালাতেও তার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করলাম।বাসায় ফিরে ল্যাপটপ অন করতেই রিপনের ম্যাসেজ,''গতরাত ২:১৫ মিনিটে জাভেদ ইন্তেকাল করেছে''!!!
আমি স্তব্ধ,ভাষাহীন,শোকাচ্ছন্ন।সারাদিন কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যেই আছি।কি করবো বুঝতে পারছিনা।ভেবেছিলাম শুক্রবার ঢাকা গিয়ে তাকে দেখে আসবো।প্রিয় বন্ধুর জানাজাটাও নসীব হলোনা।এটাই আমার প্রাপ্য।এই অপরাধ সারাজীবন বয়ে বেড়াবো..............এই হোক আমার শাস্তি।
বন্ধুরে,তুই আমায় কিছুতেই ক্ষমা করিসনা।ঐপারে গিয়েই চাইবো তোর কাছে।আচ্ছা,,,তুই কি আসলে শেষ কলে আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলি?আমার অবহেলাই কি তোর স্ট্রোকের কারণ?বন্ধুরে,আমার দোস্ত,আমার প্রাণের দোস্ত.................এ তুই আমায় কি সাজা দিলি?কতটা ভালোবাসি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি আজ।বুকের ভার বইতে পারছিনারে।বইবো,আজীবন বইবো।তুই ওপার থেকে অভিশাপ দিস আমায়।
হে আল্লাহ,হে পরম করুনাময়,আমার এ চিরদুখি বন্ধুটিকে তুমি জান্নাত দান করো।তোমার জমীনে সে বড় কষ্ট পেয়েছে।তাকে আর কষ্ট দিয়োনা। আমীন,,,,,,,সুম্মা আমীন।
পরে ভেবে যা বুঝলাম আসলে নিশুর বিরহ তাকে প্রচন্ড একাকিত্বে ভোগাতো।সে থাকতো সারাক্ষন তার স্মৃতি আর ভাবের জগত নিয়ে।সেখান থেকেই সে কিছুটা অসামাজিক আর খিটখিটে হয়ে পড়ে।আমিই ছিলাম তার আবেগের জায়গা।অধিকার নিয়েই সে আসলে আমাকে তার সকল অনুযোগ অভিমান জানাতো।বুঝলাম না.............কিছুই বুঝলাম না।
নিশুকে সে কখনোই ভুলতে পারেনি।সারাজীবন নিশুর বিরহ বুকে লালন করেই গুমরে গুমরে মরেছে।সংসার করেছে ঠিকি কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও নিশুর স্মৃতি তাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি।কবির বিরহের আজ অবসান হলো।কিন্তু নিশু কি জানে কবির এই অবর্ণনীয় যন্ত্রনার কথা?আমার ধারণা জানে না।কবি আসলে অপাত্রেই ভালোবাসা ঢেলে ছিলেন।
কবির ''অগস্ত্যোদয়'' গ্রন্থের উৎসর্গ পত্র পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন তার বিরহ,ভালোবাসা এবং কাব্য প্রতিভার গভীরতা।কাব্যরসিকরা তার এই উৎসর্গপত্রের কবিতা পড়ে অশ্রু ধরে রাখতে পারবেন্না।বাজী ধরে বলছি.................
উৎসর্গ পত্রঃ
পূর্ণ অগ্রাহায়ন তিথি আসমানে।পৃথিবীর এ'এক আশ্চর্য্য পথে আমি আর সে কান্তারের পথ হ'তে কান্তারের পথে হাঁটিতেছি।
ভাষা বিমুখতার যুপকাষ্টে দু'জন পরস্পর,পাশাপাশি,নিরিবিলি।
বসিয়াছি লম্বা লম্বা দুব্বাঘাসে।তার হাতে ছিলো মোর হাত।তিথি যখন অরণ্যের বিরাট বিরাট গাছের ফাঁক দিয়া আসি তার বদনে পড়েঃ মনে হইলো পুঁজোর সময় হইয়া আসিয়াছে।সোৎসাহে লতানো ঘাসের মতো তা'কে দেবীর পিড়িতে বসাই।জীবনের যাহা পুঁজা(অপ্রকাশিত,ভাষাহীন,মাধূর্যহীন,গোপন;প্রাণহীন) তাহা মুহুর্তে জাগিয়া উঠে-অস্তিত্ব পায়,
হয় হৃদয় বৃত্তান্ত----এমনি অগ্রাহায়ন তিথি ছিলো সেদিন।
আমার সৃষ্ট সেই শব্দায়মান সুর ঊর্মির মুখরতার মাঝে বসি আছি নিরেট নিঃশব্দতাকে পুঁজি করি দু'জন।এই বিশ্ব জুড়িয়া যে মহা মৌনের স্তবগান নিঃশব্দ ঝংকারে রণিত হইতেছে যদিও আমরা সেই ধ্যানীর মৌন মহিমার পুঁজারি ছিলুম,তবু একথা দ্বিধার কাঁটা হই বারম্বার আমার মনে বিঁধিলো যে,আমার নির্জনতার বক্ষ জুড়ে শুনিয়াছি অবিরাম বিষাদিত রোদন ধ্বনি,শান্তিহীন বিলাপ।মৃত্যূর পরে অশান্ত আত্মা যদি কেঁদে বেড়ায় তার কান্না বুঝি এমনি নিরব,এমনি মর্মন্তদ।
আমি কোটিবার তার পায়ের তলে এসে পুঁজার কুসুম,সে যে পথে চলে তার ধূলি।আমি তার পায়ে চলা পথের ধূলি সমষ্টি,মূর্তি ধরে এসেছি তাকে অতীত স্মরণ করাইয়া দিতে।তাকে আরেকবার তেমনি করে আমার বুকের উপড় নুপুর বাজাইতে হইবে।
অতঃপর কতোকতো কাল বহিয়া গিয়াছে----পুরোনো,সাদামাটা!পড়িয়াছে সময়ের আস্তরণ।পুনরায় অগ্রাহায়ন তিথি(উপরন্ত অগ্রাহায়ন তিমির)।
ধরণীর এ'এক আশ্চর্য্য পথে আবার আমি হাঁটিতেছি একা!তিমিরে বিরাট বিরাট বৃক্ষের পা ছুঁয়ে,বাতাস ছুঁয়ে,লম্বা লম্বা লতানো ঘাস ছুঁয়ে,নির্মিলীত আকাশ দেখে চিৎকার করে বলি নিশু.......নিশুগো...........এ কোন অগস্ত্যোদয় নিশু!!!
যে বাসনা সাধনের কৈশর ফুল
''রোজঈনা আঁকতার নিশু'' কে
[জাভেদ,,,কথা ছিলো আমার প্রস্থানে তুই লিখবি কিংবা তোর প্রস্থানে আমি।কথা রেখেছি বন্ধু]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৮:৪৩