আমরা সিভিলিয়ান মানে কিনা সাদাসিধে মানুষেরা খুব যে সাদা আর সিধে নই তা আমরা সবাই জানি, তবু না জানার ভান করতে করতে যখন ভুলেই যাই, তখন জলপাইরাঙ্গা বন্ধুরা মনে করিয়ে দেন। কেন জানি না, হিপোক্র্যাট বলেই হয়তো, রঙ চিনিয়ে দেয়া জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদেরও শত্রু মনে হয়। কাকের মাংস কাক খায় না--এরকম একটা প্রবাদ আমরা আমাদের পুলিশ বাহিনীকে ব্যঙ্গ করতে প্রায়শই ব্যবহার করি। আজ মনে হয় কাকস্য কাক এর সবচাইতে বড় উদাহরণ পুলিশ না, আমরা---সাদাসিধে সিভিলিয়ানেরা!
খুব মনে পড়ে, পিলখানা বিদ্রোহের প্রথম দিনের কথা। বিডিআরের এলোপাথাড়ি গুলিতে রিকশাওয়ালা মরে গেছে। আহত অনেক। রাস্তায় গুলিতে লুটিয়ে পড়েছে নির্দোষ পুলিশ সার্জেন্ট, তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনের মায়া করলো না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে রইলো রাজপথের উপর দেড়টি ঘন্টা...লাশটা আনার কেউ রইলো না। আমরা সাদা-সিধে মানুষেরা তখন পাগলা কুকুর হয়ে যাওয়া বিডিআরের সমর্থনে মিছিল করি। এ যে তাদের ন্যায়সংগত দাবির আন্দোলন...আমাদের সাদা-সিধে মানুষদের রক্তের উপর দিয়ে না গেলে চলবে কেন? তাই বলে কেউ ট্রাফিক সার্জেন্টকে বাঁচাতে যাওয়া মামুলি ছাত্রকে শহীদের খেতাবটা দিয়ে দিবেন না যেন! ও খেতাব জঙ্গীরা ধর্মসূত্রে কিনে রেখেছে, আমাদের বোমা মেরে মারার সময় নিজেরা আত্মঘাতী হবে, তখন খেতাবটা লাগবে না! আর কর্মসূত্রে কিনে রেখেছে জলপাইরাঙ্গা বন্ধুরা...উনাদের নিয়ে বেশি কথা বলা যাবে না। টুঁটি চেপে ধরবে যে!
এ তো গেল পিলখানার প্রথম দিনের কাহিনী, তখনো বিডিআরকে সমর্থন দিতে হাজার হাজার সাদাসিধে মানুষ পিলখানার বাইরে জমায়েত, কারও হাতে শান্তির প্ল্যাকার্ডও। যাক গে...শান্তি যদি আমাদের সাদা-সিধেদের সস্তার রক্তে আসে, ক্ষতি কি? ধীরে ধীরে কাহিনীপট ঘুরে গেল। দুইদিন পর যখন একটার পর একটা জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের লাশ ড্রেনের ময়লা পানিতে ভেসে উঠতে লাগলো, তখন আমরা সাদাসিধে মানুষেরা মুহূর্তের মাঝে দল বদলে নিলাম। জলপাইরাঙ্গা বন্ধু মরেছে বলে কথা! দেশ কাঁপিয়ে আর পত্রিকার প্রথম পাতা ভরে বুদ্ধিজীবীদের মতামত, তাঁদের বেশিরভাগই অবসরে যাওয়া জলপাইরাঙ্গা বুদ্ধিজীবী। পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পাতা ,মাঝের পাতা ভরে গেল জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের লাশের ছবিতে আর তাদের পরিবার পরিজনের কান্না আর অসহায়ত্বের কথায়। দিনের পর দিন পত্রিকায় চলতে লাগলো মারা যাওয়া জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের কতো কৃতিত্ব, পরিবারের প্রতি কার কতো ভালবাসা, ইনিয়ে বিনিয়ে চলতে থাকলো রাজ্যের উপাখ্যান। আহা! টিভি পর্দার সামনে আমরা সাদাসিধে মানুষেরা মৃত্যু দেখি আর চোখের জল ফেলি। টিভিওয়ালারাও নির্মল বিনোদন এর সুযোগ ছাড়লো না। চায়ের দোকানে পত্রিকা হাতে চালাতে লাগলাম নিরন্তর আড্ডা...
আমরা সাদাসিধে হিপোক্র্যাটেরা তখন ধানমন্ডি লেকে নিহত জলপাইরাঙ্গাদের আত্মার স্মরণে মোমবাতি জ্বলাতে ব্যস্ত! মাঝে দিয়ে যে সিভিলিয়ান বেকুবেরা প্রাণ দিল, তাদের স্মরণ করার সময় ছিল না। নাহলে নিশ্চিত কিছু একটা করতামই করতাম, কয়েকটা মোমবাতির তো আর অভাব হতো না, নিদেনপক্ষে আগরবাতি হলেও চলতো। কেউ আবার ফেসবুকে কান্নারত জলপাই বন্ধুর ছবি দিয়ে শোক প্রকাশ করলাম। নিন্দা জানিয়ে আর বিডিআরদের বিচার চেয়ে স্ট্যাটাস আর প্রোফাইল ফটো লাগালাম। জলপাইরাঙ্গা শহীদ(!) বন্ধুদের জানাজায় অংশ নিতে আমরা সাদাসিধেরা স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ জানাজায় অংশ নিলাম। সাদাসিধে বেকুবদের মনে হয় জানাজা হয় নাই, পত্রিকার পাতায় আর টিভির ক্যামেরায় তো দেখলাম না, হলে নিশ্চয়ই দেখতাম। আর হলোই বা, সেখানে আমাদের ভিড় বাড়ানোর দরকার কি? আমরা বরং প্যারেড স্কয়ারে জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের আত্মার মুক্তি কামনা করতে আসি।
তারপর এক সময় পত্রিকার পাতা ভরতে থাকে জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের পরিবার আর অন্য জলপাইরাঙ্গাদের দাবি-দাওয়াতে। কারো দাবি কোটি টাকা, কারো দাবি প্লট-ফ্ল্যাট, ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ...ইংলিশ মিডিয়ামের খরচের ঠেলা কি কম কথা? জননেত্রী, দেশনেত্রী পালা করে সব শহীদ জলপাইদের পরিবারকে দেখতে যান, অমুক সাহায্য তমুক সাহায্য ১০ লাখ-১৫ লাখ! মাথা ঘুরে যাচ্ছে হিসাব করতে করতে!
তারপর এক সময় পত্রিকাওয়ালারা ক্ষান্ত দিল। জল তো অনেক গড়াল, আর কতো? ঘটনার দুই সপ্তাহ পর প্রথম বুঝি কারো মনে হলো মারা যাওয়া বিডিআর সদস্যদেরও পরিবার বলে কিছু একটা আছে। ১৬ মার্চ(আগে পরে হতে পারে) পত্রিকার* প্রথম পাতার এক কোণায় আসলো নিহত(শহীদ না কিন্তু) বিডিআরদের পরিবারদের কথা, রিডাইরেক্ট করে দেয়া হলো ভেতরের সাদাকালো পাতায়। বিডিআর এর এইট পাশ জওয়ানদের পরিবারের মানুষদের জল শুকিয়ে-শুকিয়ে আসা চোখের কান্না দেখাতে চাররঙ্গা কাগজ ভরানোর কোনো মানে আছে? সেজন্যই হয়তো জননেত্রী-দেশনেত্রীদের চোখে পড়েনি এ সংবাদ, নাহয় নিশ্চিত চোখে পড়তো! শুনেছি বিডিআর নাকি আধা-জলপাই! তাদের পরিবারের কথা এলো ঘটনার দুই সপ্তাহ পরে, মরে যাওয়া নিতান্তই সাদাসিধে বেকুবদের কথা কবে আসবে পত্রিকায় কে জানে! না আসলেও চলবে মনে হয়...
এখন পত্রিকার পাতায় চিপায় চাপায় দেখি বিডিআর সদস্যদের আত্মহত্যা। একে একে নাকি আট-নয়জন আত্মহত্যা করলো! কয়জন করলো জানার কি দরকার? আমাদের জলপাইরাঙ্গা বন্ধুরা আছেন ওদের টেককেয়ার করতে। শুনেছি লাশের পোস্ট-মর্টেমে নাকি আঙ্গুলের মাঝে সুঁই পাওয়া গেছে? খারাপ না। জলপাইরাঙ্গা বন্ধুরা এর আগে আমাদের উপহার দিয়েছিল হৃদরোগ, অপারেশন ক্লীন হার্টে। তারপর ক্রসফায়ার, এখন আত্মহত্যা। আমরাও জলপাইরাঙ্গা বন্ধুদের সাথে এক হয়ে বুদ্ধি হাঁটুর গোড়ায় নামিয়ে ভাবি... যেখানে জওয়ানদের পরিবার-পরিজন তাদের পথ চেয়ে বসে আছে, সেখানে দায়িত্বজ্ঞানহীন জওয়ানেরা আত্মহত্যা করছে...কি কলিকালই না আসলো!
ভাগ্য ভালো, আমাদের পাশে আমাদের জলপাইরাঙ্গা বন্ধুরা আছেন। তারা বারেবার বুটের তলায় পিষে আমাদের মনে করিয়ে দেন, “ব্লাডি সিভিলিয়ান”...গালি ভাববেন না যেন! আমরা যে সাদাসিধে তা ভুললে চলবে কেন? সেজন্যই তো উনারা মনে করিয়ে দেন। আর আমরা জলপাই প্রেমে দিনকে দিন মত্ত হই। সেই স্বাধীনতার আমল থেকেই এই চলে আসছে। বীরশ্রেষ্ঠ হবার মতো বীরত্ব আমরা সাদাসিধে মানুষেরা দেখাতে পারিনি একাত্তরে। বুকের সাথে গ্রেনেড বেঁধে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া কিশোরের জীবন তেলাপোকার মতোই তুচ্ছ ছিল, তা কি সে জানত? মূর্খ কৃষক, মেধাবী ছাত্র আর ভঙ্গুর দেহের মজুরেরা যারা যুদ্ধে মরেছিল তারা বেঁচেছে। বাকিরা এখনো সে তেলাপোকা জীবন ধারণ করে চলছে। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরপ্রতীক আরো কিসব পদক আছে না...ওইগুলার লিস্টিতে চোখ বুলিয়ে যাই, জলপাই রঙের ভিড়ে সাদাসিধে নামগুলো খুঁজে বেড়াই!
শেষে এসে ভয়ে ভয়েই বলি আজ, মানিনা আমি ওইসব পদক। পদকের লিস্টিতে চোখ বুলিয়েই শুধু নয়, আমাদের ৩৮ বছরের স্বাধীনতার পাতায় পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখুন, হারামি পাকিদের যে ভ্রূণ আমরা আজও বহন করছি তা হলো এই জলপাইবন্ধুদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতালিপ্সুতা!
*পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোর কথা বলা হয়েছে।
একবার মুছে যাওয়ার পর ফেরত পাওয়া পোস্ট। শেষ ছবিটা বোধহয় তেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে দিলেন, অথবা অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে...যাই হোক। পোস্ট ফেরত পেয়েছি, তাতেই খুশি।এতোদিন পর আসলে মন্তব্য করারও আর কিছু বাকি নাই!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৬