চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে;
এই তো সেদিন পাশের বাড়ির দশ এগারো বছরের দামড়া খাসী টাইপের ছেলেটা বলে - ''আঙ্কেল আপনাগো ছাদে আমার ঘুড্ডি আটকাইয়া গ্যাছে একটু খুইল্লা দিবেন?''
মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়েছিলো তাই ছাদে গিয়ে ঘুড়িটা ছিঁড়ে দিয়েছি । পরে অবশ্য খারাপ লেগেছে কাজটা ঠিক হয়নি ।
দুচার দিন যাবত ব্যাপারটা ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে - আসলেই কি আমার বয়স হয়েছে?
এখনো সংসার ধর্ম কিছুই করা হলো না এসব না করে তো মরেও শান্তি পাবো না । একজনমে যৌনতার মতো অমৃতের স্বাদ চেখে দেখা হলো না এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে ! ঘর ভর্তি ফুটফুটে বাচ্চা কাচ্চা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকবে দৌড়তে থাকবে ঘর নোংরা করতে থাকবে এর চেয়ে চমৎকার হৃদয় মোহিত দৃশ্য আর কি হতে পারে !
এসবের কিছুই কি দেখতে পাবো না !
একে একে কুদ্দুসের মা জরিনার মা সকলের বিয়ে হয়ে গেলো জোড়ায় জোড়ায় বাচ্চা কাচ্চা ও হয়ে গেলো আমার এখনো ঝোপ থেকে লিটনের ফ্ল্যাটেই ওঠা হলো না ।
ধী মস্তিষ্কে মাথা ঠান্ডা করে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম । হাত দিয়ে মাথার চুল আর গাল স্পর্শ করে দেখলাম । তেমন কিছুই চোখে পড়লো না নিজের বয়স নিজের চোখে পড়বে না এটাই স্বাভাবিক ।
জোর সোর দিয়ে নিজেই নিজ পাত্রী উদ্ধারের সন্ধানে নামলাম ।
কয়েকটা ম্যারেজ ব্রোকার এপ্সে নিজের বায়োডাটা দিয়ে রেখেছি পরিচিত কয়েকটা ঘটককে ও বায়ডাটা দিয়ে রাখলাম ।
বুকের ভেতর কেমন যেন একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ভয় আর আনন্দের সংমিশ্রণ ।
বউ হবে বাচ্চা কাচ্চা হবে । বউয়ের সাথে রাতভর আনন্দ ফুর্তি করবো বাচ্চাদের সাথে দিনভর আনন্দ ফুর্তি করবো এসব ভেবেই দিন কেটে যাচ্ছে । তিন দিন হয়ে গেলো কোনো সাড়া শব্দ নেই ।
ওদিকে আমার হৃদয় মৃত তটিনী থেকে উত্তাল সমুদ্রের রুপ ধারণ করেছে ।
দেরি না করে পত্রিকার পাতায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দেখে ফোন দিলাম ।
এই প্রথম নিজে পাত্র হয়ে পাত্রী পক্ষের সঙ্গে নিজ বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করবো আতংকে আর উৎকন্ঠিত আমার হৃৎপিণ্ড সেকেন্ডে চার পাঁচবার করে স্পন্দিত হতে লাগলো ।
ও'পাশ থেকে ফোন রিসিভ করা হলো
-হ্যালো, কে বলছেন?
গলার সূরে মুগ্ধ হয়ে চুপ হয়ে আছি । কোনো এক অলৌকিক শক্তি মনে হয় আমার গলাটা আটকে ধরে আছে।
ও'পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছে । আমি কোনো উত্তর দিতে পারছি না ।
ফোনে টুং টুং শব্দ হতে লাগলো অর্থাৎ এপাশ থেকে প্রতিউত্তর না আসায় ফোন কেটে দিয়েছে।
কিভাবে কথা বলবো ;
মুনমুন মুখার্জির কবিতাপাঠ কিংবা ইন্দ্রাণী সেনের রবীন্দ্র সঙ্গীত ও এতোটা মুগ্ধ হয়ে শুনিনি কখনো। বার বার শুধু হ্যালো হ্যালো'ই শুনতে ইচ্ছে করছে। বাকি শুব্দগুলো আপাতত মোটেও শুনতে ইচ্ছে করছে না।
আবার ফোন দিলাম
ও'পাশ থেকে - ''কে বলছেন?''
এবার একটি ভিন্ন সূর। একটি ভারি গলার আওয়াজ জাদরেল টাইপ গলা । পাত্রীর মা হবেন নিশ্চই।
অত্যন্ত নম্রতার সহিত বললাম - জ্বি, আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন দিয়েছি।
ভদ্র মহিলা বললেন - বয়স কতো আপনার?
আমি বল্লাম- সাতাশ শেষ হয়ে আঠাসে পড়বে এবার।
কিছুক্ষণ চুপ হয়ে আছেন।
বয়সে তো আপনি এখনো কাঁচা তারপর ও আপনার কথা মাথায় রাখছি। মেসেজ করে মেইল এড্রেস আর ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি আপনি বায়োডাটা মেইল করে কাল যে কোনো সময় চলে আসুন।
- আচ্ছা ঠিক আছে, আসসালামু আলাইকুম।
সালামের উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।
কথা বার্তার ধরনে বোঝা যায় এই মহিলার আদব কায়দা'র যথেষ্ট অভাব আছে। যাক তাতে আমার কি আমি তো আর তার সাথে সংসার করছি না তার মেয়ে ঠিক থাকলে'ই হলো।
সারা রাত ছটফট করতে লাগলাম। কখন সকাল হবে। রাত ভর সেই মেয়েটিকে কল্পনা করে স্বপ্ন বুনতে লাগলাম। বিয়ের পর তাকে দিয়ে সারা রাত হ্যালো হ্যালো করাবো। কানের পাশে সারাক্ষণ হ্যালো হ্যালো করবে আমি ঘুমিয়ে গেলে থেমে যাবে।
ঠান নিলাম বাকি সব বাদ যে করেই হোক একে ই বিয়ে করতে হবে। এপ্স থেকে বায়োডাটা ডিলিট করে দিলাম ঘটকদের আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে নিষেধ করে দিলাম।
কল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের ই পাইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘ সময় ধরে ব্রাশ করলাম ক্লিন সেভ করে আলমারি থেকে ইস্রী করা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট বের করলাম। নতুন কালি করা জুতো টিস্যু দিয়ে আবার একটু পরিষ্কার করলাম। বের হবো সে সময় আবার মনে হলো যাই একটু আয়নায় নিজেকে দেখে আসি।
বাহ; একদম ঝক ঝকা দেখাচ্ছে। ভুঁড়িটা একটু বেরিয়ে থাকলে'ও ব্যাপার না বেশ ভালোই দেখাচ্ছে।
শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সিঁড়ি দিয়ে হাটছি আর মনে করছি কিছু একটা মনে হয় বাদ পড়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে নিচতলায় আসার পর মনে হলো বডি স্প্রে মাখতে ভুলে গেছি । আজকাল আন্ডারওয়্যার ছাড়া বের হওয়া যায় কিন্তু বডি স্প্রে ছাড়া বের হওয়া অসম্ভব । আবার সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে পাঁচ তলায় উঠে বডি স্প্রে মেখে নিচে নামলাম।
রাস্তায় এসে গুলশানের উদ্দেশে উবার ভাড়া করলাম । পথিমধ্যে শাহবাগ থেকে এক তোড়া গোলাপ আর কয়েকটা নীল চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে নিলাম ।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঠিকানা অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছলাম । কলিং বেল চাপতে'ই সদ্য প্রাপ্ত বয়সী একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো । নিশ্চই আমি যার সাথে প্রথমে কথা বলেছি;
আই মিন আমার হবু স্ত্রী ।
নীল শাড়িতে স্বর্গের অপ্সরী লাগছে । কাজল মাখা চোখে যেন পৃথিবীর সমস্ত মায়া লুকিয়ে আছে। ঠান নিলাম বিয়ের পর তাকে আমি উর্বশী বলেই ডাকবো স্বর্গের সবচেয়ে সুন্দর অপ্সরী ।
আমাদের মধ্যে হয়তো ট্যালিপ্যাথির কোনো বিষয় আশয় রয়েছে তাই আমি আসার আগেই আমার গন্ধ তাকে টেনে নিয়ে এসেছে দরজায়।
একগাল হাঁসি নিয়ে উর্বশী আমায় ভেতরে আসতে বলল । পৃথিবীর সমস্ত স্বস্তি এ হাঁসিতে ডুবে আছে । অফিসে যাবার পূর্বে রোজ একবার করে দেখে যাবো এ হাঁসি, আমি নিশ্চিত আমার সারাটা দিন হাঁসতে হাঁসতে কাটবে ।
আমি উর্বশীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলাম । ফুল হাতে উর্বশী বেশ প্রফুল্লিত হয়েছে ।
পুনরায় আমাকে ভেতরে আসতে বলেছে ।
ভেতরে এসে তুলতুলে সোফাতে বসে পড়লাম । সোফাটা অত্যাধিক তুলতুলে আমার পশ্চাৎদেশ সহ শরীরের অর্ধেকটা সোফা গিলে নিয়েছে । আমি আর উঠতে পারছি । উর্বশী আমার এই অবস্থা দেখে হাঁসতে হাঁসতে লুটুপুটি খাচ্ছে । আমি বিস্ময়ে তার হাঁসির দিকে চেয়ে আছি । মানুষের হাঁসি এতো সুন্দর হয় তা আগে দেখিনি । মানুষ এতো সুন্দর করে হাঁসতে পারে !
হাঁসি চেপে ধরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো উর্বশী । শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে নীল রঙের চুড়ি পরেছে । ভীষণ সুন্দর লাগছে ।
তার মোলায়েম হাত ধরে আমি উঠে দাঁড়ালাম । এ স্পর্শের অনুভূতি আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।
- এটা সোফা না এটা কুশন। আপনি কুশনে বসেছেন ।
ওটা সোফা ওটাতে বসতে পারেন ।
আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে সোফাতে গিয়ে বসলাম ।
- আপনি বসুন মা আসছে।
উর্বশী চলে যাচ্ছে । চলে যাওয়ার আগে তাকে থামাতে হবে । ক্ষণিকের জন্য হলেও তাকে আড়াল করতে চাচ্ছি না। লজ্জা ভেঙে বলে ফেললাম
- তুমি কি আমার ফোন ধরেছিলে?
উর্বশী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো ।
যাক শংকা মুক্ত হলাম ।
- তোমার নাম কি?
কাজল ভেজা নয়নে আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো ‘‘উর্বশী’’ ।
নাম বলেই ভেতরে চলে গেলো ।
আমি থ খেয়ে রইলাম। একি আচানক কান্ড ।
স্রষ্টা বোধহয় আমার পাঁজরের হাড় দিয়ে উর্বশীকে আমার জন্য সৃষ্টি করেছেন । আমার আর আলাদা করে নাম দিতে হলো না যে নাম আমি রেখেছি সে নাম তার জন্ম থেকে’ই দেয়া ।
এসি চলছে ;
আমি ঘামিয়ে গেছি। উর্বশীর হাতে স্পর্শ করার পর হতে ঘামাতে শুরু করেছি । ঘামাচ্ছি আর টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে যাচ্ছি ।
পা’য়ের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কেউ একজন আসছে । নড়ে চড়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলাম ।
জাদরেল গলার মহিলা’টা এসেছে । দেখতে কিছুটা সুন্দরী হলেও চেহারায় একটা দজ্জাল দজ্জাল ভাব আছে । এসব দাজ্জাল মহিলাদের আবার একটা স্পেশালিটি আছে তারা সাজুগুজু করতে ভালোবাসেন । উর্বশীর মা’য়ের ক্ষেত্রেও তা’ই হয়েছে
সাজুগুজু দেখে মনে হচ্ছে তিনি’ই স্বয়ং পাত্রী ।
- কেমন আছো ?
জ্বি ভালো । আপনি কেমন আছেন ?
- হ্যাঁ ভালোই ।
উর্বশীর সাথে দেখা হয়েছে ?
- জ্বি হ্যাঁ । উনি’ই দরজা খুলে বসতে দিয়েছেন।
আপনি করে বলছো কেনো? ওকে তুমি ‘তুমি’ করে বলতে পারো ।
বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম ‘সায়রা’ । আমি উর্বশীর মা ।
উর্বশীর বাবা গত হয়েছেন বছর দুয়েক হবে তার ব্যাবসা বানিজ্য আমি একা সামাল দিয়ে পেরে উঠতে পারছি না। এমনসময় উর্বশী নাস্তার ট্রলি নিয়ে তার মায়ের পাশে এসে বসলো । এবার তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে । মায়ের সামনে মেয়ের দিকে তাকানো ঠিক হবে না তাই মাথা নিছু করে মেঝেতে তাকিয়ে আছি ।
গলা ঝেড়ে উর্বশীর মা বললেন
- রাতে আমি আর উর্বশী খাবার টেবিলে তোমার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছি । উর্বশী তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। উর্বশীর পছন্দ’ই আমার পছন্দ । আমার পৃথিবীতে যেমন উর্বশী ছাড়া কেউ নেই তেমনি আমি’ই তার পৃথিবী ।
তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক’ই এই সব হচ্ছে ।
এখন তোমার সিদ্ধান্ত ।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলাম ।
অমৃত !
একটা মানুষের এতগুণ কি করে থাকে ।
আমি বললাম- সব কিছু যেহেতু আপোষে হয়ে গেছে সুতরাং আমার পরিবারের সাথে আলাপ করে কথা পাকাপাকি করা যেতে পারে । আশা করি পরিবারের কেউ এতে দ্বিমত পোষণ করবেন না ।
উর্বশীর মা বেশ অবাকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘‘গুড’’ ।
তাহলে শুক্রবার তোমার পরিবার নিয়ে আসো আমার বাসায় এখানেই কথা পাকাপাকি হবে ।
আমার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে । এতো সহজে সব কিছু হয়ে যাবে কল্পনা ও করিনি ।
মেয়েটার মুখে হাঁসি ফুটে আছে ঠিক যেন ভোর সকালে সমস্ত পালক ছড়ানো শাপলা ফুলের মতো ।
কুশলাদি বিনিময়ের পর বললাম -''আচ্ছা আমি এবার উঠি''
বের হবার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে পা বাড়াই ।
এমন সময় উর্বশী বলল-
‘‘আমি কি এখন থেকে আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি ?’’
আমি কথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি জিজ্ঞেস করলাম-
সরি, এক্স কিউস মি !
উর্বশী আবার বলল-
‘‘আমি কি আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি ?’’
অতঃপর আমি সেন্সলেস হয়ে যাই এবং পূর্বের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলি ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৬