একটা কালো কাক খুব আনন্দে ছিলো। একদিন সে দেখলো পুকুরে সাঁতার কাটছে এক সাদা পালকের হাঁস। সেই হাঁসকে দেখেই কাকটির দীর্ঘশ্বাস এলো। হাঁসের কাছে গিয়ে বললো- তুমি খুব সুখি তাইনা? হাঁস বললো- সুখিইতো ছিলাম এতোদিন। কিন্তু একদিন গাছের ডালে দেখলাম-লাল ঠোঁট আর সবুজ পালকের এক তোতা পাখি। সেই তোতা পাখিকে দেখেইতো আমার মুখটা ভোঁতা হয়ে গেলো। কাক উড়ে এবার তোতা পাখির কাছে গিয়ে বললো- তুমি নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি সুখি। তোতা পাখি বললো সুখেইতো ছিলাম খুব। কিন্তু একদিন দেখলাম-কী সুন্দর পেখমের এক ময়ুর। আমার মাত্র দুটো রঙ। কিন্তু তার কত রঙ। তাকে দেখেইতো দুঃখ বেড়ে গেলো । কাক এবার ময়ুরের কাছে গেলো।কত মানুষ ময়ুরের প্রশংসা করছে। আহা! ময়ুরটা কত খুশী। কাক ময়ুরকে বলে-তুমি এতো সুন্দর, তুমি সবচেয়ে সুখি তাইনা? সুখেই ছিলাম-আকাশে দিগন্ত বিস্তৃত সাতরঙা পেখমের রঙধনু না দেখা পর্যন্ত। তার তুলনায় আমার কত ছোট পেখম। আর বেশি সুন্দর বলেইতো আজ আমি বন্দী। এই চিড়িয়াখানায় কত নানা রঙের, কত রকমের, কত রুপের, কত সৌন্দর্য্যের পাখি দেখলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, চিড়িয়াখানায় বন্দী কোনো কাক দেখলাম না। সবাই সুখেই থাকে, অন্যের সাথে তুলনা আর অন্যের সুখ দেখে ঈর্ষান্বিত না হওয়া পর্যন্ত। কেউ চিড়িয়াখানায় বন্দী, কেউ লোভ,মোহ,ক্ষমতা, বৈভব আর অধিক চাওয়া-পাওয়ায় বন্দী। ঐশ্বর্য্য যার যত বেশী, মুক্তির পথ তার তত কম।
বিখ্যাত সুফি, দার্শনিক মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর মসনভীতে চমৎকার একটা গভীর তাৎপর্যময় কাহিনী আছে।
এক তোতাপাখি প্রতিদিন কত সুন্দর, উপাদেয় খাবার খায়। সুগন্ধ জলে স্নান করে। স্নিগ্ধ বাতাস তার গায়ে এসে লাগে। তারপরও তোতা পাখিটির দুচোখ ভরা কান্না। কারণ সে একজন বিখ্যাত সওদাগরের পালিত পাখি। সোনার খাঁচায় বন্দী। পাখিটি মুক্তি চায়।কিন্তু তার মুক্তির কোনো পথ নেই।
অন্য আরেকটি পাখি জানালার পাশে এসে তোতা পাখিটি দেখে বলে, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। বিজ্ঞ পাখি তোমাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছেন। তোতাপাখি বলে-আমি মুক্ত না হলে তার কাছে যাবো কেমন করে? তুমিতো আগে আমাকে মুক্ত করো।মুক্ত পাখিটি উড়ে উড়ে বয়স্ক বিজ্ঞ পাখির কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে।পরদিন, মুক্ত পাখিটি জানালার পাশে আসলে তোতা পাখি বলে- মুক্তির কোনো উপায় কি পেয়েছো? প্রাজ্ঞ পাখিটি কি কোনো পরামর্শ দিয়েছে?
না, প্রাজ্ঞ পাখিটি একটা কথাও বললো না। শুধু মনদিয়ে শুনেই গেলো। তারপর, হঠাৎ করে পরম শান্তিতে দুচোখ বন্ধ করে একদিকে হেলে শুয়ে পড়লো। জানিনা ভাই, এ জীবনে তোমার মুক্তির পথ কি?
পরদিন সওদাগর ঘরে এসে দেখেন-তোতাপাখি দুচোখ বন্ধ করে একদিকে হেলে পড়ে আছে । সওদাগর পানি দিলেন, খাবার দিলেন, ফল দিলেন,খাঁচা দোলালেন। না, পাখিটি মনে হয় মারাই গেছে। এই মরা পাখিকে দিয়ে তিনি কি করবেন? খোলা খাঁচা বাইরে রেখে সওদাগর খাঁচার দরজা খুলে দিলেন। মৃত তোতাপাখি এই প্রথম মুক্তির পথ পেয়ে আকাশে উড়ে গেলো।
বন্ধু পাখিটি বললো-সোনার খাঁচা থেকে তুমি মুক্ত হলে কেমন করে?
তোতাপাখি বললো- বিজ্ঞ পাখিটি যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক তেমন করে।
জাগতিক মোহ ত্যাগ করা ছাড়া মুক্তির অন্য কোনো উপায় নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ ভোর ৪:৩৬