মৃত্যু তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে নবাব
১৭৫৭ সালের জুলাই মাসের এক প্রচন্ড তপ্ত দুপুর।আগুনে লোহার তালার উপর পুড়ছে কয়েকশ ভু্ট্টা আর সাথে খাবার বলতে কয়েক ঝুড়ি রুটি। French and Indian War র মাঝে বিপর্যস্ত জনপদ।জনৈক কমান্ডার খাবারের দায়িত্বে আছেন।
গত সপ্তাহে কোনো এক বিশেষ কারণে ওহাইয়ো ভ্যালির এই ক্যাম্পে ঠিকমত খাবার সরবরাহ হয়নি। কমান্ডার তাই খুবই চিন্তিত। এই ক্ষুধার্ত সৈন্যদলকে সামাল দিবেন কীভাবে।পুরো লাইন খাবারের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কমান্ডার ছোট একটি রুটির টুকরো আর একটি ভুট্টা লাইনের প্রথম জনের হাতে তোলে দিলেন। একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাত হয়ে সেই খাবার পৌঁছে গেলো একেবারে লাইনের শেষপ্রান্তে দাঁড়ানো সৈন্যটির মাঝে। কোনো হৈ চৈ হলোনা। কোনো শৃংখলা ভঙ্গ হলোনা। লাইনের পিছন সারির সবাই খাবার পেলো। আর সামনের সবাই খাবারের আশায় দাঁড়িয়ে রইলো।
কমান্ডার নিজেও না খেয়ে রইলেন। সিপাহীরা কমান্ডারকে ছাড়া খাবেনা, কমান্ডার সিপাহীকে ছাড়া খাবেনা।
কমান্ডার এই ইউনিটের প্রধান হিসাবে নিয়োগের পর , কয়েকটি যুদ্ধে অসাধারণ সাফল্য আসে। ফ্রান্স কলোনি বিপর্যস্ত।
এই সাফল্যে ২৩ বছর বয়সী অধিনায়ককে ভার্জিনিয়া রেজিমেন্টের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ভার্জিনিয়া রেজিমেন্ট যেটা আমেরিকার সর্বপ্রথম সামরিক ইউনিট। (তথ্য উইকি। )
ফ্রান্স কমান্ডারের কাছ থেকে উইলিয়াম শার্লি'র কাছে গোপন খবর আসলো ২৩ বছর বয়সের কমান্ডারকে পদচ্যুত অথবা হত্যা করতে পারলে তাকেই কমান্ডারের পদ দেয়া হবে।
তিনি ঘৃণাভরে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বললেন- যে কমান্ডার সিপাহীর সাথে না খেয়ে থাকে, কমান্ডার হয়েও একজন ন্যাচারাল সোলজারের মতো পুরো ইউনিটের সেবা করে- পুরো আমেরিকা দিয়ে দিলেও তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা যাবেনা। বরং নিজের মৃত্যু হলেও এই কমান্ডারের মর্যাদা উচ্চাসীন রাখবেন।
২৩ বছর বয়সী সেই কমান্ডার নিজ ক্যাম্পের রুমে এসে ডায়েরীতে লিখলেন- বুভুক্ষু অবস্থায় থেকেও যে জাতির মাঝে এতো শৃঙ্খলা, শত প্রলোভনে যে জাতি নিজের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনা, সেই জাতি একদিন শুধু এ পৃথিবীর উপর কর্তৃত্বই করবেনা, পুরো পৃথিবীর অধীশ্বর হবে। ( সূত্রঃLibrary of Congress )
২৩ বছর বয়সী সেই দিনের সেই কমান্ডার হলেন আমেরিকার প্রথম রাস্ট্রপতি, প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম জর্জ ওয়াশিংটন।
ঠিক তাই, আমেরিকা দেশে দেশে যুদ্ধ করে- কিন্তু নিজ জাতির সাথে বেঈমানি এ দেশের কোনো সৈনিক, কোনো সিপাহী, কোনো নেতা, কোনো কমান্ডার, কোনো শাসক কোনোদিনই করেনা। সে যুদ্ধবাজ বুশ হোক, কিংবা কালো প্রেসিডেন্ট ওবামা হোক। আমেরিকার স্বার্থে রিপাবলিকান, ডেমোক্রেট,লিবারাল, টি পার্টি, গ্রীণ পার্টি সব এক।
আর আমেরিকা থেকে বহুদূরে ঠিক একই বছরে -আরেকদল বিশ্বাসঘাতকদের কারণে বাংলার শেষ স্বাধীনতা'র সূর্য অস্তমিত হয়। বিশ্বাসে কারো সাফল্যের সূর্য ওঠে, আর বিশ্বাসঘাতকাতয় কারো সূর্য অস্তমিত হয়।
জর্জ ওয়াশিংটিন যখন আমেরিকার সাফল্যের সূর্য উদয়ের স্বপ্ন দেখছেন তখন তার বয়স ২৩, আর বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পরাজিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য যখন অস্তমিত হয় তখন নবাবের বয়সও ২৩। আর সালটি একই ১৭৫৭ সাল।
নবাব কোনো ডায়েরিতে কিছু লিখেছিলেন কিনা জানিনা, তবে হয়তো মৃত্যুভয়ে পালাতে পালাতে ভাবছিলেন- যে জাতির মাঝে এমন বিশ্বাসঘাতক রয়ে যাবে , যে জাতি নিজের জাতী সত্তার সাথে বেঈমানী করে সে জাতি কোনোদিনও নিজের সম্মান নিয়ে ঠিকে থাকতে পারবেনা।
আজ দেশের সতের কোটি মানুষ বেঈমান। চমকে ওঠলেন?
যারা আওয়ামীলীগ করে তাদের চোখে বিএনপি'র সবাই পাকিস্তান আইএসআই'র চর। সে যতবড় মুক্তিযোদ্ধের কমান্ডার হোক না কেন? বিএনপি'র চোখে আওয়ামীলীগের সবাই ভারতীয় র'এর এজেন্ট। জামায়াত শিবিরের সবাই রাষ্ট্রদ্রোহি, আবার জামায়াত শিবিরের চোখে শুধু বিএনপি আর আওয়ামীলীগ না, ওরা বাদে বাকি সবাই কাফের। এদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু মানেই ভারতের চামচা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদী। দাঁড়ি , টুপি মানেই জঙ্গি। নিরপেক্ষ কথা বলা মানেই হয় সুশীল না হয় সুবিধাবাদী দালাল।
এখানে রায় বিপক্ষে গেলে কোর্টের বিচারপতিরা দালাল। সব শিক্ষকরাই দলবাজ। আমলা মানেই সরকারের পদলেহনকারী। রাজনীতিবিদ মানেই ক্ষমতার অপব্যবহারীকারি, গলাবাজ অথবা দূর্নীতিবাজ।
সাধারণ পেশাগত জীবনেও চলছে শুধু বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সাপলুডু খেলা ।
রোগীর চোখে ডাক্তাররা হলো সব রক্তচোষা। যাদের কাজই হলো রোগীকে জিম্মি করে অর্থ আদায়। ডাক্তারের চোখে রোগীরা সব বেশী বুঝে। "আরে বেটা তুই ই যদি সব বুঝিস তবে নিজের চিকিৎসা নিজে করলি না কেন?
পুলিশ মানেই হলো ঘুষখোর। আবার পুলিশের চোখে গভীর রাতে মায়ের জন্য ঔষধের জন্য কোনো ফার্মেসীতে ছুটে যাওয়া ছেলেটিও হয় চোর না হয় সন্ত্রাসী। র্যাবের চোখে সবাই লিমন। ব্যবসায়ীরা সবাই মুনাফাখোর।
হুজুররা সবাই ঘরে ঘরে গিয়ে খায় , আর পেট মোটা করে।
একবার এক হুজুর বললেন- ভাই আমরা আস্তে হাঁটলে মানুষে বলে- এতো বেশী খেয়েছে ঠিকমতো হাঁটতে পারছেনা। আবার জোরে হাঁটলে বলে-
কারো বাড়িতে দাওয়াত আছে , দেখো খাওয়ার জন্য কেমন দৌড়াচ্ছে।
এখানে বিনয়ী হবেন কারো সাথে-নিশ্চয়ই ব্যাটার কোনো ধান্দা আছে।
কারো কথায় কোনো প্রতিবাদ করবেন না- আরে তুইতো একটা ভিজা বিড়াল। প্রতিবাদমূখর হবেন- বেটা নতুন নেতা সাজতে চায়।
এযেন অবিশ্বাসী আর স্বার্থপরতার এক হতবিহ্বল জনপদ।
সেদিন ২৩ বছরের ওয়াশিংটন যেমন ডায়েরীতে লিখেছিলেন- আজ তাই হয়েছে। আড়াইশ বছর পর সত্যিই আমেরিকার কর্তৃত্ব পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ ছুঁয়েছে, আর বাংলাভূমি এখনো বিশ্বাসঘাতক আর বেঈমানদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।
গত শুক্রবার ১৯ সে সেপ্টেম্বর ছিলো বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের জন্মদিন। মৃত্যু তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে নবাব, জীবিত থাকলে এইসব বিশ্বাসঘাতক আর বেঈমানদের নিয়েই বেঁচে থাকতে হতো।
ছবি সংযুক্তির জন্য কৃতগ্গতা প্রিয় প্রবাসী পাঠক ভাই।