আপডেটঃ গত ৩০ শে জুন সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে " ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০১৪" এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রীসভা। সরকারের এই জন বান্ধব পদক্ষেপে অভিনন্দন। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি আইনের অস্পষ্ট দিক গুলো যাচাই বাছাই করে দ্রুত সংশোধনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
গ্রীষ্ম পেড়িয়ে আজ আমরা পবিত্র রমজান মাসের শুরুর পদার্পণ করেছি।সবাই কে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। গ্রীষ্ম আর রমজান মাসের কমন ও সবচেয়ে আলোচিত শব্দ দুটি হল ফরমালিন ও ভেজাল। ভেজালের জগতে ফরমালিন সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম। ভেজাল ও ফরমালিন নিয়ে প্রতিদিন ই এই গ্রীষ্ম আর রমজান উপলক্ষে ছেয়ে যাচ্ছে পত্রিকার পাতা গুলো। ভেজাল অনুসন্ধানে প্রথমেই আসে ফরমালিন পরিচিতি।
ফরমালিন কিঃ ফরমালডিহাইড একটি বর্ণহীন ও গন্ধ যুক্ত বিষাক্ত গ্যাস। এটি আগুনে জ্বলে। এই ফরমালডিহাইড গ্যাসের ৩৭-৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণ ই ফরমালিন হিসেবে পরিচিত। মুলত ফরমালিন ফরমালডিহাইডের পলিমার। এতে অবশ্য ১০-১২ শতাংশ মিথাইল অ্যালকোহল ও থাকে। লিভার বা যকৃতে মিথাইল অ্যালকোহল এনজাইমের উপস্থিতিতে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক এসিডে রুপান্তরিত হয়। দুটোই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জীবাণুনাশক হিসেবেই ফরমালিন বিশ্বে সমাদৃত।
ফরমালিনের ব্যবহারঃ ফরমালডিহাইড কাঠ এবং কন্সট্রাকশন কারখানায় কঠিন কারক বা শক্ত কারক হিসেবে, পোশাক শিল্পে বা আবরণ শিল্পে পোশাক সাদা কারক, শক্তকারক, চামড়ার ভাজ বা রেখা দূর কারক এবং মচমচে ভাব তৈরির জন্য ব্যবহিত হয়। এটি প্রিজারভেটিভ এডিটিভ হিসেবে সাবান, শ্যাম্পুতে ব্যবহিত হয়। বিশ্বে উৎপাদিত মোট ফরমালডিহাইডের ১ শতাংশের ও কম মৃত দেহ সংরক্ষণে ব্যবহিত হয়। চিংড়ি ও হাচারি তে জীবাণুনাশক হিসেবে ফরমালিন ব্যবহিত হয়।
সারা বিশ্বে প্রতি বছর আনুমানিক ১৬ বিলিয়ন পাউন্ড ফরমালিন তৈরি হয়।
কয়েক বছর ধরে মাছমাংস, ফলমূল ও সবজি সহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্য বেশি দিন তাজা রাখার জন্য এবং অধিক মুনাফা লাভের আশায় ফরমালিনের ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি ও ফরমালিন মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ।
সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও প্রতি বছর দেশে ফরমালিনের চাহিদা বিভিন্ন সুত্র অনুযায়ী ৫০- ১০০ টন বা ৫০০০০ – ১০০০০০ কেজির মধ্যে।
গত চার বছরে দেশে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ১১ লাখ কেজি। অর্থাৎ গড়ে প্রায় পৌনে ৩ লাখ কেজি। গত ১৭ জুন সংসদে এ তথ্য জানিয়েছেন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী আশার কথা হল, ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কেজি ফরমালিন আমদানি করা হলে ও তা ধীরে ধীরে কমে গত বছরে আমদানি ঠেকেছে মাত্র ৫৫ হাজার কেজিতে।
মন্ত্রীর বরাত অনুযায়ী, দেশে মুলত হাসপাতালে, ল্যাবরেটরীতে ও ওষুধ শিল্পে গবেষণার কাজে ফরমালিন আমদানি করা হয়। কোন এজেন্টের মাধ্যমে ফরমালিন আমদানি হয় না। ফরমালিন আমদানি কারক ৩৮ টি প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা ও তুলে ধরেন তিনি।
গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, ফরমালিনের অপ ব্যবহার রোধে “ ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ” বা “ টিসিবি” র মাধ্যমে ই শুধু ফরমালিন আমদানি করা হবে।
ফরমালিনের অপব্যবহারে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে গত বছরের ৪ নভেম্বর “ ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩” এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রী সভা। গত বুধবার এই আইনে সই করেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
কিন্তু ফরমালিন বিরোধী কার্যক্রমে সরকারের আত্তপক্ষ সমর্থনের বিপরীতে আছে নানা তথ্য ও অভিযোগ। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনেও আছে অস্পষ্টতা। ১৭ জুন বাণিজ্য মন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ফরমালিনের আমদানি কমেছে সত্যি। গত পাঁচ মাসে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ফরমালিন আমদানি হয়েছে মাত্র ১৯ কেজি। তবে এর অন্য নাম “ প্যারা ফরমালডিহাইড” নামে এসেছে সাড়ে ৫ হাজার টন। আর গত দেড় বছরে আমদানি হয়েছে ১৭ হাজার টন। ফরমালিনের ৯ টি রাসায়নিক নাম থাকলে ও সর্বশেষ “ ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৪” নামের নতুন আইনের খসড়ায় ফরমালিনের অন্য রাসায়নিক নাম গুলোর খসড়া নেই। এই অবস্থায় আইন টি পাশ হলে ও ফরমালিন আমদানি নিয়ন্ত্রণ দুরহ হয়ে পড়বে।
সম্ভবত এই কারনেই কাগজে কলমে ফরমালিনের আমদানি কমলেও খাদ্যে ফরমালিন বেড়েছে। মানুষের দেহ ১.৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন সহনীয় হলেও ফরমালিন বিরোধী অভিযানে দেখা গেছে, ঢাকায় প্রবেশ করা মৌসুমি ফলে রয়েছে ১২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে লিভার ও কিডনি নষ্ট হউয়ার পাশাপাশি শিশুদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে।
দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গুলোতে রোগীর মৃত্যুর প্রধান একটি কারন হার্ট এটাকে মৃত্যু। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ট এটাকে আক্রান্তদের রক্তে মিলছে তামা, সিসা ও আর্সেনিক।
ফরমালিন মুলত ভেজালের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও ভেজাল চলছে নানা ভাবে। হলুদে সিসা, মরিচে ইটের গুড়া, সরিষার তেলে ক্ষতিকর রাসায়নিক, মশার কয়েলে ভয়ঙ্কর উপাদান, মাছ-দুধ-শাকসবজি তে ফরমালিন, ওষুধে ভেজাল, রসাল ফল পাকাতে কার্বাইড, গরুর মাংসে হরমোন, বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে মুরগির খাবার। অন্যদিকে জিলাপি ও চানাচুরে ভাজতে পোড়া মবিল, মসালায় ভুসি, কাঠ , বালি ইটের গুঁড়া ও বিষাক্ত গুঁড়া রঙ ,ইসবগুলের ভুসিতে ভুট্টার গুঁড়া মেশান হচ্ছে। টেক্সটাইল ও লেদারের রঙ মেশান হচ্ছে সস্তা মানের বিস্কুট, আইস্ক্রিম, জুস, সেমাই, নুডুলস ও মিষ্টিতে। মুড়িতে মেশান হচ্ছে হাইড্রোজ।
রাজধানীর পুরান ঢাকাতেই প্রায় শতাধিক কারখানায় ভেজাল মেশান হয় কঠোর গোপনীয়তায়।
যদি ও এ নিউজের পর পর গত ১২ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজধানীতে ভেজাল বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ফরমালিন বিক্রেতাদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা শুরু করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ( ডিএমপি) । তা কত টুকু ফল প্রসু হবে অতীত রেকর্ড অনুযায়ী নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সম্প্রতি দেশি বিদেশি একদল গবেষক ৮২ টি খাদ্য পণ্য নিয়ে পরিক্ষা নিরিক্ষা করেন। রাজধানীর বড় বড় কিছু বাজার থেকে এসব খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুন বেশি উপাদান শনাক্ত হয়। মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীর কারনে
এখন খাবার কিনতে গেলেই বিষের ভয়।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রনে এ পর্যন্ত দেশে ১৬ টি আইন করা হয়েছে, আছে অনেক সংস্থা – তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অপ্রতুল সাজা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসুত্রিতার কারনে উলটো অভিযোগ আছে ভেজালে উৎসাহ দেয় আইন।
যদি ও ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে প্রতিদিন ই খুচরা ব্যবসায়ীদের ভেজাল সংশ্লিষ্টতার কারনে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে অভিযান নেই আড়তে।
ফরমালিন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তারা ফরমালিন কি চেনেন না। ফরমালিন পরীক্ষা প্রক্রিয়া নিয়ে ও আছে প্রশ্ন। তবু ও তাদের দাবি, অভিযান চালান হোক আড়তে ও আমদানি পর্যায়ে।
উৎস শনাক্ত না করে এবং পরিক্ষা না করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার প্রতিবাদ জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভেজাল বিহীন খাদ্য পাওয়া মানে এখন সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। বেশি অর্থ দিয়ে ও মিলছে না ভেজাল বিহীন খাদ্য। আর আমরা তো বুঝতেই পারছি না যে নীরবে বিষ খাচ্ছি একটু একটু করে। ভেজালের দৌড়াত্তে এগিয়ে আছে ফরমালিন। তাই এই নাম টাই ঘুরে ফিরে বারবার আসে। ফরমালিন নিয়ে ব্লগে এসেছে অনেক তথ্য সমৃদ্ধ সচেতনতা মুলক পোস্ট।
মাত্র ৫ সেকেন্ডে ফরমালিন শনাক্ত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, তরুন কৃষি বিজ্ঞানি ফারুক বিন হোসেন ইয়ামিন। খরচ হবে মাত্র এক টাকা। বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে ব্লগার ইমতিয়াজ ইমনের পোস্টে।
ব্লগার মোস্তফা১২ এর পোস্টে আছে মাছ এবং ফল ও শাকসবজি থেকে ফরমালিন দূর করার উপায়।
ব্লগার হিতাকাঙ্খী শেয়ার করেছেন ফরমালিন বা কার্বাইড যুক্ত আম চেনার উপায়।
ব্লগার জাফরুল মবীন, ফরমালিনের উৎসের এক অজানা অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন চমৎকার একটি পোস্ট ফরমালিনঃ চেনা বিষের অচেনা উৎস ফরমালিন থেকে সাধারণ মানুষ কে রক্ষায় সরকার কে প্রথমে খাদ্যে এবং তারপরেই এসব উৎসে ও নজর দেয়া অতিব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
গ্রীষ্ম ও রমজান মাস এলেই যেমন ভেজালের আলোচনা বেড়ে যায়, তেমনি বেড়ে যায় প্রশাসনের ভেজাল বিরোধী নানা কার্যক্রম। মিডিয়ার কল্যাণে এসব কার্যক্রম কিছুটা চোখে পড়ার মত হলে ও, খুব বেশি লাভ হয় ভোক্তাদের তা – নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন। গ্রীষ্ম- রোজা পেড়িয়ে গেলে যেন থিতিয়ে পড়ে ওই সব কার্যক্রম। সাধারণ ভোক্তাদের সারা বছর ভেজালের সাথে সমঝোতা করেই চলতে হয়।
কোন এক জনপ্রিয় ফেসবুকার তার স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “মাছে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করে একই ব্যক্তি নিজের সন্তানের জন্য ভেজাল জুস বা ফল কিনে খাওয়াচ্ছে। "
ভেজাল একটি সামাজিক ব্যধি। এ ব্যধি তে সাধারণ ভোক্তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি ভেজালকারিরা নিজেরাও রেহায় পাচ্ছে না।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভেজালকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সম্মান রেখে বলতে চাই, ভেজাল নামক সামাজিক ব্যধি রুখতে যেমন কঠিন আইন দরকার, তেমনি আগের আইন গুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সাথে প্রচুর সচেতনতা বাড়াতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে আবেদন, খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত আইনের ভুল গুলো যাচাই- বাছাই ও সংশোধন করে, পুরান আইন গুলো কার্যকরী করুন। সেই সাথে গন সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিন।
অনেক সময় পেড়িয়ে গেছে। এবার সময় এসেছে আগের চেয়ে ও দৃঢ় ভাবে ভেজাল কে রুখে দেয়ার।
ব্লগ থেকে নেয়া প্রথম তিনটা পোষ্টের লিঙ্ক লেখকের বিনা অনুমতিতে নেয়া হয়েছে। সময়ের অপ্রতুলতায় অনুমতি নেয়া সম্ভব হয় নি। আপত্তি থাকলে মুছে দেয়া হবে। অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
আর ভেজাল সম্পর্কিত ভাল পোস্ট গুলো ও খুঁজে পাই নি সময়ের অভাবে। কার ও কাছে থাকলে জানাবেন, পোস্টে যুক্ত করে দিব।
ছবি ক্রিতজ্ঞতাঃ গুগল, দৈনিক কালেরকণ্ঠ
পোস্ট কৃতজ্ঞতাঃ সম্মানিত ব্লগার মাহমুদ০০৭
তিনি আইডিয়া ও পরামর্শ দিয়ে পোস্টটি লিখতে উৎসাহিত করেছেন।
সবাই কে ধন্যবাদ।