somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার চাচা কি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না?

১৩ ই মে, ২০০৯ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুদ্ধ শুরু হবার ক'মাস পরই আমার একমাত্র চাচা চাকরির সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। আমার বুড়ো দাদী ছেলের জন্য কেবলই কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে চাচীর চোখ সারাক্ষণ ফুলে থাকতো।

চাচা বাড়ি ফিরেছিলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর। আমরা অবশ্য ধরেই নিয়েছিলাম চাচা আর বেঁচে নেই।

সেই চাচা পুলিশের পোশাক পরে বাড়ি ফিরে এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। চাচার গায়ে পুলিশের পোশাক দেখে প্রথমে আমি ভয়ই পেয়েছিলাম পুলিশভীতির জন্য। আসলে পুলিশ নয়, বাড়ি থেকে বের হয়ে চাচা আনসার বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।

সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়ার পর পরই দুয়ারে বিছানা বিছিয়ে চাচাকে ঘিরে বসে পড়তাম আমরা। চাচা যুদ্ধকালীন ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতেন একনাগাড়ে। তাঁর কথা শুনে আমাদের গা শিউরে উঠতো।

বড় হয়ে বাড়ি ছাড়লাম, পড়ালেখা ও জীবিকার জন্য। বাড়িতে গেলে কোনো কোনো অবসরপূর্ণ সন্ধ্যায় আগের মতোই চাচার মুখে সেই যুদ্ধের কাহিনী শুনতে বসে পড়তাম। ২৫-৩০ বছর আগের কথা কি ঝলমলে ভাষায় বলে যেতেন চাচা, যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য ফেরত এলেন।


একটা আশ্চর্য ভাবনা মাত্র কয়েক মাস আগে থেকে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চাচার কাছে তো কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ছিল না- মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কি তাহলে চাচার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল?

মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, নামীয় তালিকা হালনাগাদকরণ- বড় হয়ে এই বার্নিং ইস্যুগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হবার অনেক সুযোগ হয়েছে আমার- কিন্তু আশ্চর্য, একটি দিনের জন্যও আমার মনে হয় নি, দেখি তো চাচার নামটা কোন্‌ সেক্টরে দেখানো হয়েছে- দেখি তো চাচার নামটা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা- আশ্চর্য, ঘুণাক্ষরেও এ বিষয়টি আমার মনে উঁকি দেয় নি। এমনকি আমার চাচাকেও কোনোদিন বলতে শুনি নি- আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু যখন যুদ্ধের দিনগুলোর কথা আলোচনা প্রসঙ্গে কোথাও উঠে আসতো- দেখতাম কি অনর্গলভাবে চাচা বলে যাচ্ছেন- কিভাবে জঙ্গলে জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়েছে- গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাদেরকে কিভাবে তাঁরা শুশ্রূষা করেছেন- এসব।

নিজেকে যখন খুব অপরাধী মনে হলো- তখন একবার মনে মনে ভাবলাম খুঁজে দেখি চাচার নামটা সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আছে কিনা। পরক্ষণেই ভাবলাম- কী লাভ, চাচার নামটা কোথাও খুঁজে না পেলে তো শুধু আমার কষ্টই বাড়বে, আর কিছু না তো। আমার দরিদ্র চাচা জীবিতাবস্থায় জীবিকার জন্য অনেক কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হয়তো জানতেনও না 'দরিদ্র' মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার থেকে কী কী সুবিধা দেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে তাঁকে কোনোদিন একটা কথাও বলতে শুনি নি সরকারে বিরুদ্ধে- যুদ্ধ করলাম, অথচ সরকার আমারে কিছুই দিল না।

আমার চাচার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় না থাকলে এমন কীই বা ক্ষতি আমার বা চাচার পরিবারের? তাতেই তো আর প্রমাণিত হলো না যে আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। আমার চাচা যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার সবচেয়ে বড় দলিল তো আমি নিজে- এখনো চোখের সামনে উজ্জ্বল ভাসে- যুদ্ধ শেষ হবার পর কোনো এক বিকেলে চাচা বাড়ি ফিরে এলেন- আমার দাদী 'আনছের আনছের' বলে চাচার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন- সেই দৃশ্য আজও এতোটুকু ম্লান হয় নি।


আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর ২০০৬ সনের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আপনারা আমার চাচার রুহের মাগফেরাত কামনা করবেন প্লিজ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনে হাসি আর কান্না.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

জীবনে হাসি আর কান্না.....

কবি সুনির্মল বসু তার "হবুচন্দ্রের আইন" কবিতায় হবুচন্দ্র রাজা আইন করে কান্না নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ এখন সেই কল্পিত কবিতার রাজা হবুচন্দ্রের মতো আইন করে কান্না নিষিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

'৭৪ সালের কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল এখন সময়ের দাবী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৫


বিগত আম্লিক সরকারের আমলে যে কুখ্যাত আইনের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করে গায়েব করার চেষ্টা চলতো তা হলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইন ব্যবহার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণচোখ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৩৮


(ষড়ঋপু সিরিজের তৃতীয় কাহিনি — লোভ)

⸻ সতর্কীকরণ: ছায়া পড়লে আলোও কাঁপে ⸻

এই কাহিনি কেবল একটি গল্প নয়। এটি এক মানসিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে লুকিয়ে আছে মানব আত্মার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এসব লুটপাটের শেষ কোথায়!

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:১৮

আধা লিটারের পানির বোতল দোকানদার কেনে সর্বোচ্চ ১২.৫০ টাকায় আর ভোক্তার কাছে বিক্রি করে ২০ টাকা। এগুলো কি ডাকাতি না?

গোপন সূত্রে যতটুকু জানা যায়,
প্রাণ ৮.৫ টাকা কেনা
ফ্রেশ ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চারুকলায় আগুনে পুড়ে গেল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের শোভাযাত্রা উদ্‌যাপনের জন্য বানানো দুটি মোটিফ আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও আরেকটি শান্তির পায়রা।



আজ শনিবার সকালে চারুকলা অনুষদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×